জ্বালানিস্বার্থে ভোক্তাদের আরও স্বোচ্চার হওয়া দরকার

সড়ক ও জনপদ বিভাগের রাস্তা সংস্কারের কাজ চলে প্রায় বারমাস। তাদের অপরিকল্পিত খোঁড়াখুড়িতে নিয়মিতভাবে ভোগান্তাতিতে পড়ছে রাজধানীবাসী। সড়ক ও জনপদ বিভাগের এমন দায়িত্ব জ্ঞানহীন কর্মকাণ্ডের কারণে পানি ও গ‌্যাসের লাইন ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে নিয়মিতভাবে। এর ফলে, গ‌্যাস ও পানির সঙ্কটে দিনানিপাত করে নাগরিকরা মাঝে মধ‌্যেই। সম্প্রতি, আমিন বাজারে রাস্তা মেরামতকালে গ্যাসের পাইপলাইন ছিদ্র করে সড়ক ও জনপদ বিভাগ। এর কারণে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বিচ্ছিন্ন হয় গ‌্যাস সংযোগ। তিন-চার গ‌্যাস সঙ্কটে ভোগে ভূক্তভোগিরা। নাগরিকদের ভোগান্তি ও সড়ক ও জনপদ বিভাগের দায়িত্ব জ্ঞানহীন কর্মকাণ্ড নিয়ে একাত্তর টেলিভিশনে কথা বলেছেন দেশের বিশিষ্ট জ্বালানি বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ড. এম শামসুল আলম। সাক্ষাৎকারটি অনুলিখন করেছেন ভোক্তাকণ্ঠ প্রতিনিধি নাহিদ হাসান।

এমন সঙ্কটে মাঝে মধ‌্যেই পড়তে হচ্ছে রাজধানীবাসীকে। এ বিষয় নিয়ে আপনি কি বলবেন।

এম শামসুল আলম

এ ধরনের বিপর্যয় অনাকাঙ্ক্ষিত। তবে এটাকে কোনো ভাবেই অবশ্যম্ভাবী বলা যায় না। আবার এটাকে দূর্ঘটনা হিসেবেও মেনে নেওয়া যায় না। গ্যাসের পাইপলাইন পরিকল্পনা মাফিক টানা হয়েছে এবং তার ডিজাইন আছে। রাস্তাও তৈরি করা হয়েছে তার নিজস্ব ডিজাইন অনুযায়ী। রাস্তা সম্প্রসারণ বা মেরামতের কাজও চলবে ডিজাইনমাপিক। এটাই নিয়ম হবার কথা। গ্যাস অবকাঠামো তৈরির ক্ষেত্রে প্রকৌশলবিদ্যা সংশ্লিষ্ট জ্ঞান থাকা দরকার। আবার রাস্তা মেরামত ও রাস্তার অবকাঠামো তৈরির ক্ষেত্রেও প্রকৌশলবিদ্যা থাকা বাঞ্ছনীয়। দুই ক্ষেত্রেই প্রকৌশল জ্ঞান এবং প্রকৌশলীর সম্পৃক্ততা আছে যুক্তিসঙ্গতভাবেই। রাস্তা সম্প্রসারণ বা সংস্কারের ক্ষেত্রে, সেই রাস্তার আশেপাশে কোথায় বিদ‌্যুৎ, পানি ও গ‌্যাসের লাইন আছে তা ক্ষতিয়ে দেখতে হবে। অবশ‌্য, সেটা সেই এলাকায় গ্যাস সম্প্রসারণ বা গ্যাস নেটওয়ার্ক এর ডিজাইন দেখলেই বোঝা যায়। রাস্তা মেরামতকারী কর্তৃপক্ষের উচিত সেই ড্রইং গুলো দেখে কোথায় কোন পাইপ লাইন আছে সেটা সনাক্ত করে তাদের কার্যক্রম সম্প্রসারণে হাত দেয়া।


রাজধানীর অনেক এলাকায় গ্যাস সংকট একটি নিয়মিত অভিযোগ, বিশেষ করে শীতকালে এটি আরো প্রকোপ হয়, এর সমাধানও তো মিলছে না!

এম শামসুল আলম

প্রথমে এর সমাধান প্রত্যাশা ছিল। এলএনজির আমদানির পরেই হয়তো এই সংকট সমাধান হবে। কিন্তু এখন দেখা যায়, সেই সংকট সমাধানের দিকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যতটা মনোযোগ তার থেকে বেশি মনোযোগ এলপিজির ব্যবসা সম্প্রসারণে। এখন এই দুই জায়গায় জনগণকে ক্ষতির মুখোমুখি হতে হচ্ছে। কারণ আনমিটার্ড গ্যাসে জনগণ সবচেয়ে বেশি পয়সা দিয়ে থাকে। এখানে ৭৭ ইউনিট গ্যাসের বিল দেয়া হয়, ৩০-৪০ ইউনিট পায় জনগণ। এখানে জনগণ এলপিজির থেকেও বেশি দাম দিয়ে থাকে। এবং এখানে সরকার রাজস্ব এলএনজির থেকেও বেশি পেয়ে থাকে। অন্যদিকে সিএনজির ক্ষেত্রে দেখা যায় এলএনজির থেকে বেশি দামে সিএনজি বিক্রি হয়। সিএনজির দাম অসামঞ্জস্য ভাবে বাড়ানো হয়েছে। এলপিজির দামের সাথে অটোগ্যাসের সমন্বয় করার জন্য এই দাম বাড়ানো হয়েছে। এককথায় সিএনজির বিকল্প হিসেবে অটোগ্যাস অথ্যাৎ এলপিজি এবং বাসাবাড়িতে পাইপ গ্যাসের বিকল্প হিসেবে এলপিজির ব্যবসা সম্প্রসারণ করাই আজকের এই সংকটের মৌলিক কারণ। এখানে পাইপলাইনের ব্যবসা সরকারী কোম্পানির এবং এখানে সরকার ভোক্তাদের কল্যাণ নিশ্চিত করে পাশাপাশি চাহিদার তুলনায় এই গ্যাস স্বল্প। বিধায় এলপিজি ব্যবসা সম্প্রসারণ দরকার। এতে করে পারস্পরিক প্রতিযোগীতা সৃষ্টি হবে এবং এই ব্যবসায় স্বচ্ছতা আসবে, এবং এ ব্যবসায় সঠিক দামে প্রতিযোগিতা হলে ভোক্তাদের সুবিধা আসবে।

এবার দামের প্রসঙ্গে আসা যাক, ধাপে ধাপে গণশুনানি করে গ্যাসের দাম বাড়ে, অথচ চুলা জ্বলে না। গ্যাসের বিল দিতে হয় পাশাপাশি একই সাথে সিলিন্ডারও ব্যবহার করতে হয়। গ্যাস ব্যবহারে এই শহর গ্রাহকবান্ধব কবে হবে?


এম শামসুল আলম

গ্রাহকবান্ধব হবে তখনি, যখন জ্বালানি বিভাগ, বিদ্যুৎ বিভাগ, নিজ নিজ কার্যক্রমে জনগণের পাশে এসে দাঁড়াবে। শাসন বিভাগের কাজ সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের দায়িত্বপালনে সাড়া দেওয়া। কিন্তু, এসব প্রশাসনিক লোকজনই কোম্পানির মালিক থাকে। সব কোম্পানি যদি এভাবে ভোক্তাদের অধিকার বঞ্চিত করে তা হলে তার প্রতিকার প্রাসাশনিক ভাবে পাওয়া অনিশ্চিত হয়ে যায়। এই ক্ষেত্রে করনীয়, কোম্পানিগুলোর পরিচালনা বোর্ড থেকে তাদের চেয়ারম্যান এবং বোর্ডের সদস্য পথ থেকে জ্বালানি এবং বিদ্যুৎ বিভাগের সকলকে প্রত্যাহার করা। শুধু পলিসি রেগুলেটর দায়িত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে হবে তাদের। এতে গণশুনানি এবং বিআরটি বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেট কমিশন যথাযথ ভাবে আইনি দায়িত্ব পালনে সক্ষম হবে। তবে এটা যতক্ষণ পর্যন্ত রাষ্ট্র করতে পারছে না। ততক্ষণ পর্যন্ত ভোক্তাদের সুরক্ষার জন‌্য যে আইন তৈরী করা হয়েছে সে আইনের যথাযথ সুফল ভোক্তারা পাবে না। দ্বিতীয়ত, ভোক্তাদের অধিকার বলবৎ করার জন্য, ভোক্তাদের আরো বেশি সজাগ এবং সচেতন হতে হবে। পাশাপাশি আরো বেশি সোচ্চার হতে হবে তাদের। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দিকে দেখলে দেখা যায়, সেখানে এক পয়সা জ্বালানির দাম বাড়লে মানুষ রাস্তায় নেমে যায় তখন তড়িঘড়ি করে সবাই (প্রশাসন) নড়ে বসে। তাই জ্বালানিস্বার্থে ভোক্তাদের আরও স্বোচ্চার হওয়া দরকার।