হারিয়ে যাচ্ছে মণিপুরি তাঁতশিল্প

এক সময় মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের সব বাড়িতেই শোনা যেত তাঁত বুননের খটখট শব্দ। সে সময় মণিপুরি ও বাঙালি নারীরা মিলেমিশে তৈরি করতেন তাঁতের পোশাক। এই শিল্প এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। কমলগঞ্জ ছাড়াও এই তাঁতশিল্পের প্রচলন আছে শ্রীমঙ্গলে। কমলগঞ্জ উপজেলার আদমপুর, আলীনগর, কমলগঞ্জ, মাধবপুর ও ইসলামপুর ইউনিয়নে মণিপুরিদের সংখ্যা প্রচুর। অন্যান্য ইউনিয়নে বিচ্ছিন্নভাবে মণিপুরিদের বসবাস রয়েছে।

নিউজ বাংলার মাধ্যেম জানা যায়, প্রথমে নিজেদের জন্য তাঁতে কাপড় বুনলেও এখন অনেকটা বাণিজ্যিক হয়ে গিয়ে মণিপুরি তাঁতের মান নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মণিপুরিদের কাছ থেকে আস্তে আস্তে বাঙালিদের মাঝেও মণিপুরি তাঁতের কাজটি ছড়িয়ে পড়ায় আসল তাঁতের মান নষ্ট হচ্ছে বলেও জানান তারা।

মণিপুরি নারীদের তাঁতে বোনা শাড়ি, চাদর, গামছা, ওড়নাসহ বিভিন্ন বস্ত্র বাজারে বিক্রি হচ্ছে। বিভিন্ন মেলায়ও এসব পণ্য ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। মণিপুরিদের বিয়েতে গালিশার ফিডাসহ নানা উপকরণ লাগে। সেগুলো তারা নিজেরাই বোনে।

পুঁজি ও যথাযথ প্রশিক্ষণের অভাবে বর্তমানে মণিপুরি তাঁতশিল্পের উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে। তাঁত বোর্ড এ ব্যাপারে উদাসীন। এ জন্য আদিবাসী-অধ্যুষিত উপজেলার মণিপুরি সম্প্রদায়সহ অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর মাঝে ছড়িয়ে পড়া অতি প্রাচীন তাঁতশিল্প বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে।

ঋণ পরিশোধ করেও পাচ্ছেন না নতুন ঋণ। অভিযোগ উঠেছে তাঁত বোর্ডের কর্মচারী-কর্মকর্তাদের যোগসাজশে ঋণ দেয়ার নামে চলছে প্রহসন। পুরাতন কমিটি রেখেই নতুন কমিটির নামে নিচ্ছেন টাকা।

বর্তমানে পুঁজির অভাবে অধিকাংশ তাঁতই বিকল অবস্থায় পড়ে রয়েছে। দেখে মনে হয়, ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য প্রতীক হিসেবে রাখা হয়েছে। অনেকেই তাঁত ব্যবসা ছেড়ে অন্য ব্যবসায় যুক্ত হচ্ছেন বলেও তাঁতশিল্প ঐতিহ্য হারাচ্ছে।

এখানে রয়েছে দাদন ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য, যে কারণে সঠিক মূল্য পাচ্ছেন না প্রান্তিক তাঁতিরা। এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে উপযুক্ত মূলধন, প্রয়োজনীয় কাঁচামাল ও বাজারজাত করার ব্যবস্থা প্রয়োজন মনে করছেন অনেকে। বিচ্ছিন্নভাবে গড়ে ওঠা তাঁতিদের একটি জায়গায় নিয়ে এলে শিল্পটি লাভের মুখ দেখবে বলেও ধারণা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের।

বিজয় সিংহ ও সত্যবান সিংহ, অজিত সিংহ, মৃণাল কান্তি সিংহসহ অনেক তাঁতি জানান, তারা সঠিক সময়ে ঋণ, তাঁত বোর্ড থেকে প্রশিক্ষণ, শ্রমের সঠিক মজুরি না পাওয়ার কারণে তাঁত বোনায় আগ্রহ পান না।

অজিত সিংহ জানান, একটি মণিপুর শাড়ি একা কাজ করতে পাঁচ থেকে ছয়দিন লেগে যায়। আর দুইজন মিলে করলে তিন দিন লাগে। একটি শাড়ি মাত্র ১২০০ থেকে ১৫০০ টাকায় বিক্রি করে লাভ থাকে না।

মৃণাল কান্তি সিংহ জানান, এখন পাঙ্গাল মণিপুরি ও মুসলিমরা বাণিজ্যিক চিন্তায় তাঁতে কাপড় বোনায় মান নষ্ট হচ্ছে। তারা অল্প টাকা ব্যয়ে কাপড় বুনন করে অল্প টাকায় বিক্রি করে দিচ্ছে এতে করে মণিপুরি কাপড়ের যে গুণ, তা থাকছে না। কিছু কিছু ব্যবসায়ী মুণিপুরি কাপড়ের সঙ্গে টাঙ্গাইলের কাপড় এনে মণিপুরি বলে বিক্রি করছেন।

এ বিষয়ে মণিপুরি তাঁতি সমিতির সভাপতি রাজলক্ষ্মী সিনহা বলেন, ‘প্রায় ২০ বছর আগে তারা তাঁত বোর্ড থেকে ১০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ করে দেন। কিন্তু পরিশোধ করার পর বারবার তাঁত বোর্ডের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও তাঁত বোর্ড ঋণ না দিয়ে বলছে, যারা ঋণ পরিশোধ করেনি, তাদের ঋণ পরিশোধ না হলে নতুন করে ঋণ দেয়া যাবে না। অথচ তাঁত বোর্ড তাদের সমিতিকে বাঁধ দিয়ে নতুন করে সমিতি করে ঋণ দেয়ার ব্যবস্থা করছে। তারা আরও বলেন, তাদের জানানো পর্যন্ত হয়নি।

দক্ষিণ গোলের হাওরের বিধবা উষা রানী সিনহা বলেন, নতুন করে যে সমিতি করা হচ্ছে সেটা তিনি জানেন না। তিনি বলেন, খুব কষ্ট করে মহাজনের কাছ থেকে সুতা এনে কাপড় তৈরি করে কোনো রকমে দিনাতিপাত করছেন।

প্রকৃত তাঁতি রেখে নিজেদের মনমতো লোককে ঋণ দেয়ার অভিযোগ উঠেছে তাঁত বোর্ডের কমলগঞ্জের বার্তা বাহক কবির আহমদের বিরুদ্ধে। তিনি শ্যালিকা মাহবুবা বেগমকে টাকা দেন, সেটা নিয়ে রয়েছে সমালোচনা।

অভিযোগ উঠেছে আগের কমিটিকে পাশ কাটিয়ে নতুন সমিতি করারও। নতুন কমিটি অনুমোদন না পেলেও, টাকা তোলার কথা না থাকলেও তা করা হচ্ছে।

তাঁত বোর্ডের বার্তাবাহক কবির আহমদ জানান, তিনি এ বিষয়ে কিছুই জানেন না। তবে সভাপতি ও সেক্রেটারি টাকা নিতে পারেন বলে ধারণা করছেন।

কবির আহমদের শ্যালিকা মাহবুবা বেগম বলেন, তিনি লিয়াজোঁ অফিসারের কথায় টাকা নিচ্ছেন। তবে টাকাটা পূবালী ব্যাংক আদমপুর শাখায় অ্যাকাউন্ট খুলে জমা রাখছেন।

সমিতির অনুমোদন না পাওয়ার পরও কেন টাকা নিচ্ছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘পরে ফোন করে জানাবেন।’

কিন্তু পরে ফোনও ধরেননি বা তিনিও ফোন করেননি।

এ বিষয়ে কবির আহমদ, তার শ্যালিকা মাহবুবা ও তাঁত বোর্ডের লিয়াজোঁ কর্মকর্তার সাথে কথা বললে তাদের কথার মধ্যে পাওয়া যায় গরমিল।

কমলগঞ্জ তাঁত বোর্ডের লিয়াজোঁ কর্মকর্তা বরকত উল্লাহ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন থেকে ঋণ নিয়ে অনেকেই তা পরিশোধ করেনি। তাই এলাকার লোকজনের কথায় আমি একটি সভায় গিয়ে তিনটি গ্রামের লোকজন নিয়ে বসেছি।’

সূত্রঃ নিউজ বাংলা টুয়েন্টি ফোর