পরিবেশের নতুন আতংক ই বর্জ্য

বর্তমান বিশ্বে পরিবেশের একটি নতুন ইস্যু হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে ই-বর্জ্য। মূলত অফিস-আদালত, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ও বাসাবাড়িতে ব্যবহারের পর বিভিন্ন ধরনের ইলেকট্রিক ও ইলেকট্রনিক্স দ্রব্য যখন অচল বা সচল অবস্থায় আমরা ফেলে দেই তখনই তা  ই-বর্জ্যে পরিণত হয়। কখনো কখনো তা পূনঃ ব্যবহার উপযোগী করা হলেও অধিকাংশ সময়ে তা স্থায়ীভাবে বর্জ্যে পরিণত হয়। ইংরেজিতে এগুলো  Wast Electrical and Electronic Equipment সংক্ষেপে WEEE এবং বাংলায় ই-বর্জ্য হিসেবে পরিচিত।

প্রযুক্তির অভূতপূর্ব উন্নতি, প্রতিদিন নতুন নতুন আপডেটেড ভার্সনের উদ্ভাবন, নতুন পণ্যের বহুমুখী কার্যকারিতা, ধারণ ক্ষমতার বৃদ্ধি, আকর্ষণীয় ডিজাইন, সঙ্গে মানুষের আয় বৃদ্ধি এবং ফ্যাশনেবল ও আয়েসি জীবনের প্রতি মানুষের সহজাত আকর্ষণ ই-বর্জ্য সৃষ্টির কারণ বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। পুরনো ডিভাইসগুলো দীর্ঘদিন ব্যবহারের মত টেকসই না হওয়া, মেরামত খরচ লাভজনক ন হওয়া এবং ক্ষেত্রবিশেষে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলোর আগ্রাসী বাজারজাতকরণ কৌশল ও ই-বর্জ্য সৃষ্টির অন্যতম কারণ।

পরিত্যক্ত ডিভাইসগুলি যত্রতত্র নিক্ষেপ এবং নিয়মকানুনহীন সংগ্রহ ও পুনঃচক্রায়ন কৌশলের কারণে দিন দিন তা জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের প্রতি হুমকি হয়ে উঠছে । এসব কারণে বর্তমান বিশ্বে ই-বর্জ্য একটি অন্যতম পরিবেশগত সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ই-বর্জ্য সৃষ্টির উৎসঃ
ই-বর্জ্যকে একেক দেশে একেক ভাবে নির্দেশ করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রে কনজ্যুমার ইলেকট্রনিক্সকে (টিভি, কম্পিউটার প্রভৃতি) আর ইউরোপে ব্যাটারি বা পাওয়ার কর্ড সম্বলিত সব ইলেকট্রিক দ্রব্য কে বোঝায়। উপাদান এবং গাঠনিক বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে ই-বর্জ্য দুই ধরনের হয়ে থাকে। লৌহজাত এবং লৌহ বহির্ভূত (প্লাস্টিক, তামা, গ্লাস ,ফাইবার, কার্বন প্রভৃতি)। তবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ই-বর্জ্য কে দশটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করেছে। উল্লেখ্য যে ই-বর্জ্যের উৎস ভিত্তিক এই বিভাজন বিশ্বে সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য।

১। বড় ধরনের গৃহস্থালি যন্ত্রপাতি
    (Large household appliances)
  রেফ্রিজারেটর, ফ্রিজার, ওয়াশিং মেশিন, ক্লথ ড্রায়ার,
  ডিশ ওয়াশার, রান্নার বৈদ্যুতিক চুলা, হট প্লেট,
  মাইক্রোওয়েভ, ইলেকট্রিক ফ্যান, এয়ার কন্ডিশনার।
   
২। ছোট ধরনের গৃহস্থালি যন্ত্রপাতি
    (Small household appliances)
    ভ্যাকুয়াম ক্লিনার, টোস্টার, গ্রাইন্ডার, কফি মেকার,
    ইলেকট্রিক শেভার, ট্রিমার, হেয়ার ড্রায়ার, রাইস
    কুকার, ওয়াটার হিটার, কারি কুকার।

৩। তথ্যপ্রযুক্তি এবং যোগাযোগ বিষয়ক যন্ত্র
     (Information technology and
      telecommunication)
     মেইনফ্রেম কম্পিউটার ও মিনি কম্পিউটার,ডেস্কটপ
     ল্যাপটপ, পাম্পটপ, ট্যাব, নোটবুক, প্রিন্টার,টোনার,
     ফটোকপিয়ার, টেলিফোন ও সেলফোন, পেনড্রাইভ,
     স্ক্যানার, ইন্টিগ্রেটেড সার্কিট, ব্রডব্যান্ড ও ওয়াইফাই
      যন্ত্রাদি।

৪। ভোগ্যপণ্য যন্ত্রাদি
     (Consumer equipment)
   রেডিও,টেলিভিশন, ভিডিও ক্যামেরা, ভিডিও
   রেকর্ডার, ডিভিডি প্লেয়ার, স্টেরিও রেকর্ডার,
   ডিজিটাল ক্যামেরা ,ডিএসএলআর,এমপ্লিফায়ার
   এবং হেডফোন সহ গান শোনার নানান যন্ত্রাদি।

৫। আলোকিতকরণ সামগ্রী
     (Lighting equipment)
    ফ্লুরোসেন্ট বাল্ব ,এনার্জি সেভিং বাল্ব, উচ্চমাত্রার
     ডিসচার্জ ল্যাম্প।

৬। ইলেকট্রিক এবং ইলেকট্রনিক টুল
     ড্রিল মেশিন, কাঠ চেরাই মেশিন, সোল্ডারিং
     আয়রন, খননযন্ত্র, কাঠ ও অন্যান্য ধাতব দ্রব্যাদি
     প্রস্তুতির টার্নিং, মিলিং, গ্রাইন্ডিং, ফোল্ডিং ও বেন্ডিং
     মেশিন।

৭। খেলনা, বিনোদন ও খেলাধুলার সামগ্রী
     ইলেকট্রিক ট্রেন ও রেসিং কার সেট, ভিডিও গেম,
    খেলাধুলা ও ব্যায়ামের যন্ত্রাদি।

৮। চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য সামগ্রী
    রেডিওথেরাপি মেশিন ,এক্সরে, সিটি স্ক্যান,
    ম্যামোগ্রাফি মেশিন, ডায়ালাইসিস, ভেন্টিলেটর,
    নিউক্লিয়ার মেডিসিন মেশিন প্রভৃতি।

৯। পরিবীক্ষণ ও নিয়ন্ত্রক যন্ত্রাদি
    স্মোক ডিটেক্টর, হেয়ারিং রেগুলেটর, থার্মোস্ট্যাট,
    ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা প্রভৃতি।

১০। অটোমেটিক ডিসপেন্সার
      গরম পানিয়ের মেশিন ( চা, কফি ), গরম বা ঠাণ্ডা
      পানির ডিসপেন্সার, ওয়াটার পিউরিফায়ার, টাকা
      গণন যন্ত্র ,সব ধরনের স্বয়ংক্রিয় ডিসপেন্সার
      প্রভৃতি।

ই-বর্জ্যের ঝুঁকিঃ
প্রযুক্তির বিপ্লবের এই যুগে আমাদের জীবনযাত্রা সহজ ও স্বচ্ছন্দময় করার জন্য নিত্যনতুন নানা ধরনের পণ্য উদ্ভাবন হচ্ছে। কিছুদিন ব্যবহারের পরে সেগুলোর কর্মক্ষমতা কমে গেলে, নষ্ট হয়ে গেলে অথবা নতুন আকর্ষণীয় ডিভাইসের আকর্ষণে আমরা পুরনো ডিভাইসগুলো ফেলে দেই । যত্রতত্র পড়ে থাকার পর এগুলো একসময় ভাঙ্গারীর দোকান থেকে ভাগাড়ে, আবার কখনো বা পুনঃচক্রায়নের জন্য পরিশোধনাগারে স্থান পায়। এই পুরো প্রক্রিয়ায় বর্জ্য গুলো উন্মুক্ত আকাশের নিচে পড়ে থেকে রোদ, জলে, ভূগর্ভে যেমন দূষণ ছড়ায় তেমনি এগুলো সংগ্রহ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত মানুষের মধ্যেও স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।

এসব কারণে ইলেকট্রিক্যাল ও ইলেকট্রনিক বর্জ্য অতি দ্রুত দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে । বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচির উদ্যোগে আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত এক কনফারেন্সে ই-বর্জ্য কে ‘ New and emerging environmental threats to human health’ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

আধুনিক ইলেকট্রনিক পণ্যে ৬০ টির মতো বিভিন্ন ধরনের উপাদান থাকে। এর মধ্যে কিছু উপাদান মূল্যবান, কিছু ঝুঁকিপূর্ণ, আর কিছু উপাদান একই সঙ্গে মূল্যবান ও ঝুঁকিপূর্ণ। ই-বর্জ্যৈ থাকা এসব উপাদান গুলো হচ্ছে সিসা, ক্যাডমিয়াম, বেরিলিয়াম , ক্রোমিয়াম, তামা, অ্যালুমিনিয়াম, সোনা, রূপা , প্যালাডিয়াম, প্লাটিনাম , নিকেল,টিন, লেড (দস্তা), লোহা, সালফার, ফসফরাস, আর্সেনিক, পলিভিনাইল ক্লোরাইড (পিভিসি), পলিক্লোরিনেটেড বাই ফিনাইল(পিসিবি) প্রভৃতি।