ওয়াসার দুর্নীতির দায়ভার ভোক্তাদের ওপর চাপিয়ে দিতে চান এমডি: গোলাম রহমান

ভোক্তাকন্ঠ ডেস্ক:

ঢাকা ওয়াসা পানির মূল্য আবার বাড়াতে চায়। বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে পানির মূল্য বাড়ানোর এ প্রস্তাবের যৌক্তিকতা, ঢাকা ওয়াসার কার্যক্রমসহ নানা বিষয় নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান। তাঁর সাক্ষাৎকারটি হুবহু পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো-

প্রথম আলো: ঢাকা ওয়াসা পানির দাম বর্তমান মূল্যের চেয়ে কমপক্ষে ২০ শতাংশ বাড়াতে চায়। বাংলাদেশসহ সারা বিশ্ব এখন এক অতিমারির ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। এ সময়ে পানির দাম বাড়ানোর প্রস্তাব কতটুকু যুক্তিযুক্ত বলে আপনার মনে হয়?

গোলাম রহমান: জীবন ধারণের জন্য পানি অপরিহার্য। নাগরিকদের জন্য পানির সংস্থান করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব হিসেবে আদিকাল থেকে বিবেচিত হয়ে আসছে। করোনা মহামারির কারণে নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর আয়রোজগার কমেছে, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মানুষের জীবন অতিষ্ঠ। এমন প্রেক্ষাপটে ওয়াসার পানির মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব সুবিবেচনাপ্রসূত নয়, যুক্তিযুক্তও নয়।

প্রথম আলো: ওয়াসা কর্তৃপক্ষ দাবি করছে, বর্তমানে প্রতি ১ হাজার লিটার পানিতে সরকারের ভর্তুকি দিতে হয় ১০ টাকা। ওয়াসার এমডি বলেছেন, সরকারের কাছ থেকে ভিক্ষা নিয়ে কোনো সংস্থা নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে না। সুপেয় পানি পাওয়া একটি অধিকার। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে সরকারের একটি প্রতিষ্ঠানের কাছে মানুষ কিছু প্রত্যাশা করতে পারে না? ওয়াসার এমডির বক্তব্যকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

গোলাম রহমান: ভর্তুকি দেওয়া হয় জনগণের পরিশোধিত শুল্ক-করের অর্থ থেকে। জনকল্যাণে ভর্তুকি দেওয়া যেতে পারে। ভর্তুকি হ্রাস করার জন্য মূল্যবৃদ্ধি নয়, পানি পরিশোধন ও সরবরাহ ব্যয় হ্রাস করার পথ বেছে নেওয়াটাই যুক্তিযুক্ত। উদাহরণস্বরূপ রাজউকের প্রধান কর্মকর্তা চেয়ারম্যান একজন অতিরিক্ত সচিব। একইভাবে বাংলাদেশ বিমান, পেট্রোবাংলা, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের প্রধান কর্মকর্তারাও অতিরিক্ত সচিব। এসব সংস্থার গুরুত্ব ও পরিচালনা কোনো অংশেই ওয়াসার থেকে কম নয়। একজন অতিরিক্ত সচিবের মাসিক বেতন ভাতা এক লাখ টাকার কাছাকাছি, আর ঢাকা ওয়াসার এমডির বেতন প্রায় সাত লাখ টাকা। এমডির পদে একজন অতিরিক্ত সচিবকে নিয়োগ দেওয়া হলেই বছরে ৫০ থেকে ৬০ লাখ টাকা সাশ্রয় সম্ভব বলে মনে হয়। ওয়াসার এমডি সংস্থাটির অমিতব্যয়িতা, অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি-অপচয়ের সব দায়ভার ভোক্তাদের ওপর চাপিয়ে দিয়ে ভর্তুকি কমানোর পথ বেছে নিয়েছেন। সংস্থাটির অপ্রয়োজনীয় ব্যয় সংকোচনে তিনি ও সরকার মনোযোগী হলে মূল্যবৃদ্ধির প্রয়োজন হবে বলে মনে হয় না।

প্রথম আলো: পানির দাম বাড়ানোকে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ বলছে ‘উৎপাদন ব্যয়ের সঙ্গে বাজার মূল্যের সমন্বয়’। আপনি কী বলেন?

গোলাম রহমান: ওয়াসার সৃষ্টি হয়েছে জনগণকে একটি অতিপ্রয়োজনীয় সেবা প্রদানের জন্য। ব্যবসায়িক বিবেচনা এ ক্ষেত্রে মুখ্য হওয়া সংগত নয়। আমি আগেই বলেছি, ওয়াসার গ্রাহকদের বিবেচনায় মূল্যবৃদ্ধির এ উদ্যোগ ওয়াসার অমিতব্যয়িতা, অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি-অপচয়ের দায়ভার ভোক্তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা বৈ কিছু নয়।

প্রথম আলো: ওয়াসা কর্তৃপক্ষ বলেছে, ওয়াসা বিদেশি ঋণে বেশ কিছু প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। আর এসব ঋণের কিস্তি পরিশোধে ওয়াসাকে অনেক বেশি টাকা পরিশোধ করতে হচ্ছে। ওয়াসার বিভিন্ন প্রকল্প নিয়ে দীর্ঘসূত্রতার কথা আমরা একাধিকবার লিখেছি। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে ঋণের বোঝা জনগণ বইবে কেন?

গোলাম রহমান: সরকার বিদেশ থেকে ঋণ ও অনুদান গ্রহণ করে বিভিন্ন সংস্থাকে প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য অর্থ প্রদান করে। অনুদানের অর্থ পরিশোধ করতে হয় না। ঋণের অর্থ সুদসহ পরিশোধযোগ্য। পরিশোধের দায়িত্ব রাষ্ট্রের। প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতায় একদিকে প্রকল্প বাস্তবায়ন ব্যয় বাড়ায়, অন্যদিকে জনগণ প্রত্যাশিত সেবা থেকে বঞ্চিত হয়। বর্ধিত ব্যয়ের দায়ভার সংস্থার কর্তাব্যক্তিদের ওপর বর্তানো যুক্তিসংগত। নিদেনপক্ষে তাঁদের জবাবদিহির আওতায় আনা ন্যায়সংগত হবে।

প্রথম আলো: ওয়াসা যে পানি সরবরাহ করে, সে পানি পানের উপযোগী নয়। সেই পানি ফুটাতে মানুষকে জ্বালানি ব্যবহার করতে হয়। তারও একটা খরচ আছে। তাই স্বল্প মূল্যে পানি দেওয়ার যে কথা ওয়াসা বলে, সেটা বাস্তবে সত্য নয়। এটা দীর্ঘদিন থেকে চলে আসছে। নাগরিক হিসেবে কীভাবে দেখেন বিষয়টি?

গোলাম রহমান: ওয়াসা সুপেয় ও নিরাপদ পানি সরবরাহ করতে অনেক ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হচ্ছে। এটা হতাশাব্যঞ্জক ও অনাকাঙ্ক্ষিত।

প্রথম আলো: মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পানির দাম প্রতিবছর ৫ শতাংশ বাড়ানো হয়। কিন্তু সুপেয় পানি এখনো অধরা। পানির গুণগত মান বৃদ্ধি না করে প্রতিবছর এর দাম বাড়ানো সামঞ্জস্যপূর্ণ কতখানি?

গোলাম রহমান: ন্যায্যতার বিবেচনায় অগ্রহণযোগ্য।

প্রথম আলো: ওয়াসা শুধু পানি সরবরাহকারী কর্তৃপক্ষ নয়, এটা পয়োনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষও। নগরীর মোট পয়োবর্জ্য প্রায় ৮৫ শতাংশ উন্মুক্ত স্থানে গিয়ে পড়ে, এর পরিশোধনে কোনো ভূমিকা নেই ওয়াসার। দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের এই ভূমিকা কীভাবে দেখেন আপনি?

গোলাম রহমান: দায়িত্ব পালনে চরম ব্যর্থতা।

প্রথম আলো: পানিসহ অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে নাগরিক সংগঠনগুলোর ভূমিকা কতটুকু কার্যকর বলে আপনার মনে হয়?

গোলাম রহমান: মূল্যনিয়ন্ত্রণ নাগরিক সংগঠনগুলোর কাজ নয়। তারা কেবল জনগণের সমস্যা ও আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা তুলে ধরতে পারে। সমাধানের দায়িত্ব সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের।

সূত্র:  প্রথম আলো