ক্যাব প্রস্তাবিত জ্বালানি নীতি-২০২৪ বাস্তবায়ন বিষয়ক বিশেষ আলোচনাসভা অনুষ্ঠিত

ক্যাব প্রস্তাবিত বাংলাদেশ জ্বালানি রূপান্তর নীতি-২০২৪ বাস্তবায়নের জন্য জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষার্থীদের সাথে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
কনজুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এর উদ্যোগে ২০ আগস্ট২০২৫ বুধবার সকাল ১০.০০ টা হতে দুপুর ২.০০টা পর্যন্ত ঢাবির সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের মুজাফফর আহমেদ চৌধুরী মিলনায়তনে এই আয়োজন করা হয়। এতে উপস্থিত ছিলেন, ঢাবির অর্থনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শতাধিক শিক্ষার্থী।

গোটা পৃথিবীর মত বাংলাদেশও জ্বালানি রূপান্তর প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে। এই জ্বালানি রূপান্তর যাতে ভোক্তাবান্ধব, অর্থবহ, সাশ্রয়ীমূল্যের এবং পরিবেশ সুরক্ষা নিশ্চিত করে অগ্রসর হয় সেটাই কাংখিত লক্ষ্য। ভোক্তাবান্ধব জ্বালানি খাত ও জ্বালানি সুবিচার প্রতিষ্ঠাসহ জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবিতে কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) বহু বছর ধরে সামাজিক ও বৃদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলন করে আসছে। তারই ধারাবাহিকতায় ক্যাব, ‘বাংলাদেশ জ্বালানি রূপান্তর নীতি-২০২৪’ প্রস্তাব করেছে। এবং সেটা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে নানাবিধ কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে।

জুলাই, ২০২৪ ছাত্রজনতার গণঅভ্যুত্থানের আকাংখা ছিল সর্বত্র বৈষম্য বিলোপ। জ্বালানিতন্ত্রে জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে তরুণ ছাত্র-জনতার নেতৃত্বে জ্বালানি খাতে সর্বাত্মক বৈষম্য বিলোপে জ্বালানি সুবিচার নিশ্চিত হবে এই প্রত্যয়ে কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ(ক্যাব) এ বছরের শেষার্ধে অয়োজন করতে যাচ্ছে ‘ইয়ুথ পার্লামেন্ট অন জাস্ট এনার্জি ট্রানজিশন’ -এর সংসদীয় অধিবেশন।
জ্বালানি অপরাধ, জ্বালানি দারিদ্র, জ্বালানি অধিকার, জ্বালানি সুবিচার ও জ্বালানি নিরাপত্তা一 এসব মানদন্ডে চলমান জ্বালানি রূপান্তরকে স্বার্থক করে জনস্বার্থকে সুরক্ষা দিতে হলে ক্যাব প্রস্তাবিত জ্বালানি রূপান্তর নীতি-২০২৪ বাস্তবায়ন এখন সময়ের দাবি। কেননা জনস্বার্থ তথা জ্বালানি অধিকার সংরক্ষণের প্রশ্নে বাণিজ্যিক নয়, সেবা খাত হিসেবে জ্বালানি খাতকে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় পুনর্বহালের প্রস্তাব করা হয়েছে এই নীতিতে।
এরই প্রেক্ষাপটে ‘ক্যাব প্রস্তাবিত জ্বালানি নীতি-২০২৪ এর আলোকে জ্বালানি সুবিচার ও জ্বালানির নিরাপত্তা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষার্থিরা।

০২.
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থি নাজিফা তাজনুর, ‘জ্বালানি সরবরাহে লুন্ঠনমূলক ব্যয় ও লুন্ঠনমূলক মুনাফা’, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থি সাবাত মোস্তফা প্রথুন, ‘মূল্যহার নির্ধারণে ভোক্তা ও বিইআরসি’, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থি অরিত্র রোদ্দুর ধর, ‘জ্বালানি নিরাপত্তা সংরক্ষণে বিনিয়োগ ও মূল্যহার’, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থি মেহবুবা আফরোজ, ‘জ্বালানি খাত উন্নয়নে সুবিচার সংকট’, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থি মো: সাদমান সাকিব, ‘জ্বালানি ইউটিলিটি সমূহের সেবানীতি ও পরিচালনা পদ্ধতি’, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থি মুস্তাইন বিল্লাহ সাদ, ‘সরকারি ও বেসরকারি লাইসেন্সিদের নিয়ন্ত্রণে বিইআরসি’, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থি জুহায়ের বিন হুদা, ‘জ্বালানি অধিকার সংরক্ষণে বিচার বিভাগ’ শীর্ষক বিষয়ে আলোচনা উপস্থাপন করেন।

এই অনুষ্ঠানে সম্মানিত প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ জ্বালানি ও বিদ্যুৎ গবেষণা কাউন্সিল (বিইপিআরসি)- এর চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ওয়াহিদ হোসেন এনডিসি
(সিনিয়র সচিব)। বিশেষ অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন ক‍্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ‍্যাপক এম শামসুল আলম , এবং অধ্যাপক তানজিমউদ্দীন খান, সদস্য, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন। সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক ড. মঞ্জুর-ই-খোদা তরফদার, কোষাধ্যক্ষ, ক্যাব।

 

০৩.
আলোচনায় নিম্নোক্ত বিষয়াদির ওপরে গুরুত্ব আরোপ করা হয়:-

০১) বাংলাদেশের জ্বালানি খাতে রূপান্তরের অন্যতম অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে জ্বালানি সরবরাহব্যবস্থায় লুকিয়ে থাকা লুন্ঠনমূলক ব্যয় ও অযৌক্তিক মুনাফা অর্জনের কাঠামো।
এই পরিস্থিতি শুধু জ্বালানি সুবিচার ব্যাহত করছে না, বরং দীর্ঘমেয়াদে জ্বালানি নিরাপত্তা, পরিবেশ সংরক্ষণ এবং প্যারিস চুক্তি ২০১৫ বাস্তবায়নের লক্ষ্যকে হুমকির মুখে ফেলছে।
জ্বালানি খাতে লুন্ঠনমূলক ব্যয় ও মুনাফা কেবলমাত্র অর্থনৈতিক সমস্যা নয়, এটি একটি নৈতিক ও ন্যায্যতার প্রশ্ন। ক্যাব প্রস্তাবিত বাংলাদেশ জ্বালানি রূপান্তর নীতি ২০২৪-এ জ্বালানি সুবিচার প্রতিষ্ঠায় এই অপব্যবহার রোধে সুস্পষ্ট কর্মপন্থা প্রস্তাব করেছে। এর যথাযথ বাস্তবায়ন হলে একটি জনগণ-নিয়ন্ত্রিত, স্বচ্ছ ও দায়িত্বশীল জ্বালানি সরবরাহব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব।

০২). বাংলাদেশে এনার্জি বা জ্বালানির মূল্যহার নির্ধারণ একটি গুরুত্বপূর্ণ অথচ বিতর্কিত প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়ার মূল দায়িত্বে রয়েছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। এই কমিশনের দায়িত্ব হলো বিদ্যুৎ, গ্যাস, এলপিজি ও জ্বালানির বিভিন্ন দামের ভারসাম্য রক্ষা করা। কিন্তু বাস্তবে, মূল্যহার নির্ধারণ প্রক্রিয়ায় ভোক্তার অংশগ্রহণ সীমিত এবং জবাবদিহিতা প্রশ্নবিদ্ধ। ক্যাব প্রস্তাবিত রূপান্তর নীতির আলোকে যদি বিইআরসি’র কাঠামোগত সংস্কার, জনসম্পৃক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও তথ্য উন্মুক্ততা নিশ্চিত করা হয়, তাহলে দেশের জ্বালানি খাতে ন্যায্যতা, জবাবদিহিতা , স্বচ্ছতা অর্জন করা সম্ভব।

০৩). বাংলাদেশে জ্বালানি নিরাপত্তা রক্ষা করতে হলে বিনিয়োগ ও মূল্যহার নীতিতে রূপান্তর ঘটাতে হবে। শুধু অবকাঠামো নয়, দরকার সুবিচারভিত্তিক ট্যারিফ, গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণ, এবং দুর্নীতি ও অস্বচ্ছতা দূরীকরণ।

০৪). বাংলাদেশের জ্বালানি খাত উন্নয়নে জ্বালানি সুবিচার এখন সময়ের দাবি। ক্যাব প্রস্তাবিত জ্বালানি রূপান্তর নীতি ২০২৪ এই খাতে একটি সমন্বিত ও বিকেন্দ্রীকরণভিত্তিক পথে অগ্রসর হওয়ার দিকনির্দেশনা দেয়। তা বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, অংশগ্রহণমূলক প্রশাসন এবং আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতার সদ্ব্যবহার।
০৫). বাংলাদেশের জ্বালানি খাতের সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ বা জ্বালানি ইউটিলিটিসমূহের (যেমন পিডিবি, ডেসকো, ডিপিডিসি, তিতাসসহ অন্যান্য) সেবা নীতি, প্রাতিষ্ঠানিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ঘাটতি, পরিকল্পনার সংকট এবং ভোক্তাবান্ধব দৃষ্টিভঙ্গির অভাব বাংলাদেশের জ্বালানি সুশাসনের অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্যাব প্রস্তাবিত নীতিমালা অনুসরণ করে রাষ্ট্রীয় এবং বেসরকারি ইউটিলিটি সেবাকে নতুন কাঠামোতে রূপ দিতে হবে—যেখানে সেবা শুধুই উপরের দয়া নয়, এটি জনগণের অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবে।

০৬). জ্বালানি সুবিচার নিশ্চিত করতে হলে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) -এর ভূমিকা আরো কার্যকর, স্বচ্ছ এবং জনবান্ধব করতে হবে। সরকারি-বেসরকারি সব লাইসেন্সধারীর জন্য একটি নিরপেক্ষ, তথ্যভিত্তিক এবং অংশগ্রহণমূলক নিয়ন্ত্রক কাঠামো গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি।

 

০৭). বাংলাদেশের জ্বালানি রূপান্তর একটি ন্যায়ভিত্তিক, অংশগ্রহণমূলক ও পরিবেশসম্মত প্রক্রিয়ায় হতে হলে বিচার বিভাগের ভূমিকা অপরিসীম। ক্যাব প্রস্তাবিত বাংলাদেশ জ্বালানি রূপান্তর নীতি ২০২৪ বিচার বিভাগকে এই প্রক্রিয়ার অংশীদার হিসেবে চিহ্নিত করেছে। জনগণের জ্বালানি অধিকার রক্ষা ও আইনগত সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হলে—নীতিনির্ধারক, বিচার বিভাগ ও নাগরিক সমাজের সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম বলেন, জ্বালানি খাতের অবিচার দূর করার জন্য হাইকোর্টে অন্তত ১৫টি মামলা দায়ের করেছে ক্যাব। ক্যাবের লক্ষ্য বাংলাদেশের জ্বালানি খাতে সুবিচার নিশ্চিত করা। কিন্তু এই খাতের লুণ্ঠনকারীরা ক্ষমতাধর। তারপরও তাদের জবাবদিহির আওতায় আনার চেষ্টা করে যাচ্ছে ক্যাব। আমরা চাই- শিক্ষার্থীরাও এই মিশনে অংশগ্রহণ করে বাংলাদেশের জ্বালানি রূপান্তরে জনস্বার্থে ভূমিকা রাখুক।
আলোচনা সভায় ইউজিসির সদস‍্য ও ঢাবির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজিমউদ্দীন খান বলেন, আমাদের জ্বালানি কাঠামো ফসিল ফুয়েল নির্ভর। এই ফসিল ফুয়েল থেকে বেরিয়ে আসা জরুরি। কিন্তু এটা সম্ভব হচ্ছে না। এর মূল কারণ জ্বালানি কাঠামো বিদেশি কোম্পানি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। যার কারনে বাংলাদেশে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। তিনি আরো বলেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ইতিমধ্যে ন্যায্য জ্বালানি রুপান্তরের জন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে।
তিনি বলেন, জ্বালানি খাতের লুণ্ঠনমূলক ব্যয়ে দেশীয় গোষ্ঠীর সাথে বিদেশি গোষ্ঠীও যুক্ত রয়েছে। কারণ আমাদের জ্বালানি কাঠামো গড়ে দিচ্ছে বিদেশি কোম্পানি। অর্থাৎ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কাঠামোই বিদেশিদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। অথচ এই লুন্ঠনকারীদের এখনো আইনের আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। কিন্তু নতুন সরকারের মেয়াদ বছর পার হয়ে গেলেও এখনো তা সম্ভব না হওয়াটা দুঃখজনক। এই লুণ্ঠনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া না হলে জ্বালানি খাত দুর্নীতিমুক্ত হবে না।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ জ্বালানি ও বিদ্যুৎ গবেষণা কাউন্সিল (বিইপিআরসি)- এর চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ওয়াহিদ হোসেন এনডিসি বলেন, আমরা যখন জ্বালানির অধিকার প্রতিষ্ঠায় ভর্তুকি দেই, এতে দেখা যায় অনেক ক্ষেত্রেই এই সুবিধা প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষ পায় না। সুবিধাবাদীরাই এটা নিয়ে নেয়। তাই জনগণের অধিকার আদায়ের জন্য নাগরিক সমাজকে জাগিয়ে রাখতে হয়। জনগণ কোনো কিছু চাইলে সরকার তা করতে বাধ্য হয়।

সভাপতির বক্তব্যে ক্যাবের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মঞ্জুর-ই-খোদা তরফদার বলেন, গোটা পৃথিবীর মত বাংলাদেশও জ্বালানি রূপান্তর প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে। এই জ্বালানি রূপান্তর যাতে ভোক্তাবান্ধব, অর্থবহ সাশ্রয়ীমূল্যের এবং, পরিবেশ সুরক্ষা নিশ্চিত করে অগ্রসর হয় সেটাই আমাদের কাংখিত লক্ষ‍্য।