ছুটি বাড়ার সঙ্গে শিক্ষার্থীদের মধ্যে পর্যায়ক্রমে বেড়েছে হতাশা

গতবছরের ১৮ মার্চ থেকে বন্ধ রয়েছে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ফলে অনাগত ভবিষ্যৎ, অনিশ্চিত শিক্ষাজীবন, নানাবিধ পারিবারিক সমস্যাসহ বিভিন্ন কারণে শিক্ষার্থীদের মাঝে বাড়ছে বিষণ্ণতা ও হতাশা। সবচেয়ে বেশি বিষণ্নতা ও হতাশায় ভুগতে দেখা গেছে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের।

একদিকে বয়স শেষ হচ্ছে, অন্যদিকে সবকিছু বন্ধ। এমন অবস্থায় হতাশা এবং মানসিক অবসাদে নুয়ে পড়ছেন তারা। করোনার কারণে দীর্ঘ ছুটিতে সবকিছু স্থবির হয়ে পড়ায় স্বাভাবিক জীবন ধারা থেকে তারা ছিটকে পড়েছেন। শিক্ষার্থীরা বলেন, বন্ধের প্রথম অবস্থায় বাড়িতে নিশ্চিন্তে থাকলেও এখন ক্রমেই তা দুশ্চিন্তায় পরিণত হচ্ছে। বাড়ছে হতাশা ও বিষাদ। কেননা, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত অধিকাংশ শিক্ষার্থীই মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান, যাদের সিংহভাগই টিউশনি অথবা খণ্ডকালীন চাকরির সামান্য টাকায় নিজের চলাফেরা ও পড়াশোনার খরচ নির্বাহ করতেন। কিন্তু এই দীর্ঘ ছুটিতে অনেকেই তাদের আয়ের সেই উৎস হারিয়েছেন। ফলে এখন তাদের মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে বলে জানান, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা।

আমার সরকারি চাকরিতে যোগ দেওয়ার বয়স প্রায় শেষের দিকে। সেশনজটসহ নানা সমস্যায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাস করতেই দীর্ঘদিন লেগেছে। এখন যখন সরকারি চাকরির জন্য চেষ্টা করব বা করছি, তখনই সবকিছু বন্ধ। এমন অবস্থায় যদি সবকিছু স্বাভাবিক না হয়, চাকরির পরীক্ষা না হয়, তবে দীর্ঘ দিনের সব চেষ্টা ও স্বপ্ন বিফলে যাবে। এসব নিয়ে আমি মানসিকভাবে খুবই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত, জানান ঢাকা কলেজ থেকে স্নাতকোত্তর পাস করা ওবায়দুর রহমান।

করোনার আগে শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে এসে ক্লাস করা, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়া, বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে নিজেদের জড়িত রাখলেও দীর্ঘ সময় ক্যাম্পাস বন্ধ থাকায় সেটি সম্ভব হচ্ছে না৷ আর দীর্ঘ ছুটিতে সবচেয়ে বেশি বেকায়দায় পড়েছেন মেয়ে শিক্ষার্থীরা। লম্বা সময় বাড়িতে বেকার বসে থাকায় পারিবারিক চাপে অনিচ্ছা সত্ত্বেও অনেককেই বসতে হচ্ছে বিয়ের পিঁড়িতে। ফলে ভবিষ্যৎ শিক্ষা জীবন নিয়েও তৈরি হচ্ছে অজানা আতঙ্ক এবং শঙ্কা।

শিক্ষার্থীদের অনলাইন কাউন্সেলিং ও প্রতিষ্ঠানের স্ব স্ব বিভাগ থেকে নিয়মিত পরিচর্যায় পরামর্শ দিলেন ঢাকা কলেজের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হাফিজা সুলতানা। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, হতাশা থেকেই শিক্ষার্থীরা মানসিক অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ছে৷ বর্তমানে অনলাইন ক্লাসে শুধু একাডেমিক বিষয় পড়ানো হচ্ছে৷ শিক্ষার্থীদের মানসিক শক্তি বাড়াতে অনলাইনে মোটিভেশনাল ক্লাসের ব্যবস্থা করা উচিত৷ দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা অতিমাত্রায় অনলাইন নির্ভর হয়ে পড়ছে৷ এতে অনেক শিক্ষার্থীই ইন্টারনেটের অপব্যবহারের মাধ্যমে অনেক ক্ষতিকর জিনিসের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েছে৷ দেশের বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থীদের মানসিক অবসাদগ্রস্ততা দীর্ঘমেয়াদে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলেও মনে করেন স্নাতকের শিক্ষার্থী সায়মা নাহার দিনা।

করোনাভাইরাস পরিস্থিতি একটা দুর্যোগ৷ বিগত কয়েক দশকে এমন দুর্যোগ আমাদের জীবনে আসেনি৷ শিক্ষার্থীরা দীর্ঘদিন ক্লাসে আসতে পারছে না৷ এই দীর্ঘ বিরতি তাদের মধ্যে ‘মানসিক অসুস্থতা’ তৈরি করেছে৷ এটা থেকে আবার ‘রেসিডুয়াল ডেভিয়েন্স’ তৈরি হচ্ছে৷ ফলে অনেক শিক্ষার্থীরই নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় হচ্ছে৷ নানা অপরাধে শিক্ষার্থীরা জড়িয়ে পড়ছে৷ এমন অবস্থায় পরিবার থেকে শিক্ষার্থীদের মানসিক সাপোর্ট দিতে হবে। এছাড়া এই মুহূর্তে ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং শিক্ষকদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সম্পর্কের উন্নয়নসহ প্রতিষ্ঠানিকভাবে কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন বলেও মনে করেন, সমাজবিজ্ঞানী ও ঢাকা কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আবু সিনা সৈয়দ তারেক।