কঠিন বর্জ্য : পরিবেশ ধ্বংসের প্রধান কারণ

মানব সভ্যতা উন্নয়নের সাথে মানবজাতির যত উপকার সাধন হয়েছে বিভিন্ন ধরনের সমস্যাও তত প্রকট হয়ে উঠেছে। আজকের পৃথিবীতে অন্যতম চ্যালেঞ্জ হচ্ছে যথাযথ বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে প্রকৃতিকে জীবের বসবাসযোগ্য রাখা। বিশ্বে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে বর্জ্যরে পরিমাণও মাত্রাতিরিক্ত বাড়ছে। উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশেও একই চিত্র। প্রতিনিয়ত জনসংখ্যার উচ্চ ঘনত্বের সাথে বর্জ্যরে উৎপাদন হচ্ছে অধিকহারে। যার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় বর্জ্য নিয়ন্ত্রকদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রতি বছর মাথাপিছু ১৫০ কিলোগ্রাম এবং সর্বমোট ২২.৪ মিলিয়ন টন বর্জ্য উৎপন্ন হচ্ছে যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এভাবে চলতে থাকলে ২০২৫ সাল নাগাদ মাথাপিছু বর্জ্য সৃষ্টির হার হবে ২২০ কিলোগ্রাম এবং সর্বমোট বর্জ্যরে পরিমাণ ৪৭ হাজার ৬৪ টনে গিয়ে দাঁড়াবে, যা পরিবেশের জন্য হুমকি হয়ে উঠবে। বর্জ্য বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। কঠিন, তরল, বায়বীয়।

মানুষের ব্যবহার্য জিনিসপত্র যখন অকেজো অথবা অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে তখন এগুলো কঠিন বর্জ্য হিসেবে বিবেচিত হয়। উৎস অনুসারে কঠিন বর্জ্য বিভিন্ন ধরনের হতে পারে। গৃহস্থালি বর্জ্য, শিল্প কারখানার বর্জ্য, শহরাঞ্চলের বর্জ্য, হাসপাতালে ব্যবহৃত সরঞ্জামাদি, বিপজ্জনক বর্জ্য, কৃষি বর্জ্য ও প্লাস্টিক উল্লেখযোগ্য। যথাযথ বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অভাবে প্রতিনিয়ত পরিবেশের উপাদান ও বসবাসরত জীবের ক্ষতি হচ্ছে। পরিবেশের প্রধান তিনটি উপাদান হচ্ছে মাটি, পানি ও বায়ু। কঠিন বর্জ্যরে কারণে পরিবেশের এ সবগুলো উপাদান মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মানুষ যত্রতত্র ময়লা আবর্জনা ফেলে রাখে যার বেশির ভাগই কঠিন বর্জ্য। এগুলো মাটির সাথে মিশে মাটিতে বসবাসরত অণুজীবকে ক্ষতিগ্রস্ত করে মাটির অত্মত্ব ক্ষারকত্ব হ্রাস বৃদ্ধি করে এবং কৃষিজমির ক্ষতিসাধন করে ও এর বন্ধন দুর্বল করে দেয়। আর এই বর্জ্যপদার্থ চুইয়ে গিয়ে ভূগর্ভস্থ পানির ক্ষতিসাধন করে। 

এ ছাড়া বৃষ্টির সময় এসব বর্জ্য খাল-বিল-নদী-নালার পানির সাথে মিশে গিয়ে পানি দূষণ করে। এতে মানুষ, জলজপ্রাণী রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ে। ময়লা আবর্জনার দুর্গন্ধ বাতাসে ছড়িয়ে বাতাস দূষিত করে। এ ছাড়া মিথেন কার্বন-ডাই-অক্সাইড ইত্যাদিসহ বিভিন্ন ক্ষতিকর গ্যাস বায়ুতে মিশে বায়ু দূষণ করে। কঠিন বর্জ্যরে সবচেয়ে বড় উৎস হচ্ছে শহরাঞ্চলের বর্জ্য। শহরের বর্জ্যগুলো বাসাবাড়ি, হাসপাতাল, কলকারখানা ইত্যাদি থেকে উৎপন্ন হয়। রান্নাঘরের বর্জ্য থেকে শুরু করে পরিধেয়, প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ, প্লাস্টিক, কাগজ, ব্যাটারিসহ বিভিন্ন ক্ষতিকর বর্জ্যও উৎপন্ন হয়।

দেশের অধিকাংশ পৌর এলাকার বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সেকেলে। রাস্তার পাশে ডাস্টবিনগুলো ময়লা আবর্জনায় উপচানো থাকে। তীব্র দুর্গন্ধ ছড়ায়। পরিবেশ নোংরা হয়ে থাকে। পৌর কর্তৃপক্ষ সেখান থেকে ময়লা সরিয়ে শহরের আশপাশের খাল বা খানাখন্দে ফেলে রাখে। সেখান থেকে নতুন করে আরো বিশদ আকারে জীবাণু ও দুর্গন্ধ ছড়ায়। শহরের কল-কারখানাগুলো থেকে প্রতিনিয়ত বিষাক্ত বর্জ্য উৎপন্ন হয়। এগুলোর ব্যবস্থাপনা ব্যয়বহুল বলে অনেক প্রতিষ্ঠান এগুলো মুক্তভাবে শহরের খাল-বিল নদী-নালায় ফেলে দেয়। এগুলোর মধ্যে কাপড়ের রঙ, চামড়া শিল্পে উৎপন্নবর্জ্য, বিভিন্ন যন্ত্রাংশ, কলকব্জা এসব উল্লেখযোগ্য। সাভারের চামড়া শিল্প নগরীতে উৎপন্ন চামড়ার উচ্ছিষ্ট, ঝিল্লিসহ কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কোনো পদক্ষেপ এখনো সম্পূর্ণরূপে গৃহীত হয়নি।

যখন জীববৈচিত্র্যের কথা আসে আমাদের বর্জ্য সমস্যাটি বিশ্বের প্রজাতির স্বাস্থ্যকে মারাত্মকভাবে জর্জরিত করে। কঠিন বর্জ্য স্যাঁতসেঁতে উন্নয়নশীল দেশগুলোর পরিবেশ মারাত্মকভাবে নষ্ট করছে। বিশ্ব পরিবেশের সাথে সাথে বাংলাদেশেও গত কয়েক দশকে অবনতি দ্রুত গতিতে চলছে। আমরা যেভাবে বর্জ্য নিষ্পত্তি করি তা হতাশাব্যঞ্জক। একমাত্র এই দশকে বর্র্জ্য নিষ্পত্তি আরো বেশি গাফিল হয়ে পড়েছে। আমাদের চারপাশের পরিবেশের এ বিপর্যয়ের একটি অন্যতম কারণ হচ্ছে বায়ু দূষণ। বায়ু দূষণের কারণে বিশ্বে প্রতিবছর ৭০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। পৃথিবীর ৯১ শতাংশ মানুষ এমন জায়গায় বসবাস করে যেখানে বায়ু দূষণের মাত্রা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদিত মাত্রার চেয়ে বেশি। বিশ্বজুড়ে প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৯ জন দূষিত বায়ু সেবন করে। আমাদের দেশে বায়ু দূষণের বড় কারণ সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অভাব। জলবায়ু পরিবর্তন হয়ে বেড়ে গেছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ। বাংলাদেশে ২২ শতাংশ মানুষ বাতাসে ভাসমান বস্তুকণা ও ৩০ শতাংশ মানুষ জ্বালানি সংশ্লিষ্ট দূষণের শিকার। প্রকৃতির জীববৈচিত্র্য ও ভারসাম্য রক্ষার্থে এখনি সবাইকে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

লেখক : শিক্ষার্থী।
ইমেইল : [email protected]