“দুধ কলা দিয়ে পোষা হচ্ছে ব্যাংক লুটেরাদের”, উচ্চ আদালত

ঢাকা, ২১ মে মঙ্গলবারঃ অর্থমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী ঋণখেলাপিদের জন্য আরও বড় ছাড় দেবার বিষয়ে, গত ১৬ মে ২০১৯-এ জারিকৃত বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘ঋণ পুনঃতফসিল ও এককালীন পরিশোধ সংক্রান্ত বিশেষ নীতিমালা’ শিরোনামে প্রকাশিত সার্কুলারের ওপর ২৪ জুন পর্যন্ত স্থিতাবস্থা জারি করেছে উচ্চ আদালত। এই সার্কুলারে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত মন্দমানে খেলাপি হওয়া ঋণ মাত্র ২ শতাংশ ডাউনপেমেন্ট নিয়ে ১০ বছরের জন্য পুনঃতফসিলের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল, এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সুদহার উল্লেখ করা হয় মাত্র ৯ শতাংশ। এমনকি পুনঃতফসিলের আগে সুদ মওকুফ সুবিধা দেওয়া যাবে বলেও উল্লেখ করা হয়েছিল।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলার স্থগিত চেয়ে আইনজীবী মনজিল মোরসেদের করা রিট আবেদনের শুনানি করে বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের হাইকোর্ট বেঞ্চ আজ এই স্থগিতাদেশ দেন।

‘ঋণ পুনঃতফসিল ও এককালীন এক্সিটসংক্রান্ত বিশেষ নীতিমালা’  শীর্ষক এ সার্কুলারের শুরুতে বলা হয়েছে, নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত বিভিন্ন কারণে ব্যবসায়ী/শিল্পোদ্যোক্তারা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ব্যাংকের ঋণ অনেক ক্ষেত্রেই নিয়মিতভাবে পরিশোধিত হচ্ছে না। সংশ্লিষ্ট ঋণ বিরূপভাবে শ্রেণীকৃত হয়ে পড়ায় ঋণ বিতরণ ও আদায় কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ অবস্থায় উৎপাদনশীল খাতসহ অন্যান্য খাতে স্বাভাবিক ঋণপ্রবাহ বজায় রাখতে এবং নিয়মিত আদায়ের লক্ষ্যে কতিপয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের জারিকৃত সার্কুলারে বলা হয়েছে, ‘২০১৮ সালের ডিসেম্বরভিত্তিক ঋণখেলাপিরা সুযোগ পাবে। ছাড় গ্রহণের জন্য আগামী ৯০ দিনের মধ্যে অর্থাৎ ১৬ আগস্টের খেলাপিদের আবেদন করতে হবে। এ সুবিধা গ্রহণকারীরা ব্যাংক থেকে আবার নতুন করে ঋণ নিতে পারবে। প্রচলিত নিয়ম মেনে সতর্কতার সঙ্গে ঋণ দিতে বলা হয়েছে। নতুন ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করলে পুনঃতফসিল সুবিধা বাতিল হবে।

সুবিধাগ্রহণের পর নিয়মিত অর্থ পরিশোধ না করলেও তাদের খেলাপি করা যাবে না। ৯টি মাসিক কিস্তির তিনটি এবং ত্রৈমাসিক তিন কিস্তির একটি পরিশোধ না করলেও নিয়মিত থাকা যাবে। তবে মাসিক কিস্তির মধ্যে ছয়টি ও ত্রৈমাসিক কিস্তির দুটি পরিশোধ না করলে পুনঃতফসিল সুবিধা বাতিল করা হবে।

স্বাধীনতার পর থেকে যারা ঋণখেলাপি, তাদের এককালীন এক্সিট সুবিধা দেওয়া হবে। এ ক্ষেত্রে তাদের খেলাপি ঋণের হিসাব হবে ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বরের এককালীন হিসাবায়ন ভিত্তিতে। অর্থাৎ ১৯৭১ সালের পর থেকে ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত যত খেলাপি ঋণ আছে, তার হিসাব করা হবে। কোনো ঋণখেলাপি যদি মনে করে, এককালীন ঋণ পরিশোধ করে খেলাপির তালিকা থেকে বেরিয়ে যাবে, তাহলে সে ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে সার্কুলারে। এতে বলা হয়েছে, ২ শতাংশ ডাউনপেমেন্টে ঋণখেলাপিরা ঋণ পরিশোধের জন্য এক বছর পর্যন্ত সময় পাবে। আগের সব সুদ বাবদ পাওনা মওকুফ করা হবে। এককালীন পরিশোধের জন্য সুদহার আরো কম, ব্যাংকের কস্ট অব ফান্ডের সমান। তবে এক বছরের মধ্যে টাকা পরিশোধ না করলে সুবিধা বাতিল হবে।এই এককালীন এক্সিট সুবিধা ও পুনঃতফসিল সুবিধা কার্যকরের ৯০ দিনের ব্যাংক ও গ্রাহকের মামলা স্থগিত করতে হবে। পরে গ্রাহক কোনো শর্ত ভঙ্গ করলে সুবিধা বাতিল করে মামলাপুনরায় চালু হবে।’

আদালতে আবেদনের পক্ষে মনজিল মোরসেদ নিজেই শুনানি করেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে শুনানি করেন মো. মনিরুজ্জামান। 

এ সময় আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে গত ১৬ মে আদালতে গিয়ে বলেছিলাম, এ সার্কুলারটি স্থগিত করা হোক। সে সময় শুনানিতে আদলত বাংলদেশের ব্যাংকের আইনজীবীকে জিজ্ঞেস করেছিল এ ধরনের সার্কুলার হয়েছে কিনা। বাংলাদেশের ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হল, এ ধরনের কেনো সার্কুলার হয়নি।

আদালত সে কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের আবেদন মঞ্জুর না করে বলেছিল, তালিকা দিতে হবে। আগামী ২৪ জুন পর্যন্ত তাদের সময় দেয় আদালত। এর প্রেক্ষিতে ১৬ মে বিকেলেই বাংলাদেশ ব্যাংক সার্কুলারটা ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে। সেটিই আমরা রিট দায়ের করে স্থগিত চেয়েছি।’

রিট শুনানিকালে, বিচারপতি এফএম নাজমুল আহসান ও বিচারপতি কেএম কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ তাঁদের পর্যবেক্ষণে, বাংলাদেশ ব্যাংকের জারি করা ওই সার্কুলারকে আদালত ‘দুষ্টের পালন, শিষ্টের দমন’ এবং বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের অর্থনীতি শেষ করে দিচ্ছে এবং ব্যাংক লুটেরাদের দুধ কলা দিয়ে পুষছে বলে মন্তব্য করেন’।