গণপরিবহনে উপেক্ষিত যাত্রী অধিকার

।।এস এম নাজের হোসাইন।।

সাম্প্রতিক সময়ের বহুল আলোচিত নিরাপদ সড়কের দাবিতে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের জোরালো দাবির মুখে বিদ্যমান সড়ক পরিবহন আইন সংস্কার করে নতুন আইন প্রস্তাব করেছে মন্ত্রিসভা। সরকার শিক্ষার্থীদের দাবির প্রতি সম্মান রেখে দ্রুত আইনটি হালনাগাদ করার উদ্যোগ নেন। সাধারণ শিক্ষার্থীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে আইন সংস্কারে সরকারের দ্রুত পদক্ষেপকে সাধুবাদ এবং কিছু কিছু নতুন সংযোজন অবশ্যই প্রশংসনীয়। কিন্তু নিরাপদ সড়কের দাবির বিপরীতে দাঁড়িয়ে আছে সড়ক নিরাপত্তা ও যাত্রী অধিকারের মূল বিষয়গুলো। বিশেষ করে আইন প্রয়োগে সংশ্লিøষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতার অভাব, সদিচ্ছা, আন্তরিকতা, রাজনৈতিক ও এ খাতে জড়িতদের অবৈধ প্রভাব বিস্তার এবং নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের লোকজনের দায়িত্ব এড়ানোর চেষ্টা এবং বৃহৎ জনগোষ্ঠীর স্বার্থকে গৌণ করে ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির মতো দুরারোগ্য ব্যাধি দূর করা না গেলে যত কঠিন আইন প্রণয়ন করা হোক না কেন, সাধারণ জনগণ কাক্সিক্ষত সুফল পাবে না। এ ছাড়া গণপরিবহন সেক্টরের সঙ্গে জড়িত সবপক্ষের সম-অংশগ্রহণ নিশ্চিত না হলে আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষ আগেকার মতো অক্ষম ও অসহায় হয়ে পড়বে, নৈরাজ্য বন্ধ করা কঠিন হবে।

দেশে আইনের তেমন অভাব নেই। কিন্তু আইন প্রয়োগে সীমাহীন দুর্বলতার কারণে জনগণ এসব আইন থেকে সুফল পায় না। আইনগুলো অনেকটাই ‘কাজীর গরু খাতায় আছে, গোয়ালে নাই’ সে রকম। কারণ দেশে বাড়ি নিয়ন্ত্রণ আইন ২০০০ আছে, কিন্তু আইন বাস্তবায়নে কোনো কর্তৃপক্ষ আজ পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয় নেই। যার কারণে বাড়িভাড়া খাতে চলছে চরম নৈরাজ্য। এর আগে সড়ক পরিবহন আইন বিদ্যমান থাকলেও ট্রাফিক বা বিআরটিএ আইন প্রয়োগে তৎপর ছিল না। এটা অনেকটা ধূমপানবিরোধী আইনের মতো। যারা আইন প্রয়োগ করবেন, তারা যত্রতত্র ধূমপানে লিপ্ত। সড়ক পরিবহন আইন থাকলেও শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে দেখা গেছে অধিকাংশ সরকারি যানবাহনের ফিটনেস নেই। চালকদের লাইসেন্স নেই অথবা হালনাগাদ নেই। ট্রাফিক আইন মানে না, সরকারের মন্ত্রী থেকে শুরু করে ক্ষমতাধর লোকজন। ট্রাফিক বিভাগ যানবাহনে শৃঙ্খলা আনায়নে তৎপর হলেও বিআরটিএ নামক প্রতিষ্ঠানের কোনো অস্তিত্ব সড়কে পাওয়া দুষ্কর। যার ফলে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন অনেকটাই সড়ক পরিবহনে শৃঙ্খলা ও মৃত্যুর মিছিল থামানোর অভ্যুত্থানে পরিণত হয়েছিল।

আইন প্রয়োগে বিআরটিএর সক্ষমতা বাড়ানো বিশেষ করে ৩৬ লাখ মোটরযানের পর্যাপ্ত পরিদর্শকের ব্যবস্থা করা, বিশেষ করে প্রতি হাজারে একজন পরিদর্শকের ব্যবস্থা করা হলে ট্রাফিক পুলিশের ওপর নির্ভরশীলতা কমবে। প্রস্তাবিত আইনে একটি যুগান্তকারী সংযোজন হলো দুর্ঘটনায় ক্ষতগ্রস্ত হলে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্য ট্রাস্ট গঠন। এ দুর্ঘটনায় ক্ষতিপূরণ দিতে তহবিল গঠন ও ট্রাস্ট গঠনের উদ্যোগ সময় উপযোগী ও প্রশংসনীয় হলেও ট্রাস্টি বোর্ড গঠনে সরকারের কর্মকর্তা ও পরিবহন খাতে জড়িত মালিক-শ্রমিকদের দিয়ে গঠন করা হলে এটা আবারও পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে যাবে। এ ছাড়া সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাসে সড়ককে অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা, গাড়িগুলোর ফিটনেস নিশ্চিত করা, পরিবহন শ্রমিকদের নির্দিষ্ট শ্রমঘণ্টার পরিবর্তে মালিকদের চাপিয়ে দেওয়া বেশি কাজ করিয়ে নেওয়ার প্রবণতা কঠোর হস্তে দমন, বিদ্যমান আইনে সপ্তাহে অনধিক ৪৮ ঘণ্টা কাজ করানোর বিধান কঠোরভাবে অনুসরণ, পরিবহন শ্রমিকদের কর্মপরিবেশ উন্নয়ন বিষয়ে আরো মনোযোগী হওয়া দরকার।

ক্যাবসহ নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনরত অন্যান্য নাগরিক সংগঠনগুলো দীর্ঘদিন ধরেই ঢাকাসহ সারা দেশের প্রতিটি জেলা ও মহানগরে যান চলাচলের অনুমোদনকারী আঞ্চলিক পরিবহন কমিটিতে (আরটিসি) ভোক্তাদের প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত করার দাবি করে আসছিল। বিদ্যমান মোটরযান আইন, ১৯৮৩ অনুযায়ী কমিটিতে মালিক ও শ্রমিক ইউনিয়নের একজন করে প্রতিনিধি থাকার কথা থাকলেও সব স্থানেই তিন-চারজন করে মালিক-শ্রমিক প্রতিনিধি আছেন। প্রস্তাবিত সড়ক পরিবহন আইনে এ কমিটিতে মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের ন্যূনতম একজন করে প্রতিনিধি রাখার প্রস্তাব করা হলেও সেখানে ভোক্তাদের (যাত্রী) কোনো প্রতিনিধি রাখা হয়নি। যার কারণে প্রস্তাবিত আইনে ভোক্তা স্বার্থ সংরক্ষিত হয়নি।

প্রস্তাবিত আইনের সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সর্বোচ্চ সাজা পাঁচ বছরের কারাদ- ও অর্থদ- বা উভয় দ- এবং সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে গণপরিবহন খাতে জড়িত নাগরিক সমাজের দীর্ঘদিনের জনদাবি ছিল সর্বোচ্চ সাজা ১০ বা তারও বেশি করা। এমনকি উচ্চ আদালতের নির্দেশনা ছিল সাত বছর করার। খসড়া আইনে সর্বোচ্চ সাজা পাঁচ বছরের কারাদ- করায় যাত্রীদের স্বার্থ রক্ষা হয়নি, বরং বাসমালিক ও শ্রমিকদের স্বার্থই প্রাধান্য পেয়েছে। এ ছাড়া সড়ক দুর্ঘটনা মৃত্যু হলে প্রতিবেশী ও উন্নত দেশের আদলে ১০ থেকে ১৪ বছরের কারাদ-ের বিধান চালু করা দরকার। তদন্তে কারো নিহত হওয়ার ঘটনা উদ্দেশ্যমূলক হত্যা বলে প্রমাণিত হলে সে ক্ষেত্রে ফৌজদারি আইনে মৃত্যুদ-ের বিধান প্রয়োগ হবে। বস্তুত এটিও নির্ভর করবে পুলিশের তদন্তের ওপর। কিন্তু আমাদের দেশে পুলিশি তদন্তের নিরপেক্ষতা ও সত্যতা যাচাই অধিকাংশ সময়ই প্রশ্ন সাপেক্ষে হয়। সে কারণে স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু তদন্ত এবং এর প্রতিবেদন ও চার্জশিট দাখিল হলেই অপরাধীর উপযুক্ত সাজা হতে পারে। প্রস্তাবিত আইনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, এতে দুর্ঘটনায় কেবল চালকের সাজার কথা বলা হয়েছে। এটা ঠিক, আমাদের দেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রে চালকের অদক্ষতা, বেপরোয়া গাড়ি চালনা, যাত্রীর ওঠানামা ও ওভারটেকের মাধ্যমে অসুস্থ প্রতিযোগিতা ইত্যাদির কারণেই দুর্ঘটনা ঘটে বেশি। তবে দুর্ঘটনার জন্য চালক ছাড়াও ফিটনেসবিহীন গাড়ি, ত্রুটিপূর্ণ সড়ক ব্যবস্থাপনা বা অন্য কোনো অবকাঠামো, এমনকি দুর্ঘটনাকবলিত ব্যক্তিও দায়ী হতে পারেন। এসব ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের সাজার বিষয়টি জড়িত থাকার কথা। কিন্তু খসড়া আইনে তা নেই।

গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার বিষয়টি বর্তমান সময়ে সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। কিন্তু বাস চলাচলের অনুমোদন প্রক্রিয়ার সংস্কারের দাবি এই আইনে উপেক্ষিত। ঢাকার গণপরিবহনের বিশৃঙ্খলার জন্ম এর অনুমোদন প্রক্রিয়া দায়ী। সব বাস-মিনিবাস অল্প কিছু কোম্পানির অধীনে নিয়ে আসা এবং তা কেন্দ্রীয়ভাবে পরিচালনা করার জন্য ‘রুট ফ্রান্সাইজ’ পদ্ধতি দাবি দীর্ঘদিনের। ঢাকার গণপরিবহনের জন্য সরকারের করা ২০ বছরের কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা (এসটিপি) এবং জাপানি সংস্থা জাইকার সমীক্ষাতেও গণপরিবহনে শৃঙ্খলার জন্য এ ব্যবস্থা চালুর সুপারিশ করা হয়েছিল। মালিক-শ্রমিকদের ইচ্ছা অনুযায়ী অপেশাদার ও অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পরিবহনের অনুমোদন দেওয়ার কারণে গণপরিবহনে অসুস্থ প্রতিযোগিতার কারণে নৈরাজ্য, চাঁদাবাজিকে চরমভাবে উৎসাহিত করছে।

প্রস্তাবিত আইনে সরকারি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে গণপরিবহনের জন্য ভাড়ার হার ও সর্বনিম্ন ভাড়া নির্ধারণ ও পুনর্নির্ধারণের কথা বলা হয়েছে। আর শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বিলাসবহুল ও বিশেষ সুবিধার গণপরিবহনের ভাড়া নির্ধারণের ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য হবে না। কিন্তু এ বিশেষ ব্যবস্থার কথা বলে ঢাকায় ‘সিটিং সার্ভিস’, গেটলকের মতো বিশেষ ব্যবস্থায় চলা বাসগুলোয় উঠলেই সর্বনিম্ন ১০-২০ টাকা পর্যন্ত আদায় করা হচ্ছে। অথচ সরকার ঢাকায় মিনিবাসের ন্যূনতম ভাড়া ৫ টাকা এবং বড় বাসের জন্য ৭ টাকা নির্ধারণ করে দিলেও পরিবহন মালিকরা তা কোনোভাবেই মানছেন না। অন্যদিকে দূরপাল্লার পথে প্রচুর শীতাতপনিয়ন্ত্রিত (এসি) বাস, ঢাকায়ও বেশ কিছু কোম্পানি এসিবাস চললেও তারাও নিজেদের ইচ্ছামতো ভাড়া ঠিক করছে। এ ছাড়া বিআরটিএ ৩১ আসনের মিনিবাস ও ৫২ আসনের বড় বাসের ভাড়া নির্ধারণ করে দেয়। কিন্তু এখন ঢাকায় ৩১-৪০ আসনের বাস চলছে। দূরপাল্লার পথে ২৬, ৪০ ও ৫২ আসনের বাস চলাচল করে, যা মালিকরা নিজেদের মতো করে ভাড়া নির্ধারণ করছেন। অন্যদিকে বাসের ভাড়া নির্ধারণে বিআরটিএর ব্যয় বিশ্লেষণ কমিটি আছে, যেখানে সরকারি কর্মকর্তার বাইরে বেশির ভাগই মালিক-শ্রমিক প্রতিনিধি। কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) একজন প্রতিনিধি থাকলেও মালিক-শ্রমিকরাই সেখানে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। প্রস্তাবিত আইনেও সে বিষয়ে পরিষ্কার না থাকায় পুরনো ব্যবস্থা বহাল থাকার সম্ভাবনা প্রচুর। এ ছাড়া সড়ক নিরাপত্তা উপদেষ্টা পরিষদে মালিক-শ্রমিক প্রতিনিধি ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের রাখার কথা বলা হলেও যাত্রীদের প্রতিনিধিত্ব সম্পর্কে পরিষ্কার বক্তব্য না থাকলে সেখানে ভোক্তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে না। ফলে সড়ক নিরাপত্তার বিষয়গুলো বরাবরের মতো উপেক্ষিত থেকেই গেল।

তাই আইনপ্রণয়নের পাশাপাশি আইন বাস্তবায়নে সরকারি দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধি, গণপরিবহন সেক্টরে জড়িত মালিক-শ্রমিক ও যাত্রীদের (ভোক্তা) নীতিনির্ধারণীতে সম-অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, সরকারি রেগুলেটরি প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্তৃপক্ষকে নাগরিক পরিবীক্ষণের আওতায় আনা, জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা, প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকান্ডে জন-অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা জরুরি। তাহলেই গণপরিবহনে সুশাসন আসবে, থামবে সড়কে মৃত্যুর মিছিল।

লেখক : সহসভাপতি, কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)

যোগাযোগ : [email protected]