ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণে গণমাধ্যমের ভূমিকা

ভোক্তা অধিকার আন্দোলনের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। ভোক্তা আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকবৃন্দ। ১৯৩০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভোক্তাগন ভোক্তা ইউনিয়ন নামে নিজস্ব একটি সংগঠন গড়ে তোলেন।
বাংলাদেশের ক্রেতা ভোক্তাদের সচেতনতার জন্য সরকারী বেসরকারী উদ্যোগের পাশাপাশি গণমাধ্যমের ভূমিকা
সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন। বাংলাদেশের ক্রেতা সাধারণের অধিকার নিশ্চিত করার দাবী ও দীর্ঘদিনের।
কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) ও অন্যান্য সংগঠন বাংলাদেশের ভোক্তা অধিকার নিশ্চিত করার জন্য দীর্ঘদিনের আন্দোলনের ফলে সরকার ভোক্তা অধিকার সংরক্ষন আইনে ২০০৯ প্রণয়ন করে।
সাধারণভাবে বলতে গেলে সকল মানুষই ভোক্তা। তবে ধনী বা স্বচ্ছল ভোক্তাদের প্রধান সমস্যা হচ্ছে পণ্যের গুনগতমান এবং গরীবদের প্রধান সমস্যা হচ্ছে ভোগ্যপণ্যের মূল্য নিয়ে। ভোক্তাদের স্বার্থরক্ষার জন্য যদি আইনের বাস্তবায়ন থাকে এবং
ভোক্তারা যদি সচেতন থাকেন তাহলে সকল স্তরের ভোক্তাদের স্বার্থরক্ষার একটি সুযোগ থাকে।
যে কোন মানুষই কোন না কোন পণ্য ক্রয় করে থাকে। সে অর্থে সব মানুষই ভোক্তা। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণে গণমাধ্যমের ভূমিকা


পণ্য কিনে কেউ যাতে প্রতারিত না হয়, সে জন্য বিদ্যমান আইনের বাস্তবায়ন জরুরী।
যে কোনো আইনের যথাযথ প্রয়োগ রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যেমন উদ্যোগ গ্রহন জরুরী তেমনি আইন ও অধিকার
সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য সম্মিলিত সামাজিক উদ্যোগ গ্রহন আরও বেশী জরুরী।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষনে গণমাধ্যমের ভূমিকা প্রশংসনীয়। গণমাধ্যমের অসাধারণ ভূমিকার কারণে
বাংলাদেশের ভোক্তাগন ভেজাল সচেতন হচ্ছেন। দিন দিন আমাদের দেশে খাদ্য ভেজালের প্রবণতা বেড়েই চলছে।
বর্তমানে খাদ্যে ভেজাল এমন পর্যায়ে রয়েছে ভেজালমুক্ত খাবার এবং অন্য কোন পণ্য ভেজালমুক্ত পাওয়াই কঠিন হয়ে পড়েছে। এমতাবস্থায় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণে গণমাধ্যমের ভূমিকা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট থমাস জেপারসন বলেছিলেন যদি আমাকে এই পরিস্থিতিতে ফেলা হয় যে সংবাদপত্র ছাড়া সরকার আর সরকার ছাড়া সংবাদ পত্র এ দুটোর যে কোন একটি বেছে নিতে হবে আমি এক মূহুর্তও দেরী না করে দ্বিতীয়টি বেছে নেব।

দার্শনিক আর্থার শোফেনহাওয়ার বলেছেন সংবাদপত্র হলো সেকেন্ড হ্যান্ড অব ওয়ার্ল্ড হিস্ট্রি অর্থাৎ একটি হাত নিয়ে যেমন একজন মানুষ অসম্পূর্ণ ঠিক তেমনি পৃথিবীর পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচনার জন্য গণমাধ্যমের সাহায্য না নিলে তা হবে অসম্পূর্ণ।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণেও যদি গনমাধ্যম সহযোগিতা না করে তাহলে ভেজাল বিরোধী অভিযান বা সরকারী বেসরকারী উদ্যোগ সত্যিকারের সফলতা পাবে না। গণমাধ্যম হলো জাতির মেরুদন্ড। সাংবাদিকরা হলেন দেশ গড়ার শক্তি।
তারা দেশে ঘটে যাওয়া অন্যায়ের সমালোচনা করেন। চীনের বহু অঞ্চলে এক সময় দুর্ভিক্ষে বহু মানুষ মারা গেছে, স্বাধীন সংবাদপত্র বা গণমাধ্যম না থাকায় সেই মৃত্যুর কথা বাইরের মানুষ জানতে পারেনি। সরকার ব্যবস্থা ও নিতে পারেনি।


বাংলাদেশের গণমাধ্যম এখন অন্য যে কোন সময়ের চেয়ে বিকশিত। বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম
জোরদার হওয়ায় গণমাধ্যমেরও চ্যালেঞ্জ রয়েছে মানুষের অধিকার রক্ষা করা, চেতনার মান উন্নত করা,
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষনে ভূমিকা রাখাও গণমাধ্যমের দায়িত্ব। মানুষের কাছে যখন কোন বিকল্প থাকে না
তখন মানুষ গণমাধ্যমের দ্বারস্থ হয়। গণমাধ্যমই মানুষের আকাংখা পূরণ করতে অগ্রণী ভূমিকা রাখে।
বর্তমান পৃথিবীতে শুধুমাত্র ভোক্তা অধিকার নয় কোনো অধিকারই প্রতিষ্ঠা করা যাবে না যদি গণমাধ্যমের সক্রিয় ভূমিকা না থাকে।
১৯৬২ সালের ১৫ মার্চ মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির উদ্যোগে মার্কিন কংগ্রেসে ক্রেতা ভোক্তাদের চারটি অধিকার আইনী স্বীকৃতি লাভ করে।

ভোক্তাদের চারটি অধিকার আইনী স্বীকৃতি লাভ করে, অধিকার গুলি ছিল নিম্নরূপঃ-

১. নিরাপত্তার অধিকার

২. তথ্য জ্ঞাত হবার অধিকার

৩. ন্যায্যমূল্যে পণ্য বা সেবা পাওয়ার অধিকার

৪. অভিযোগ করা ও প্রতিনিধিত্বের অধিকার।

পরবর্তীতে ভোক্তা আন্দোলন সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়লে জাতিসংঘ এ চারটি অধিকারের সঙ্গে আরও চারটি অধিকার যুক্ত করে। এ অধিকার গুলোই মূলত সারা বিশ্বে ভোক্তা আন্দোলনের ভিত্তি হিসেবে কাজ করছে।

জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত অন্য চারটি অধিকার হচ্ছে-

১. অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থানের মৌলিক চাহিদা পূরনের অধিকার,

২. কোন পণ্য সেবা ব্যবহারে ক্ষতিগ্রস্থ হলে ক্ষতিপুরণ পাবার অধিকার

৩. ক্রেতা ভোক্তা অধিকার সম্পর্কে শিক্ষা লাভের অধিকার

৪. স্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস ও কাজ করার অধিকার

এ অধিকার গুলোর মধ্যে অনেকগুলো অধিকার বাংলাদেশের সংবিধানে মৌলিক অধিকার হিসাবে স্বীকৃত।

ভোক্তা কে ?

নিম্নোক্ত ব্যক্তিগণ ভোক্তাঃ

  • যিনি, পুন: বিক্রয় ও বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য ব্যতীত সম্পূর্ণ মূল্য পরিশোধ করে বা সম্পূর্ণ বাকিতে পণ্য বা সেবা ক্রয় করেন।
  • আংশিক মূল্য পরিশোধ করে বা আংশিক বাকিতে পণ্য অথবা সেবা ক্রয় করেন।
  • কিস্তিতে পণ্য অথবা সেবা ক্রয় করেন।


ভোক্তার দায়িত্বঃ

  1. ভোক্তা তার নিজের দায়িত্ব সম্পর্কে অবগত থাকা।
  2. ভোক্তার অধিকার সংরক্ষনের সুফল সম্পর্কে জানা।
  3. ভোক্তার অধিকার বিরোধী কার্যের কুফল সম্পর্কে জানা।
  4. যাচাই-বাছাই করে সঠিক পণ্য বা সেবা সঠিক মূল্যে কেনা।
  5. ভোক্তার অধিকার বাস্তবায়নে সংগঠিত ও সোচ্চার হওয়া এবং অভিযোগ দায়ের করা।

বিক্রেতা কে?

  • কোন পণ্যের উৎপাদকারী বা প্রস্তুতকারী, সরবরাহকারী, পাইকারী বিক্রেতা, খুচরা বিক্রেতা।
  • ভোক্তা অধিকার বিরোধী কার্য ও অপরাধ কি কি?
  • নির্ধারিত মূল্য অপেক্ষা অধিক মূল্যে কোন পণ্য, ঔষধ বা সেবা বিক্রয় বা বিক্রয়ের প্রস্তাব করা।
  • জেনে শুনে ভেজাল মিশ্রিত পণ্য বা ঔষধ বিক্রয় বা বিক্রয়ের প্রস্তাব করা।
  • স্বাস্থের জন্য ক্ষতিকারক নিষিদ্ধ দ্রব্য কোনো খাদ্য পণ্যের সাথে মিশ্রন ও বিক্রয় করা।
  • মিথ্যা বিজ্ঞাপন দ্বারা ক্রেতা সাধারণকে প্রতারিত করা।
  • প্রতিশ্রত পণ্য বা সেবা যথাযথ ভাবে বিক্রয় বা সরবরাহ না করা।
  • ওজনে কারচুপি করা।
  • বাটখারা বা ওজন পরিমাপক যন্ত্রে কারচুপি করা।
  • পরিমাপে কারচুপি করা।
  • দৈর্ঘ্য পরিমাপক ফিতা বা অন্য কিছুতে কারচুপি করা।
  • কোন নকল পণ্য বা ঔষধ প্রস্তুত বা উৎপাদন করা।
  • মেয়াদ উত্তীর্ণ পণ্য বা ঔষধ বিক্রয় বা বিক্রয়ের প্রস্তাব করা।
  • নিষিদ্ধ ঘোষিত কোন কার্য করা যাতে সেবাগ্রহীতার জীবন বা নিরাপত্তা বিপন্ন হতে পারে।
  • অবৈধ প্রক্রিয়ায় পণ্য উৎপাদন বা প্রক্রিয়াকরণ করা।
  • অবহেলা, দায়িত্বহীনতা দ্বারা সেবা গ্রহীতার অর্থ স্বাস্থ্য বা জীবনহানি ইত্যাদি ঘটানো।
  • কোন পণ্য মোড়কবদ্ধভাবে বিক্রয় করার এবং মোড়কের গায়ে পণ্যের উৎপাদনের তারিখ সর্বোচ্চ খুচরা বিক্রয়মূল্য, মেয়াদ উত্তীর্ণের তারিখ ইত্যাদি লিপিবদ্ধ করার বাধ্যবাধকতা লঙ্ঘন করা।
  • আইনানুগ বাধ্যবাধকতা অমান্য করে দোকান বা প্রতিষ্ঠানে সহজ দৃশ্যমান কোন স্থানে পণ্যের মূল্য তালিকা লটকিয়ে প্রদর্শন না করা।

ভোক্তা অধিকার বিরোধী কার্য ও অপরাধ এবং দন্ডঃ

ক. অনধিক ১ বছর কারাদন্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডযোগ্য অপরাধঃ-

  • পণ্যের মোড়ক ব্যবহার না করা বা মোড়কের গায়ে সর্বোচ্চ বিক্রয় মূল্য, মেয়াদ উর্ত্তীণের তারিখ, ইত্যাদি লেখা না থাকা।
  • পণ্য ও সেবার মূল্য তালিকা সংরক্ষন ও লটকায়ে প্রদর্শণ না করা।
  • নির্ধারিত মূল্যের অধিক মূল্যে কোন পণ্য, ঔষধ বা সেবা বিক্রয় বা বিক্রয়ের প্রস্তাব করা।
  • প্রতিশ্রত পণ্য বা সেবা যথাযথভাবে বিক্রয় বা সরবরাহ না করা।
  • ওজনে, বাটখারা বা ওজন পরিমাপক যন্ত্রে কারচুপি করা।
  • পরিমাপে, দৈর্ঘ্যে পরিমাপকে কারচুপি করা এবং মেয়াদ উত্তীর্ণ পণ্য বা ঔষধ বিক্রয় বা বিক্রয়ের প্রস্তাব করা।

খ.অনধিক ১ বছর কারাদন্ড বা অনধিক ২ লক্ষ টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডযোগ্য অপরাধঃ- মিথ্যা বিজ্ঞাপন দ্বারা ক্রেতা সাধারণকে প্রতারিত করা।

গ. অনধিক ২ বছর কারাদন্ড বা অনধিক ১ লক্ষ টাকা অর্থদন্ড বা উভয় দন্ডযোগ্য অপরাধঃ- অবৈধ প্রক্রিয়ার পণ্য উৎপাদন বা প্রক্রিয়া করণ করা।

ঘ. অনধিক ৩ বছর করাদন্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থ দন্ড বা উভয় দন্ডযোগ্য অপরাধঃ- ভোক্তা কর্তৃক মিথ্যা বা হয়রানীমূলক মামলা দায়ের করা।

ঙ. অনধিক ৩ বছর কারদন্ড বা অনধিক ২ লক্ষ টাকা অর্থ দন্ড বা উভয় দন্ডযোগ্য অপরাধঃ-

  • জেনে শুনে ভেজাল মিশ্রিত পণ্য বিক্রয় বা বিক্রয়ের প্রস্তাব করা।
  • খাদ্য পণ্যে ক্ষতিকর নিষিদ্ধ দ্রব্য মিশ্রন বা বিক্রয় করা।
  • পণ্যের নকল প্রস্তুত বা উৎপাদন করা।
  • সেবা গ্রহীতার জীবন বা নিরাপত্তা বিপন্নকারী কার্য করা।
  • অবহেলা, দায়িত্বহীনতা দ্বারা সেবাগ্রহীতার অর্থ, স্বাস্থ্য বা জীবনহানি ইত্যাদি ঘটানো।

পরিশেষে বলা যায় বাংলাদেশের গণমাধ্যম যথার্থ অর্থেই সর্বস্তরের সচেতন ক্রেতা ভোক্তাদের নির্ভরযোগ্য আশ্রয় কেন্দ্র।
ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে গত দেড়শ বছরে বাঙালীর যা অর্জন তার বেশীর ভাগই সংবাদপত্রের অবদান।
মানুষের অধিকার রক্ষায় গণমাধ্যমের ভূমিকাই প্রধান। সীমান্ত রক্ষীরাই শুধু নয়, গণমাধ্যমও আজ জাতির অতন্দ্র প্রহরী।
যখন অন্যায়কারীকে আইনের আওতায় আনা সম্ভব হয় না তখনও গণমাধ্যমই জনগণের একমাত্র ভরসা।
বাংলাদেশ মানবসম্পদ সূচকে ভারত ও পাকিস্তান থেকে এগিয়ে রয়েছে। বিশ্বব্যাংকের করা নতুন এক সূচক অনুযায়ী
দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে শ্রীলংকা ও নেপাল ছাড়া সবার চেয়ে ভালো অবস্থানে বাংলাদেশ।
বিশ্বব্যাংকের ১৫৭টি সদস্য রাষ্ট্রের ওপর জরিপ করে এই তালিকাটি করা হয়েছে।
এতে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও বেঁচে থাকার অনুষঙ্গগুলো বিবেচনা করা হয়েছে।
বাংলাদেশের এই এগিয়ে যাওয়ার ধারাকে বেগবান করতে হলে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষনে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ আয়োজন বাড়াতে হবে। আর সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগের বাস্তবায়নের জন্য গণমাধ্যমের কার্যকর ভূমিকার কোন বিকল্প নেই।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণে গণমাধ্যমের ভূমিকা


লেখক:-
ড. মোহাম্মদ আবু তাহের,
ব্যাংকার, গবেষক ও কলামিস্ট এবং সভাপতি, ক্যাব মৌলভীবাজার।