সুরক্ষিত হোক ভোক্তা অধিকার ও নিরাপদ খাদ্যঃএস এম নাজের হোসাইন

ঢাকা, ১৫ মার্চ রোববারঃ আজ ১৫ মার্চ বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস ২০২০ বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী উদযাপিত হচ্ছে। গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে ‘ভোক্তাবাদ’ আন্দোলন জোরদার হয়। ১৯৬২ সালের ১৫ মার্চ মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি কর্তৃক মার্কিন কংগ্রেসে ক্রেতা-ভোক্তা আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণার ঐতিহাসিক দিনটির স্মরণে প্রতিবছরের ১৫ মার্চ বিশ্বজুড়ে দিবসটি বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। ক্রেতা-ভোক্তা আন্দোলনে বিশ্বব্যাপী ভোক্তা সংগঠনগুলো নানামুখী কাজ করে যাচ্ছে। বিশ্বে ভোক্তা আন্দোলনের মূল প্রবক্তা মার্কিন সিনেটর ও মাল্টিন্যাশনাল মনিটর পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা রাল্ফ নাদের। ক্রেতা-ভোক্তাদের আন্তর্জাতিক সংগঠন কনজ্যুমারস ইন্টারন্যাশনাল বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ভোক্তা আন্দোলনে নেতৃত্বদান ও এই আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ভোক্তা অধিকার সুরক্ষায় এসব সংগঠন প্রয়োজনীয় কর্মসূচি চালিয়ে আসছে। কিন্তু ক্রেতা-ভোক্তাদের অধিকার কতটুকু সংরক্ষিত হচ্ছে, সেটা আজও এক বড় ধরনের প্রশ্ন। একই সঙ্গে ভোক্তা বা ক্রেতা হিসেবে অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে আমরা কতটুকু সচেতন ও কার্যকর করতে পেরেছি বা করেছি—এ প্রশ্নের উত্তর ইতিবাচক নয়।

সমাজের সর্বস্তরের মানুষ কোনো না কোনোভাবে একজন ভোক্তা। আবার অনেকে বলে থাকে মানুষের জীবন ও জীবিকার সঙ্গে যেসব অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা রাষ্ট্র ও জাতিসংঘ কর্তৃক স্বীকৃত এগুলোই ভোক্তা অধিকারের আওতায়। জাতিসংঘ স্বীকৃত ভোক্তা অধিকারগুলোর মধ্যে অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থানের মৌলিক চাহিদা পূরণের অধিকার, নিরাপদ পণ্য ও সেবা পাওয়ার অধিকার, পণ্যের উপাদান, ব্যবহারবিধি, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ইত্যাদি তথ্য জানার অধিকার, যাচাই-বাছাই করে ন্যায্য মূল্যে সঠিক পণ্য ও সেবা পাওয়ার অধিকার, কোনো পণ্য বা সেবা ব্যবহারে ক্ষতিগ্রস্ত হলে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার অধিকার, অভিযোগ করার ও প্রতিনিধিত্বের অধিকার, ক্রেতা-ভোক্তা হিসেবে অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে শিক্ষা লাভের অধিকার, স্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ ও বসবাস করার অধিকার অন্যতম। তবে অধিকারের পাশাপাশি কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে বলা হলেও এ বিষয়গুলো সম্পর্কে আমাদের অজ্ঞতার বিষয়টিও কম নয়। বিষয়গুলো হলো—পণ্য বা সেবার মান ও গুণাগুণ সম্পর্কে সচেতন ও জিজ্ঞাসু হোন, দরদাম করে সঠিক পণ্যটি বাছাই করুন, আপনার আচরণে অন্য ক্রেতা যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সে ব্যাপারে সচেতন থাকুন, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় সচেতন ও সক্রিয় হোন,  ক্রেতা-ভোক্তা হিসেবে অধিকার সংরক্ষণে সোচ্চার ও সংগঠিত হোন।

বিশ্ব ভোক্তা অধিকার দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য বিষয়টি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। একদিকে ক্রেতা-ভোক্তাদের লাগামহীন ভোগপ্রবণতা যেন পরিবেশের বিপর্যয় না ঘটায়, অন্যদিকে ব্যবসায়ীদের অতিমুনাফা অর্জনের আকাঙ্ক্ষা, আবার আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষের বৈষম্যমূলক আচরণ ধনিক ও ব্যবসায়ী প্রীতি যেন পৃথিবীকে বসবাসের অনুপযোগী করে না তোলে।

বলার অপেক্ষা রাখে না, এখন পুরো জাতি যেন আত্মাহুতি দেওয়ার নেশায় মেতেছে। আমরা প্রায়ই বলে থাকি একজন ব্যবসায়ী দু-চারটি পণ্যের উৎপাদক বা বিক্রেতা হলেও তিনি নিজে অসংখ্য পণ্যের ক্রেতা-ভোক্তা। ফলে এমন প্রবণতায় দিন শেষে আমরা সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। মানহীন, ভেজাল ও কম পুষ্টিমানসম্পন্ন খাবার গ্রহণের ফলে আমাদের শারীরিক ও মানসিক সামর্থ্য দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। অসংখ্য রোগের নিরাপদ আশ্রয়স্থলে পরিণত হচ্ছে একেকটি স্থূলকায় শরীর। দুরারোগ্য সব ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে অসংখ্য পরিবার হচ্ছে নিঃস্ব। সে কারণে ভোক্তা আন্দোলন ও জনস্বাস্থ্য আন্দোলনে জড়িতরা অনেকেই বলছেন খাদ্যে ভেজাল মানুষ হত্যার চেয়েও ভয়াবহ।

বাংলাদেশের সংবিধান থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট আইনগুলোয় ‘নিরাপদ খাদ্যদ্রব্য ও সেবা’ লাভের সুযোগকে একজন নাগরিকের মৌলিক অধিকার হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। সম্প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী খাদ্যে ভেজাল, দুর্নীতি ও মাদকের বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতা প্রদর্শনের নির্দেশ দিয়েছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী খাদ্যে ভেজাল ও অনিরাপদ খাদ্য উৎপাদন এবং বিক্রয়কে ‘দুর্নীতি’ হিসেবে চিহ্নিত করে এ ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট মহলকে নির্দেশ দিয়েছেন। মহামান্য হাইকোর্ট প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণাকে সাধুবাদ জানিয়েছেন। সম্প্রতি হাইকোর্টও খাদ্য ভেজালকে দুর্নীতি বলে আখ্যা দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী আরো বলেছেন, এ ব্যাপারে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। সরকার এ ক্ষেত্রে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি অনুসরণ করবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এ ঘোষণা দেশে চলমান নিরাপদ খাদ্যের আন্দোলনকে আরো বেগবান করবে। দেশের নাগরিক হিসেবে আমরা খানিকটা স্বস্তি বোধ করছি। কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সেই কাঙ্ক্ষিত ঘোষণা মাঠ পর্যায়ে কতটুকু বাস্তবায়িত হচ্ছে বা জনগণ কতটুকু তার সুফল পাচ্ছে? জাতিসংঘ গৃহীত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যগুলোয় (এসডিজি) ‘ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ’কে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তার প্রতিফলন কতটুকু হচ্ছে, আমরা সবাই জানি। নকল ও মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর খাদ্যপণ্যে বাজার সয়লাব। পণ্যের প্যাকেটে উৎপাদনের তারিখ না থাকা, মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য বিক্রি করা, বেশি দাম রাখা, ফ্রি ডিসকাউন্টের নামে প্রতারণা, জেনেশুনে ভেজাল পণ্য বিক্রি করা, এক পণ্যের দরদাম ঠিক করে অন্য পণ্য দেওয়ার মতো অসংখ্য ঘটনা ঘটছে। এমনকি অসম্ভব বা অবাস্তব পণ্যের অফার, বাহারি বিজ্ঞাপন দিয়ে মানুষের পকেট কাটার দৃষ্টান্তও কম নয়।

দেশের ‘ভোক্তারা’ সর্ববৃহৎ অর্থনৈতিক জনগোষ্ঠী হলেও সরকারের প্রতিনিয়ত নানা বিষয়ে নীতিনির্ধারণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় তাদের অংশগ্রহণ একেবারেই নগণ্য। ভোক্তারা সুসংগঠিত নয় ও তাদের সংগঠন শক্তিশালী না থাকায় অনেক ক্ষেত্রেই সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় ভোক্তাদের ওপর কী প্রভাব ফেলবে সে বিবেচনায় উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে বারবার। এ অবস্থায় ভোক্তাস্বার্থ বিবেচনা, সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় ভোক্তাদের স্বার্থের বিষয়টি তুলে ধরা, ভোক্তাস্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কার্যক্রমে সমন্বয় সাধন, চাহিদা, উৎপাদন, আমদানির সঠিক পরিসংখ্যান সংরক্ষণ; সর্বোপরি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুফল থেকে দরিদ্র, স্বল্প আয় ও নিম্নমধ্যবিত্তের ভোক্তারা যাতে বঞ্চিত না হয় সেই লক্ষ্যে জীবনযাত্রার ব্যয় সহনীয় পর্যায়ে রাখার উদ্দেশ্যে ১৫ থেকে ২০টি অত্যাবশ্যকীয় খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য চিহ্নিত করে সেসব খাদ্যপণ্যের সরবরাহ পরিস্থিতি সন্তোষজনক পর্যায়ে এবং মূল্য স্থিতিশীল রাখার দায়িত্ব অর্পণ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে একটি পৃথক ডিভিশন অথবা পৃথক স্বতন্ত্র একটি ‘ভোক্তা অধিকারবিষয়ক মন্ত্রণালয়’

(Consumers Affairs Ministry) সৃষ্টি বহুল কাঙ্ক্ষিত দাবিতে পরিণত হয়েছে। তাই পৃথক মন্ত্রণালয় থাকলে অবশ্যই সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের নীতিনির্ধারক মহলে ভোক্তাস্বার্থের দিকগুলো বেশি মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে আসবে।

লেখক : ভাইস প্রেসিডেন্ট, কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)[email protected]