তথ্য-উপাত্তে জ্বালানি নিরাপত্তা

।। জ্বালানি ডেস্ক ।।

বাংলাদেশের জ্বালানি খাতের সাম্প্রতিক চিত্র ফুটিয়ে তুলতে এই খাতের বিশ্লেষকদের অনুসন্ধানকে ভিত্তি করে নিম্নে কিছু তথ্য-উপাত্ত পেশ করা হলো। ‘ভোক্তাকণ্ঠ ডটকম’-এর জ্বালানি খাত সম্পাদনা বিভাগ মনে করে, এসব তথ্য জ্বালানি খাতে ভোক্তা অধিকার রক্ষায় সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।

  • দেশের বর্তমান অবশিষ্ট গ্যাস মজুদ (প্রমাণিত ও সম্ভাব্য) ১৪ দশমিক ০৮৮ টিসিএফ। সরকারি ও পরামর্শক সংস্থার সূত্র মতে গ্যাস উৎপাদনের হার ২০১৭ সালের পর থেকে কমতে থাকবে। ২০২৫ সালে বর্তমান গ্যাস নিঃশেষ হবে না বটে তবে তা স্বল্প ও নগণ্য হারে ২০৩০ সাল বা তারপরও কিছু সময় পর্যন্ত সরবরাহ হবে।
  • ২০১০ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিদেশ থেকে আমদানিকৃত জ্বালানির ওপর নির্ভরতা ছিল ১০ শতাংশের কম, ২০৩০ সালে আমদানিকৃত জ্বালানির (গ্যাস, কয়লা ও আমদানিকৃত জ্বালানি তেল ও ইউরেনিয়াম) ওপর নির্ভরতা বেড়ে তা হবে ৭০ শতাংশ।
  • গ্যাস উন্নয়ন তহবিলের ৪ হাজার কোটি টাকা দেশীয় প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা বৃদ্ধির নামে ব্যয় হলেও এই খাতে তাদের অবদান আগের চেয়ে কমেছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এই অর্থ তছরুপ ও অপব্যয় হয়েছে। আইন সংশোধন করে ওই তহবিলের আরও আড়াই হাজার কোটি টাকা পেট্রোবাংলা ব্যাংকে এফডিআর রেখে সুদ নিচ্ছে। এখন আবার আইন সংশোধন করে ওই টাকা অন্য খাতে ব্যবহারের পরিকল্পনা করেছে সরকার।
  • সব ধরনের গ্যাস বিক্রির অর্থ থেকে সরকার শুল্ক-ভ্যাট পায় ৫৫ শতাংশ। আবার গ্যাসের সম্পদমূল্য ধরে দাম বাড়ানোর ফলে সেখান থেকেও শুল্ক-ভ্যাট পায় ৫৫ শতাংশ। বাদবাকি অর্থ থাকে সম্পদমূল্য মার্জিন হিসেবে। সেই অর্থ দিয়ে বিইআরসি জ্বালানি নিরাপত্তা তহবিল গঠন করেছে। ওই তহবিলে প্রায় ২৩ হাজার কোটি টাকা জমেছে। ১৯৯৮ সালে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ঘোষিত এসআরও (২২৭ নম্বর) অনুযায়ী এই অর্থ জ্বালানি উন্নয়নেই ব্যয় হবে। কিন্তু সরকার পরবর্তীতে ওই ঘোষণা পুনর্ব্যাখ্যা করে শুল্ক-ভ্যাট বাবদ ৫৫ শতাংশ অর্থ এনবিআরকে দিতে বলছে। এজন্য গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। অথচ এতদিন ৫৫ শতাংশ শুল্ক-ভ্যাটের টাকা নিয়ে যে তহবিল বানানো হলে তা ব্যবহার করে জনগণকে সুরক্ষা দেয়া হচ্ছে না।
  • ২০০৯ সাল থেকে এলপিজি সিলিন্ডারের সরকার নির্ধারিত দাম হলো ৭০০ টাকা। বিশেষজ্ঞরা ভারতে এর দাম বিবেচনায় নিয়ে এদেশের বিভিন্ন সূচক হিসাব করে দেখেছেন যে, এদেশে এলপিজি সিলিন্ডারের দাম ৪৫০ টাকা হওয়াই সমীচীন।
  • এলপিজি মূলত চলছে বেসরকারি খাতের উদ্যোগে। তা দেখভালের কোনো নীতিমালাও নেই। বেসরকারি উৎপাদকরা চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ না করে বাজারে সংকট তৈরি করে রেখেছে। এর ফলে এখানে কালোবাজার তৈরি হয়েছে। ৭০০ টাকার এলপিজি ৯৫০ থেকে ১২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
  • সরকার এই কালোবাজারির ফলে বাড়া এলপিজির দামের সঙ্গে সমন্বয়ের জন্য আবাসিক গ্যাসের দাম বাড়িয়েছে, আরও বাড়াতে চাচ্ছে। এর মাধ্যমে কালোবাজারিকে বৈধতা দেয়া হচ্ছে, তেমনি একে উৎসাহিত করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সরকারের উচিত ছিল এলপিজির দাম নিয়ন্ত্রণ করা। একচেটিয়া ব্যবস্থা ভেঙে দিয়ে বাজারে প্রতিযোগিতা তৈরি করার উদ্যোগ নেয়া।
  • দেশে নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার না হলে বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে নিজস্ব যে গ্যাসের উপর ভর করে অর্থনীতিকে আয়েশের সঙ্গে এগিয়ে নিয়ে এসেছে তার পরিসমাপ্তি ঘটবে। বিদ্যুৎ ও কয়লা আমদানিতেও খরচ হবে প্রচুর। বেশি দামের জ্বালানি আমদানির কারণে সাশ্রয়ী মূল্যে জ্বালানি ব্যবহারে অভ্যস্ত বাংলাদেশকে কঠিন আর্থিক চ্যালেঞ্জও সামলাতে হবে, বাধাগ্রস্ত হবে প্রবৃদ্ধি।
  • বিদেশি তেল-গ্যাস উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোর (আইওসি) গ্যাস ক্রয়ে ব্যয় বেশি হওয়ায় দেশীয় প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা বাড়াতে গ্যাস উন্নয়ন তহবিল গঠন করা হয় ২০১০ সালে। সে সময় আমাদের মোট গ্যাসের ৪৮ ভাগ আইওসি থেকে পাওয়া যেত। গ্যাসের দাম বাড়িয়ে ভোক্তাদের কাছ থেকে এ খাতে বছরে নেয়া হচ্ছে প্রায় ৮০০ কোটি টাকা। সুদসহ এ তহবিলে ইতোমধ্যে জমা হয়েছে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা। বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে খরচ করা হয়েছে ৪ হাজার কোটি টাকারও বেশি। অথচ দেশীয় কোম্পানির গ্যাসের পরিমাণ আরও কমে গেছে। আইওসির গ্যাসের পরিমাণ বাড়তে বাড়তে এখন ৬০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।
  • স্থলভাগ, অগভীর সমুদ্র এবং গভীর সমুদ্র, কোথাও গ্যাস উত্তোলন ও অনুসন্ধানে কোনো অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। হেলাফেলায় পার হয়ে গেছে এক দশকেরও বেশি সময়। এখন অনুসন্ধান ও উৎপাদনে যাওয়ার জন্য তড়িঘড়ি করলেও নতুন কোনো গ্যাসক্ষেত্র উৎপাদনে আসতে সময় লাগবে আরও অন্তত পাঁচ বছর। গ্যাস উত্তোলনের জন্য বিদেশি কোম্পানিগুলোর সঙ্গে করা উৎপাদন অংশীদারিত্ব চুক্তিতে (মডেল পিএসসি) স্বচ্ছতা নেই, আছে দুর্নীতির অভিযোগ। এর ফলে নতুন গ্যাস যখনই পাওয়া যাবে, তা আগের মতো সাশ্রয়ী হবে না।