বাংলাদেশে কর্মসংস্থানে অটোমেশনের প্রভাব কেমন

।। বিশেষ প্রতিনিধি ।।

বিশ্বজুড়ে বদলে যাচ্ছে শ্রম খাত, কাজের প্রকৃতি। ক্লার্ক পেশা, রুটিন কাজ, মাঝারি ও অদক্ষ শ্রমের ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্বলিত যন্ত্র (রোবট) ও স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের (অটোমেশন) ব্যবহার বড় আকারের জায়গা দখল করছে। এতে কর্মহীন হয়ে পড়ছেন অসংখ্য মানুষ। এই সমস্যা এখনও চরম রূপ ধারণ না করলেও আশঙ্কা করা হচ্ছে, এর মাধ্যমে সৃষ্টি হতে পারে জবলেস ইকোনমি বা কর্মহীন এক অর্থনীতির। বিশ্বব্যাপী এ নিয়ে উদ্বেগ-আতঙ্ক বাড়ছে। বাংলাদেশও তার বাইরে নয়।

২০১৬ সালে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) একটি গবেষণায় অনুমান করা হয়, অটোমেশন যে হারে ছড়িয়ে পড়ছে, তাতে এশিয়ার কিছু দেশে বস্ত্র, বয়ন ও তৈরি পোশাক সংশ্লিষ্ট উৎপাদন খাতের ৮০ শতাংশেরও বেশি কর্মসংস্থান হারিয়ে যাবে। মার্কিন সংবাদমাধ্যম ওয়ালস্ট্রিট জার্নালের একটি প্রতিবেদনেও এর সপক্ষে বিভিন্ন তথ্য উঠে এসেছে।

প্রতিবেদনটিতে জানানো হয়েছে, জারাসহ বড় ফ্যাশন ব্র্যান্ডের জন্য পোশাক তৈরি করে বাংলাদেশের ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেড। বন্দরনগরী চট্টগ্রামে তার বহুতলা কারখানায় ব্যবহার করা হয় স্পেনে নির্মিত ফিনিশিং মেশিন। এই মেশিন দেড় ডলারেই পাওয়া যায়। এই মেশিনের মাধ্যমে জিন্সের মধ্যে মসৃণ ছিদ্র সৃষ্টি করা হয়। পাশের কারখানায় কয়েক ডজন শ্রমিক এই কাজ করেন। অথচ, তাদের সবার চেয়ে অনেক নিখুঁতভাবে একই পরিমাণ কাজ করে দেয় এই মেশিন। ফিনিশিং দিতে গিয়ে যেসব জিন্স নষ্ট হয়, সেগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে সেলাই করে দেয়ার জন্য ওই কারখানায় আছে আরও ৪টি মেশিন। একটি মেশিন যে পরিমাণ সেলাই করতে পারে, তা পুরনো কায়দায় করতে লাগে ১২ জন মানুষ।

আরেকটি কারখানা হলো ঢাকার মোহাম্মদি ফ্যাশন সোয়েটার্স লিমিটেড। ২০১২ সালের পর থেকে সেখানে শুরু হয় অটোমেশন। ২০১৭ সাল নাগাদ দেখা গেল বুননের পুরো কাজই করছে জার্মানিতে নির্মিত ১৭৩টি স্বয়ংক্রিয় মেশিন। আগে প্রতিদিন সর্বোচ্চ ১০ ঘণ্টা করে এই সোয়েটার বুননের কাজ করতো কয়েকশ’ শ্রমিক। এখন নিয়মিত বিরতিতে মেশিন পরিষ্কারের জন্য কয়েকজন দক্ষ শ্রমিক রয়েছেন। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক রুবানা হক জানান, প্রায় পাঁচশ’ শ্রমিককে ছাঁটাই করে মেশিন বসানো হয়েছে তার কারখানায়। কিনতে চান আরও মেশিন। এইচঅ্যান্ডএম ও জারার মতো পশ্চিমা ব্রান্ডের জন্য সোয়েটার বানায় মোহাম্মদি গ্রুপ।

বাংলাদেশের একজন শ্রমিক নেতাকে উদ্ধৃত করে ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল জানিয়েছে, যেসব কারখানায় আগে ৩০০ শ্রমিক ছিল এখন সেগুলোতে হয়তো ১০০ জন আছে। দেশের বড় পোশাক কারখানার মালিকরাও বলছেন, ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায়, অটোমেশনের দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া তাদের বিকল্প কিছু করার নেই।

২০১৬ সালে বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ : প্রপোসড ডেভেলপমেন্ট পলিসি ক্রেডিটস ফর মোর, বেটার, অ্যান্ড ইনক্লুসিভ জব’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০৩ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত দেশে কর্মসংস্থানের ঊর্ধ্বগতি বজায় থাকলেও ২০১০ সালের পর থেকে তা কমে আসছে। কর্মসংস্থানের এই নেতিবাচক প্রবণতা অকৃষি খাত থেকে শুরু করে উৎপাদনমুখী শ্রমঘন খাতেও বজায় রয়েছে জানিয়ে সংস্থাটি বলেছে, ২০০৩ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত গার্মেন্ট শিল্পে প্রতিবছর যেখানে ৩ লাখ ২০ হাজার শ্রমিক চাকরিতে ঢুকেছে, সেখানে ২০১০ সালের পর সেটি কমতে কমতে বছরে ৬৪ হাজারে নেমে এসেছে।

বিজিএমইএ’র দেওয়া হিসাবে দেখা গেছে, ২০১১-১২ অর্থবছরে দেশে পোশাক শিল্প-কারখানা ছিল ৫ হাজার ৪০০টি। সেখানে কর্মসংস্থান ছিল তখন ৪০ লাখ। ২০১৫-১৬ অর্থবছর শেষে খাতটির কারখানার সংখ্যা দাঁড়ায় ৪ হাজার ৩২৮টিতে। কিন্তু কর্মসংস্থান এখনও ৪০ লাখই। অর্থাৎ গত কয়েক দশকে পোশাক শিল্পের আয় বেড়ে দ্বিগুণ হলেও কর্মসংস্থান বাড়েনি বরং কমেছে।

কর্মসংস্থান কমলেও বাংলাদেশের তৈরি পোশাক উৎপাদন কমেনি বরং বাড়ছে ক্রমাগত। স্থানীয় ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, অটোমেশনই শ্রমিকদের স্থান পূরণ করছে। ফলে কমছে না উৎপাদন। ২০১৩ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যভাগে, বাংলাদেশের বার্ষিক তৈরি পোশাক রপ্তানির পরিমাণ ১৯.৫ শতাংশ বেড়েছে। কিন্তু এই সময়ে চাকরি বেড়েছে মাত্র ৪.৫ শতাংশ।

অটোমেশনের ফলে শ্রমিকরা কর্মসংস্থান হারাচ্ছে, এই অভিযোগে কান দেওয়ার চেয়ে বরং কারখানা মালিকরা এখানে জোরারোপ করতে চাচ্ছেন যে, অটোমেশনের ফলেই বাংলাদেশ এখনও সস্তা মূল্যে পোশাক রপ্তানি করতে পারছে এবং অন্যান্য দেশের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় টিকে আছে। বিদেশি ক্রেতারাও অটোমেশনে জোর দিচ্ছেন। বাংলাদেশে কমপ্লায়েন্স কারখানা তৈরির জন্য যেসব সূচক নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে অটোমেশন বৃদ্ধির প্রস্তাবনাও রয়েছে।

অটোমেশন যদিও মানুষের শ্রমের পরিমাণ কমিয়ে তার সুখ স্বাচ্ছন্দ্য সৃষ্টি করার কথা, কিন্তু গুটিকয়েকের নিয়ন্ত্রণে থাকায় তা হয়ে উঠেছে দুশ্চিন্তার কারণ। বলা হচ্ছে, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিপুল অগ্রগতির নতুন এই বিশ্বে আমাদের আরও শ্রম বাড়াতে হবে। অথচ হওয়ার কথা ছিল উল্টো। বিজ্ঞানের অগ্রগতির ফলে মানুষের শ্রমের পরিমাণ কমার কথা। বিশ্লেষকরা বলছেন, উৎপাদনের খাতসমূহে আরও বড় বড় পরিবর্তন ঘটবে। শ্রমিকদের তাই সংগঠিত হতে হবে। ব্যক্তিকে হতে হবে চটপটে এবং একের অধিক পরিমাণ কাজে দক্ষ হওয়া সকলের জন্যই আবশ্যক। আগামী পৃথিবীর কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য সবাইকে প্রস্তুত হতে হবে।