দেশের মুদ্রার বাজারে তারল্য সংকট

ভোক্তাকন্ঠ ডেস্কঃ ব্যাংকগুলোতে হঠাৎ নগদ অর্থের চাহিদা বেড়েছে। তারল্য সংকটের কারণে আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে স্বল্প সময়ের জন্য ধার করা অর্থের সুদের হার বা কল-মানি রেট বাড়ছে।

বুধবার (১৭ নভেম্বর) বেশির ভাগ ব্যাংকের কল-মানি রেট ছিল সাড়ে ৪ শতাংশ। খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বেসরকারি ব্যাংকগুলো ঋণে ৯ শতাংশ সুদহার বাস্তবায়নের জন্য আমানতের সুদহার কমিয়ে দিয়েছিল। তাই অনেক আমানতকারী কম সুদে নিরুৎসাহিত হয়ে টাকা উঠিয়ে নিয়েছেন। এরই প্রভাব পড়েছে বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে। তাই তারা এখন সরকারি ব্যাংকগুলোর কাছে কল-মানির মাধ্যমে টাকা ধার করছে।

অন্যদিকে, বাজারে মার্কিন ডলারের সরবরাহ বাড়াতে ডলার বিক্রি করে টাকা তুলে নিচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর প্রভাবে তারল্যের সংকট তৈরি হয়েছে মানি মার্কেটে (মুদ্রাবাজার)।

এ বিষয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোহাম্মদ শামস-উল ইসলাম বলেন, ‘কল-মানি রেট নির্ভর করে মানি মার্কেটের সাপ্লাই অ্যান্ড ডিমান্ডের ওপর। যখন ডিমান্ড বেড়ে যায় তখন রেটও বেশি থাকে। এখন বেশির ভাগ ব্যাংকের নগদ অর্থের চাহিদা বেড়েছে তাই রেটও একটু হাই।’

হঠাৎ চাহিদা বাড়ার কারণ কী- জানতে চাইলে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটির এ প্রধান নির্বাহী বলেন, ‘আমাদের অনেক ব্যাংক করোনার সময় উচ্চ মুনাফার জন্য আমানতের সুদহার কমিয়ে দিয়েছিল। ব্যাংকাররা মনে করেছেন আমানতকারীদের বেশি সুদ না দিয়ে যখন প্রয়োজন পড়বে তখন কল-মানি থেকে টাকা নেব। সুদহার কমে যাওয়ায় গ্রাহক ব্যাংক থেকে অর্থ নিয়ে অন্য কোথাও বিনিয়োগ করেছে অথবা যে জায়গায় বেশি লাভ পেয়েছেন ওখানেই টাকা রেখেছেন। এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ায় ব্যাংকগুলোর বাড়তি অর্থের প্রয়োজন হচ্ছে। নগদ টাকার টানও পড়েছে।’

তিনি বলেন, ‘ব্যাংকের অর্থ সরবরাহ ঠিক রাখা মূলত ট্রেজারি ম্যানেজমেন্টের কাজ। যারা সামরিক লাভকে বড় করে দেখে তাদেরই এমন দুর্দশা হয়। আর যারা ভবিষ্যৎ দূরদর্শিতা নিয়ে চিন্তা করে পদক্ষেপ নেন তাদের এ ধরনের সমস্যা হয় না। তবে যাই হোক এ সংকট সাময়িক, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।’

বাংলাদেশ ব্যাংকের ওয়েবসাইটে দেওয়া সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, আন্তঃব্যাংক লেনদেনে মঙ্গলবার কল-মানিতে গড়ে ৪ দশমিক ২৫ শতাংশ সুদে মোট ছয় হাজার ৮৫০ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছিল। এর আগের দিন সোমবার কল-মানি রেট ছিল ৩ দশমিক ১৪ শতাংশ। ওই দিন লেনদেন হয় আট হাজার ৩৭৮ কোটি টাকা। রোববার গড়ে ২ দশমিক ৯৩ শতাংশ সুদে লেনদেন হয় আট হাজার ৫৪৪ কোটি টাকা। গত সপ্তাহের শুরুতে অর্থাৎ ৮ নভেম্বর কল-মানি রেট ছিল ২ দশমিক ৩২ শতাংশ।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৮ সালের এপ্রিল পর্যন্ত কল-মানিতে গড় সুদহার সাড়ে ৪ শতাংশে উঠলেও পরবর্তীতে সুদহার সর্বনিম্ন অবস্থানে নেমে আসে। ওই বছর আগস্টে কল-মানি মার্কেটের সুদহার সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ হলেও সর্বনিম্ন সুদহার শূন্য দশমিক ১০ শতাংশে নেমে আসে। ২০০৯ সালের অক্টোবরে গড়ে ২ দশমিক ৮ শতাংশ সুদে লেনদেন হয় কল-মানি মার্কেটে। ওই বছর জুলাই মাসে সর্বনিম্ন শূন্য দশমিক ৭৫ শতাংশে তা নেমে যায়। এরপর ২০২০ সালের বেশির ভাগ সময় কল-মানির রেট ২ শতাংশের নিচেই ছিল।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশের ব্যাংক খাতে চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত উদ্বৃত্ত বা অতিরিক্ত তারল্যের পরিমাণ ছিল দুই লাখ ১৯ হাজার ৬৮২ কোটি টাকা। গত জুনে অতিরিক্ত এ তারল্যের পরিমাণ দুই লাখ ৩২ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত ওঠে। রেকর্ড পরিমাণ অতিরিক্ত তারল্যের মধ্যে ৯৮ হাজার ৮১৬ কোটি টাকা আছে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রধান চার ব্যাংক সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকের কাছে। বর্তমানে কল-মানি বাজারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে এ ব্যাংকগুলো নেতৃত্বের আসনে রয়েছে। এর মধ্যে অগ্রণী ব্যাংক একাই সাড়ে ৪ শতাংশ সুদে বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে চার হাজার কোটি টাকার বেশি কল-মানি, রেপো ও শর্ট নোটিশ ডিপোজিট হিসেবে ধার দিয়েছে।

ব্যাংক-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, করোনা পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ায় দেশে আমদানির চাপ বেড়েছে। গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিন মাসে আমদানি বেড়েছে ৪৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ। এর দায় পরিশোধে বাড়তি ডলার লাগছে। ফলে ডলারের দামও বাড়ছে। দেশের ব্যাংকগুলোতে এখন নগদ মার্কিন ডলারের মূল্য ৮৯ টাকায় উঠেছে। আমদানিপর্যায়ের ডলারের দর উঠেছে ৮৫ টাকা ৮০ পয়সায়। এমন পরিস্থিতিতে বৈদেশিক মুদ্রাবাজার স্থিতিশীল রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক চলতি অর্থবছরে এখন পর্যন্ত ১৬৫ কোটি ডলার বিক্রি করেছে। এর মাধ্যমেও বাজার থেকে প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। মুদ্রাবাজারে চাপ সৃষ্টির পেছনে এটাও অন্যতম কারণ বলছেন ব্যাংকাররা।