কোথায় গেলো চিকিৎসকদের প্রণোদনার টাকা?

গতবছর ৭ এপ্রিল এক ভিডিও কনফারেন্সে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘মার্চ (২০২০) থেকে যারা কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ করছেন, আমি তাদের পুরস্কৃত করতে চাই।’

তিনি বলেন, ‘সরকার তাদের উৎসাহ দিতে বিশেষ প্রণোদনা দেবে। এ ছাড়া দায়িত্ব পালনের সময় কেউ কোভিড-১৯ আক্রান্ত হলে তার জন্য ৫-১০ লাখ টাকার স্বাস্থ্যবীমা থাকবে। কেউ মারা গেলে স্বাস্থ্যবীমা পাঁচগুণ হবে।’করোনা মহামারিতে সম্মুখসারির যোদ্ধা বলা হয় চিকিৎসক, নার্সসহ অন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের। প্রণোদনা ছিল দুই মাসের মূল বেতন। এ ছাড়া করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালে কাজ করা চিকিৎসকদের ১৫ দিনের দৈনিক দুই হাজার টাকা ভাতাও ছিল। করোনা আক্রান্ত হলে চিকিৎসকদের জন্য পাঁচ থেকে ১০ লাখ টাকার স্বাস্থ্যবীমাও ছিল। মূল বেতনের যে প্রণোদনা দেওয়ার কথা সেটা এখন পর্যন্ত কেউ পায়নি বলে জানান করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালগুলোতে দায়িত্ব পালন করা চিকিৎসকরা।গতবছরের ৭ এপ্রিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সে করোনা রোগীদের চিকিৎসার সঙ্গে জড়িতদের জন্য প্রণোদনা ঘোষণা করেন। ঘোষণার এক বছর পরও কেউ তা পাননি।

বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের দেওয়া তথ্যমতে করোনায় হাসপাতালগুলোতে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এ পর্যন্ত মোট ৮ হাজার ১৮৪ জন স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত হয়েছেন। এদের মধ্যে চিকিৎসক রয়েছেন দুই হাজার ৯০৩ জন, নার্স এক হাজার ৯৯০ জন, অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী তিন হাজার ২৯১ জন। করোনা কিংবা করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন ১৩৬ জন চিকিৎসক।

শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজের ভাইরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. জাহিদুর রহমান  বলেন, এক বছর জনস্বার্থে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করেছি, অতিরিক্ত টাকা খরচ করেছি। সরকারি দায়িত্ব পালন করতে যেয়ে নিজে করোনায় আক্রান্ত হয়েছি, পরিবারের সব সদস্য আক্রান্ত হয়েছে। তারপরও দায়িত্বে অবহেলা করিনি। কিন্তু আর তো পারা যাচ্ছে না।কোয়ারেন্টিন ভাতা, প্রণোদনা, ক্ষতিপূরণ কিচ্ছু পাইনি। লকডাউনের মধ্যে যাতায়াত, খাওয়া খরচ অন্য সময়ের চেয়ে বেড়ে যায়। প্রথমদিকে সুরক্ষা সামগ্রী কেনার পেছনেও আমাদের অনেক টাকা খরচ হয়েছে। অথচ এর সবই দেওয়ার কথা ছিল রাষ্ট্রের।

প্রধানমন্ত্রী নিজে ঘোষণা দিলেন, সরকারি প্রজ্ঞাপন হলো। অথচ একবছর পরও আমরা এভাবে বঞ্চিত হচ্ছি।’ বলেন ডা. জাহিদুর রহমান।
গত ৯ জুলাই অর্থমন্ত্রণালয়ের বাজেট অনুবিভাগের যুগ্মসচিব ড. মোহাম্মদ আবু ইউসুফের সই করা ‘করোনাভাইরাস  (কোভিড-১৯) আক্রান্তদের চিকিৎসা সেবায় সরাসরি নিয়োজিত স্বাস্থ্যকর্মীদের এককালীন বিশেষ সম্মানী’ শীর্ষক পরিপত্রে বলা হয়, ‘করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের সেবা প্রদানে সরাসরি নিয়োজিত চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সরকার এককালীন বিশেষ সম্মানী দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।’
পরিপত্রে আরও বলা হয় ‘বিশেষ সম্মানীর আওতায় শুধু করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের সেবা প্রদানে সরাসরি কর্মরত চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা এককালীন দুই মাসের মূল বেতনের সমপরিমাণ অর্থ পাওয়ার যোগ্য হিসেবে বিবেচিত হবেন।’

এর আগে গত ১৭ জুন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক চিঠিতে বলা হয়, করোনার চিকিৎসা দেওয়া চিকিৎসক, নার্সসহ অন্যদের কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ প্রণোদনা দেওয়ার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দেন। সেজন্য অধিদপ্তর থেকে সেদিন থেকে তিন দিনের ভেতর চিকিৎসক, নার্সসহ অন্যদের নাম পাঠানোর অনুরোধ করা হয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) ডা. শেখ মোহাম্মদ হাসান ইমাম বলেন, ‘দুই মাসের এককালীন প্রণোদনার বরাদ্দ হয়েছে কিছু প্রতিষ্ঠানের জন্য। কাজ হচ্ছে, তবে একটু যাচাই বাছাই করতে হয়। হাসপাতাল থেকে যে তালিকা পাঠানো হয়েছে আমাদের কাছে, সেগুলো মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে অধিদপ্তর।’

তিনি আরও বলেন, ‘চিকিৎসকরা ক্লান্ত, এটা সত্যি। তাদের মধ্যে আক্রান্তের হারও অনেক। এটাও জানি। তবে আমরা চিকিৎসকদের বিভিন্নভাবে, মিটিংয়ের মাধ্যমে উজ্জীবিত করার চেষ্টা করছি।’ ‘চিকিৎসকরা দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে যেমন নিজেরা আক্রান্ত হয়েছেন তেমনি তাদের পরিবারের অনেকেই আক্রান্ত হয়েছেন। এতো ঝুঁকির মধ্যেও পেশাগত নৈতিকতা, দেশের মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা এবং সর্বোপরি প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানের কারণে কাজ করে গেছেন, এখনও করছেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পরও, অর্থমন্ত্রণালয়ের বরাদ্দের পরও চিকিৎসকরা প্রণোদনার টাকা পাননি। এটা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উদাসীনতা। বড় ব্যবসায়ীদের অনেকেই প্রণোদনার টাকা পেয়েছেন। পাননি চিকিৎসকরা। এটা পুরো চিকিৎসক সমাজের জন্য খুবই কষ্টের।’