প্রত্যাহার হচ্ছে না ট্রেজারি বন্ডের উৎসে কর

সরকারি সিকিউরিটিজের (ট্রেজারি বিল বা ট্রেজারি বন্ড) সুদ আয়ের ওপর উৎসে কর কর্তন শেষ পর্যন্ত প্রত্যাহার হচ্ছে না। রাজস্ব আদায় বিবেচনায় নিয়ে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে— সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।

যদিও বন্ড মার্কেট উন্নয়নে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রস্তাবনা ছিল, বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ বৃদ্ধিতে সুদ আয়ের ওপর উৎসে কর না কাটা। তাদের যুক্তি, সরকার বন্ড থেকে প্রয়োজনীয় ব্যয় মেটানোর অর্থ না পেলে ব্যাংক থেকে বেশি ঋণ গ্রহণ করবে। এতে ব্যাংক খাতে সরকারের ঋণ নির্ভরশীলতা পুনরায় বৃদ্ধি পেতে পারে। আর ব্যাংক থেকে বেশি ঋণ নিলে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বেসরকারি ঋণের ওপর।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রস্তাবনা ছিল, বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ বৃদ্ধিতে সুদ আয়ের ওপর উৎসে কর না কাটা। তাদের যুক্তি, সরকার বন্ড থেকে প্রয়োজনীয় ব্যয় মেটানোর অর্থ না পেলে ব্যাংক থেকে বেশি ঋণ গ্রহণ করবে। এতে ব্যাংক খাতে সরকারের ঋণ নির্ভরশীলতা পুনরায় বৃদ্ধি পেতে পারে
রাজস্ব আহরণের স্বার্থে বাংলাদেশ ব্যাংকের এমন যুক্তিতে অর্থ মন্ত্রণালয় শেষ পর্যন্ত একমত হতে পারেনি। তাই মন্ত্রণালয়ের ক্যাশ বন্ড ডেট ম্যানেজমেন্ট কমিটির ৪৮তম সভা থেকে উৎসে কর প্রত্যাহারের প্রস্তাব নাকচ করে দেওয়া হয়।

সেপ্টেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে অনুষ্ঠিত সভায় এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। সভায় উপস্থিত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বিষয়টি নিশ্চিত করেন।

সভায় সিদ্ধান্ত হয়, সরকারি সিকিউরিটিজের বিপরীতে অর্জিত সুদ বা ডিস্কাউন্ট আয়ের ওপর প্রযোজ্য ৫ শতাংশ উৎসে কর কর্তন বহাল থাকবে। তবে এ কর কর্তনের বিষয়ে কোনো জটিলতা থাকলে তা দূর করতে হবে।

উৎসে করের বিষয়টি সেকেন্ডারি মার্কেটে বন্ডের মূল্যের ওপর প্রতিফলিত হবে। তাই এ বিষয়ে কোনো জটিলতার সুযোগ নেই

ওই সভার সভাপতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব আব্দুর রউফ তালুকদার এ বিষয়ে বলেন, উৎসে করের বিষয়টি সেকেন্ডারি মার্কেটে বন্ডের মূল্যের ওপর প্রতিফলিত হবে। তাই এ বিষয়ে কোনো জটিলতার সুযোগ নেই।

তিনি আরও বলেন, সরকারি সিকিউরিটিজের বিপরীতে অর্জিত সুদ বা ডিস্কাউন্ট আয়ের ওপর প্রযোজ্য ৫ শতাংশ উৎসে কর কর্তন বহাল থাকবে। তবে এ কর কর্তনের বিষয়ে কোনো জটিলতা থাকলে এনবিআর সদস্য (করনীতি) ও বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেট ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্টকে তা দূর করতে হবে।

এ বিষয়ে এনবিআর সদস্য (করনীতি) মো. আলমগীর হোসেন বলেন, এনবিআর সভার সিদ্ধান্ত অনুসরণ করবে। এর মাধ্যমে কর সংক্রান্ত জটিলতা দূর হবে।

সভার আলোচনার সূত্রে আরও জানা যায়, সরকারি সিকিউরিটিজের বিপরীতে অর্জিত সুদ ও ডিস্কাউন্ট আয়ের ওপর আরোপিত ৫ শতাংশ উৎসে কর বিষয়ক একটি সভা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে গত ২৩ জুন অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেট ম্যানেজমেন্ট বিভাগের প্রতিনিধিগণ অংশগ্রহণ করেন এবং উৎসে কর প্রত্যাহারের বিষয়ে যুক্তি তুলে ধরেন।

এ বিষয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে জানানো হয়, বন্ড বা বিলের ডিসকাউন্ট বা লাভ পরিশোধকালে ডিসকাউন্ট বা লাভের ওপর মাত্র ৫ শতাংশ হারে উৎসে কর কর্তনের বিধান প্রত্যাহার হলে পরবর্তীতে কর আদায়ে জটিলতা তৈরি হবে। সরকার বড় অঙ্কের রাজস্ব হারাবে। তাই এ বিধান পরিবর্তনের কোনো সুযোগ নেই।

এনবিআরের যুক্তি ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানিয়েছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। তিনি বলেন, সরকারি বন্ডের সুদের ওপর ৫ শতাংশ কর খুব বেশি নয়। এতে বন্ড মার্কেটে তেমন প্রভাব পড়ার কথা নয়। তাছাড়া সরকারকে রাজস্ব আহরণের কথা ভাবতে হবে। আমি মনে করি সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সরকারি বন্ডের সুদের ওপর ৫ শতাংশ কর খুব বেশি নয়। এতে বন্ড মার্কেটে তেমন প্রভাব পড়ার কথা নয়। তাছাড়া সরকারকে রাজস্ব আহরণের কথা ভাবতে হবে। আমি মনে করি সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

উৎসে কর কর্তনের বিষয়ে গত সেপ্টেম্বর মাসে অর্থ মন্ত্রণালয়কে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে প্রথম দফায় চিঠি দেওয়া হয়। সেখানে উল্লেখ করা হয়, উৎসে কর কর্তন দেশের বন্ড মার্কেটের উন্নয়নে বড় অন্তরায়। সরকারি বন্ডের সুদের ওপর উৎসে কর আরোপের কারণে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বেসরকারি বিনিয়োগে। পাশাপাশি ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে সরকারের ব্যাংক-নির্ভরতা বেড়ে যাচ্ছে। সার্বিকভাবে সরকারের ব্যয়ও বাড়বে।

এছাড়া অনেক বিনিয়োগকারী বন্ড কিনতে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন— এমন আশঙ্কার কথা তুলে ধরা হয় চিঠিতে। সেখানে সরকারি সিকিউরিটিজে (বন্ড) সুদ আয়ের ওপর উৎসে কর কর্তন প্রত্যাহারের অনুরোধ জানানো হয়। গত ১৩ সেপ্টেম্বর কেন্দ্রীয় ব্যাংক একই বিষয়ে অনুরোধ জানিয়ে দ্বিতীয় দফা চিঠি দেয়।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চিঠিতে আরও উল্লেখ করা হয়, বন্ড সুদ আয়ের ওপর উৎসে কর কাটার কারণে এ খাতে ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগে আগ্রহ কমে যেতে পারে। এতে বন্ড মার্কেটের উন্নয়ন চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হবে। এমন পরিস্থিতিতে আরও কয়েকটি আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে বন্ড কেনায় বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ কমে গেলে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ওপর। কারণ, সরকার বন্ড খাত থেকে প্রয়োজনীয় ব্যয় মেটানোর অর্থ না পেলে তখন ব্যাংক থেকে বেশি পরিমাণে ঋণ গ্রহণ করবে। এতে ব্যাংক খাতে সরকারের ঋণ নির্ভরশীলতা পুনরায় বৃদ্ধি পেতে পারে। আর ব্যাংক থেকে বেশি ঋণ নিলে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বেসরকারি ঋণের ওপর। তখন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে বেসরকারি খাতে ঋণ দেওয়ার ফান্ডও কমে যাবে। বেসরকারি খাতে পর্যাপ্ত ঋণ না গেলে বিনিয়োগও কমে যাবে। বিনিয়োগ কমে গেলে সরকারি বন্ডের চাহিদা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেতে পারে। আর বন্ডের চাহিদা কমে গেলে সরকারের কাছে ব্যাংক ঋণের চাহিদা বাড়বে। এতে ঋণের সুদের হারও উল্লেখযোগ্য হারে বাড়তে পারে। ফলে সরকারের কস্ট অব ফান্ড ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাবে।

উৎসে কর কর্তন দেশের বন্ড মার্কেটের উন্নয়নে বড় অন্তরায়। সরকারি বন্ডের সুদের ওপর উৎসে কর আরোপের কারণে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বেসরকারি বিনিয়োগে। পাশাপাশি ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে সরকারের ব্যাংক-নির্ভরতা বেড়ে যাচ্ছে। সার্বিকভাবে সরকারের ব্যয়ও বাড়বে— বাংলাদেশ ব্যাংক
প্রসঙ্গত, ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত অর্থ আইন- ২০২০ এর আওতায় সরকারি বন্ড থেকে যে আয় হবে তার ওপর ৫ শতাংশ উৎসে কর আরোপের প্রস্তাব করা হয়। এরপর থেকে তা চলমান রয়েছে।

সরকারি সিকিউরিটিজ (বন্ড) কী

সরকার যে বন্ড বাজারে ছাড়ে তাকে ট্রেজারি বন্ড বা সরকারি সিকিউরিটিজ বলে। বন্ডের ক্রেতা হচ্ছেন ঋণদাতা। আর বন্ড ইস্যুকারী ঋণগ্রহীতা। শেয়ারের মতো বন্ডেরও প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি মার্কেট আছে। বন্ড ইস্যু করে সরকার ঋণ নেয়।

কারা বন্ড ক্রয় করেন

একসময় শুধু ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান সরকারি বন্ড ক্রয় করত। এজন্য ব্যাংক ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে বেসরকারি খাতের চেয়ে অগ্রাধিকার দেওয়া হতো সরকারকে। এটি বিবেচনায় নিয়ে বন্ডের বাজার সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেয় অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংক। পরবর্তী সময়ে বিমা প্রতিষ্ঠান, মিউচ্যুয়াল ফান্ড, নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান, করপোরেট প্রতিষ্ঠান, পেনশন তহবিলসহ নানা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে বন্ড কেনার জন্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এছাড়া অনিবাসী বা বিদেশি ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান শুধু ট্রেজারি বন্ড কিনতে পারেন।

বন্ড ক্রয়ে সুবিধা

ট্রেজারি বন্ড দীর্ঘমেয়াদি। বর্তমানে ২, ৫, ১০, ১৫ ও ২০ বছর মেয়াদি ট্রেজারি বন্ড বাজারে প্রচলিত আছে। এ বন্ডে এক লাখ টাকা বা এক লাখ টাকার গুণিতক যে কোনো অঙ্ক মূল্যের সমপরিমাণ সরকারি ট্রেজারি বন্ড কেনা যায়। ট্রেজারি বন্ডের সুদের হার বা ‘কুপন রেট’ বাংলাদেশ ব্যাংকে অনুষ্ঠিত নিলামে ইলেকট্রনিক বিডিং সিস্টেমের মাধ্যমে নির্ধারিত হয়। ট্রেজারি বন্ডের সুদ প্রতি ছয় মাস অন্তর পরিশোধ করা হয়।

ছয় বছর আগে ২০ বছর মেয়াদি ট্রেজারি বন্ডের সুদের হার ছিল ১৫ দশমিক ৫০ শতাংশ। এখন যা ৯ শতাংশ। বিভিন্ন প্রকল্প, বিশেষ করে বৃহৎ অবকাঠামোর প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য সরকারের দীর্ঘমেয়াদি ফান্ডের দরকার হয়।

ট্রেজারি বিল স্বল্পমেয়াদি হয়। মেয়াদ এক বছরের কম। বর্তমানে ১৪, ৯১, ১৮২ ও ৩৬৪ দিন মেয়াদি ট্রেজারি বিল বাজারে চালু আছে।

এনবিআর সূত্রে জানা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরে আয়কর খাত থেকে মোট সংগ্রহ হয় ৮৫ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ৫১ হাজার কোটি টাকা আসে উৎসে কর থেকে।