দীর্ঘস্থায়ী লকডাউনে অর্থনীতির চাকা সচল রাখা যাবেনা

দীর্ঘদিন ধরে করোনার ভয়াবহতা চলছে। করোনা তাণ্ডবলীলা চালিয়ে যাচ্ছে সারা পৃথিবীতে। বাংলাদেশ করোনার প্যানডেমিক চলছে তার আপন গতিতে। ১লা জুলাই থেকে লকডাউন শুরু হয়েছে, ১৪ জুলাই পর্যন্ত চলবে। ১লা জুলাই থেকে সারাদেশে কঠোর বিধিনিষেধের লকডাউন ঘোষণা করে সরকার। বিধিনিষেধ বাস্তবায়ন করতে পুলিশের পাশাপাশি মাঠে রয়েছে বিজিবি ও সেনাবাহিনী। জরুরী কাজ ছাড়া কেউ বাইরে বের হলে তাদের ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে গ্রেফতার ও জরিমানা করা হচ্ছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে প্রধান চ্যালেঞ্জ হবে অর্থনীতির চাকা সচল রাখা।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যত দ্রুত সম্ভব করোনার টিকা জোগাড় করতে হবে। সবাইকে বিনামূল্যে টিকা দেওয়া নিশ্চিত করতে হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সংসদে অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে বলেছেন “টিকার জন্য যত টাকা লাগে দেব”। বাংলাদেশের জন্য লকডাউন করোনা প্রতিরোধের জন্য যথাযথ মাধ্যম হতে পারে না। করোনা মহামারীর কারণে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপরেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। করোনা ভাইরাসে শুধু মৃত্যুই বাড়ছে না স্থবির করে দিয়েছে জনজীবন ও উৎপাদন প্রক্রিয়া। অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারাকাত এর গবেষণা থেকে জানা যায় দেশের ছোট-বড় সব ধরনের পাইকারি ও খুচরা ব্যবসা, হোটেল, চায়ের দোকানি মুদি দোকান, মনোহারী দোকান আছে প্রায় ৮৬ লাখ ৫৩ হাজার ৮৯৪ জন। এরমধ্যে গ্রামে অবস্থান হচ্ছে ৩৪ লাখ ৮৮ হাজার ৯২০ জন। আর শহরে অবস্থান ৫১ লাখ ৬৪ হাজার ৯১৪ জন। এরমধ্যে ফেরিওয়ালা হকার ও ভ্যানে পণ্য বিক্রেতা আছেন ২৭ লাখ ৫৩ হাজার ৭১৯ জন, চা পান বিক্রেতা আছেন হাজার ১৯ লাখ ৪৫ হাজার ৬৮৫ জন। এরা সবাই চলমান এই কঠোর লকডাউনে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এছাড়া নির্মাণ খাতে ৩৪ লাখ লোক ও পরিবহন খাতে আছেন ৫২ লাখ শ্রমিক। এসব খাতের লোকজন কর্মহীন হয়ে দিনাতিপাত করছেন বর্তমান পরিস্থিতিতে। উন্নত দেশের মতো এ সমস্ত মানুষকে প্রণোদনা বা ক্ষতিপূরণ দেয়া সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়।

বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেছেন অর্থনীতি সচল রাখাই এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ। সচলের প্রধান উপকরণ হচ্ছে ভ্যাকসিন। তিনি আরো বলেছেন ভোক্তা ব্যয় করতে না পারলে রাজস্ব আহরণ হবে না। লকডাউন এ ভোক্তা ব্যয় করতে পারবে না, এতে রাজস্ব অর্জন কঠিন হবে। যেভাবে করোনার ভয়াবহতা বাড়ছে সবাই স্বাস্থ্যবিধি না মানলে পরিস্থিতি আরও মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। শহরের তুলনায় গ্রামের মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না। লকডাউন চলাকালে অফিস বন্ধ থাকার সুবাদে ৪ দিন গ্রামে থেকেছি। জুমার নামাজে মসজিদে গিয়ে দেখলাম আমি সহ মোট তিনজন মাস্ক পরিধান করে মসজিদে গিয়েছি। গ্রামাঞ্চলে খুব কম সংখ্যক মানুষেই টিকা নিয়েছেন। গ্রামের মানুষ স্বাস্থ্যবিধি পরিপালন করছেন না। গ্রামাঞ্চলে করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধি পাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে এখনই দৃষ্টি না দিলে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে। গ্রামের মানুষ যাতে করোনার টিকা নেয় সেই ব্যবস্থা করতে হবে। তাছাড়া মাস্ক পড়াসহ সুরক্ষামূলক বা অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি পরিপালন করতে যথাযথ কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। করোনা সংক্রমণ উদ্বেগজনক হারে বেড়ে যাওয়ায় মসজিদে নামাজ আদায়ের ক্ষেত্রে নয় দফা নির্দেশনা দিয়েছে সরকার। অন্যান্য সব ধর্ম প্রতিষ্ঠান ও উপাসনালয়ে প্রবেশের ক্ষেত্রে মাস্ক পরিধান ও স্বাস্থ্যবিধি পরিপালন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। দীর্ঘস্থায়ী লকডাউনে অর্থনীতির চাকা সচল রাখা যাবেনা

মসজিদে নামাজ আদায়ে ৯ দফা সরকারি নির্দেশনা হলোঃ

১) মসজিদে প্রবেশ দ্বারে হ্যান্ড স্যানিটাইজার হাত ধোয়ার ব্যবস্থা সহ সাবান পানি রাখতে হবে এবং মুসল্লিদের অবশ্যই মাস্ক পরে মসজিদে আসতে হবে।

২) প্রত্যেকে নিজ নিজ বাসা থেকে অজু করে সুন্নত নামাজ ঘরে আদায় করে মসজিদে আসতে হবে এবং ওযু করার সময় কমপক্ষে ২০ সেকেন্ড সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে।

৩) মসজিদে কার্পেট বিছানো যাবে না পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের আগে সম্পূর্ণ মসজিদ জীবানুনাশক দিয়ে পরিষ্কার করতে হবে। নিজ নিজ দায়িত্বে জায়নামাজ নিয়ে আসতে হবে।

৪) কাতারে নামাজ দাঁড়ানোর ক্ষেত্রে শারীরিক দূরত্বও নিশ্চিত করতে হবে।

৫) শিশু, বৃদ্ধ, যেকোনো অসুস্থ ব্যক্তি এবং অসুস্থদের সেবায় নিয়োজিত ব্যক্তি জামাতে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকবে।

৬) সংক্রমণ রোধ নিশ্চিতকল্পে মসজিদের ওজুখানায় সাবান বা হ্যান্ড স্যানিটাইজার রাখতে হবে। মসজিদের সংরক্ষিত জায়নামাজ ও টুপি ব্যবহার করা যাবে না।

৭) সর্বসাধারণের সুরক্ষা নিশ্চিতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ, স্থানীয় প্রশাসন এবং আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রনকারী বাহিনীর নির্দেশনা অবশ্যই অনুসরণ করতে হবে।

৮) করোনা ভাইরাস মহামারী থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য নামাজ শেষে মহান আল্লাহতালার দরবারে খতিব ইমাম ও মুসল্লিরা দোয়া করবেন।

৯) সম্মানিত খতিব ইমাম এবং মসজিদ পরিচালনা কমিটি বিষয়গুলো বাস্তবায়ন নিশ্চিত করবেন।

চিকিৎসকরা পরামর্শ দিয়েছেন নিজের জীবন রক্ষার্থে বর্তমান পরিস্থিতিতে একসাথে দুটি মাস্ক ব্যবহার করোনা থেকে বাঁচাতে রাখতে পারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। শুধুমাত্র স্বাস্থ্যসেবা ও তার উপর নির্ভরশীল থাকলে চলবে না। নিজ নিজ অবস্থান থেকে ভূমিকা রাখা ও জরুরি। গত বছর দীর্ঘ লকডাউন হয়েছে তখন ও অনেক মানুষ জীবিকা হারিয়েছেন। ২০১৯ সালের শেষের দিকে দারিদ্র্যের হার ছিল ২০ শতাংশের মতো, সেটা বেড়ে ৪১% হয়ে গেছে (সূত্র দৈনিক প্রথম আলো ৬ এপ্রিল ২০২১) সুতরাং দীর্ঘমেয়াদি লকডাউন থাকলে অর্থনীতির চাকা বন্ধ হয়ে যাবে আর অর্থনীতির চাকা বন্ধ হলে করোনা আক্রমণ করার আগেই দরিদ্র ও খেটে খাওয়া মানুষ না খেয়ে মারা যাবে। আমাদের মনে রাখতে হবে পৃথিবীর অন্যান্য উন্নত দেশের মতো মাসের পর মাস লকডাউন দেয়া যাবে না। যেভাবে কঠোর লকডাউন এ আইন প্রয়োগকারী সংস্থা সমূহ তৎপর দেখা গেছে ঠিক সেভাবে লকডাউন পরবর্তী সময়ে স্বাস্থ্যবিধি মানতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সভা-সমাবেশ সামাজিক আড্ডা বন্ধে কঠোর ভূমিকা নিতে হবে। পাশাপাশি মনে রাখতে হবে, দেশে একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে মানুষকে প্রজ্ঞা ও ধৈর্য্যের সাথে সচেতন করতে হবে। প্রয়োজনে আইন অনুযায়ী জরিমানা করতে হবে, গ্রেফতার করে মামলা দায়েরও করা যেতে পারে, কোন অবস্থাতেই কোন নাগরিককে অমর্যাদার ও অমানবিক শাস্তি দেয়া যাবে না। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সংবিধানের ৩৫(৫) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নির্যাতনের মতো অমর্যাদাকর দন্ড প্রদান নিষিদ্ধ। এই অনু্চ্ছেদ অনুযায়ী কাউকে অমর্যাদাকর, নিষ্ঠুর লাঞ্চনাকর, অমানবিক দন্ড প্রদান করা যাইবেনা কারো সহিত অনুরুপ আচরনও করা যাইবেনা।


আশার কথা হলো পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে করোনার ভয়াবহতা কমতে শুরু করেছে, বেশ কিছু দেশে লকডাউনও তুলে দেওয়া হয়েছে। বিশ্বখ্যাত ন্যাচার জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণা পত্রে গবেষকরা দাবি করেছেন, শক্তির শীর্ষে পৌঁছেছে করোনাভাইরাস। ডেল্টা ভেরিয়েন্ট রূপে এই মুহূর্তে তাণ্ডব চালাচ্ছে বিশ্বব্যাপী। তবে এটির ক্ষমতা এখন ক্রমেই শেষ হয়ে আসছে। তারা বলছেন, করোনা রূপান্তরিত হতে হতে এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে, যা আরো বেশি সংক্রমণের জন্য আর রূপান্তরিত হবে না, এটি চূড়ান্ত একটি ভেরিয়েন্ট, যা ডেমিন্যান্ট স্ট্রেইন হিসেবে আরও কিছু দিন থাকবে। তবে ডেল্টা ভেরিয়েন্টই সেই ভেরিয়েন্ট কিনা তা নিশ্চিত হতে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। কারণ ডেলটা এখনো ডেমিন্যান্ট হয়ে উঠেনি তবে শীঘ্রই হয়ে উঠবে বলে বিজ্ঞানীরা মনে করছেন।   

ড. মোহাম্মদ আবু তাহের

দীর্ঘস্থায়ী লকডাউনে অর্থনীতির চাকা সচল রাখা যাবেনা
লেখক: ড. মোহাম্মদ আবু তাহের (লেখক-গবেষক, কলামিস্ট ও ব্যাংকার)

মতামত কলামের লেখা পাঠকের নিজস্ব মতামত।

এর মাধ্যমে ভোক্তাকন্ঠের নিজস্ব মতামত প্রতিফলিত হয় না বরং মতামতের জন্য লেখক এককভাবে দায়ী।

ডিসক্লেইমার(Disclaimer)