ভোক্তার রমজানের ধর্ম ও করণীয়

রোজা ইসলামের অন্যতম ফরয ইবাদাত। ইসলাম হচ্ছে মুসলিমের পাঁচ স্তম্ভ বিশিষ্ট ঘর। রোজা হচ্ছে সেই ঘরের তৃতীয় স্তম্ভ। ইসলামি পরিভাষায়, ‘সুবহে সাদিক হতে সুর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার ও যৌনসম্ভোগ হতে বিরত থাকার নাম রোজা’। মুমিনদের মাঝে আল্লাহর বিশেষ রহমত হিসেবে রমজান মাস আসে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা ফরমান, “হে ঈমানদারগণ, তোমাদের উপর রোজা ফরজ করা হয়েছে। যেমন ফরজ করা হয়েছিলো তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের উপর। যেন তোমরা পরহেযগারী অর্জন করতে পার।” (সূরা- বাকারা, আয়াত- ১৮৩)

রজব মাস আসলেই মহানবি (স.) নফল রোজা রাখা ও নফল নামাজ পড়ার মাধ্যমে রমজান মাসের প্রস্তুতি নিতেন। আর বেশি বেশি এই দোয়া করতেন- হে আল্লাহ! আপনি আমাদের রজব ও শাবান মাসের বরকত দান করুন এবং আমাদেরকে রমজান পর্যন্ত পৌঁছে দিন।

এই ঘটনার মাধ্যমে রমজান মাস সম্পর্কে মহানবী (স.) এর উৎসাহ জানা যায়। আল্লাহ তায়ালা রমজান মাসকে পবিত্রতম মাস হিসেবে ঘোষণা করেছেন।

হাদীসে এসেছে, একদিন রাসূলুল্লাহ (স.) মিম্বরে আরোহনের সময় মিম্বরের প্রথম সিঁড়িতে পা রেখে বললেন, ‘আমীন’। তারপর দ্বিতীয় সিড়িতে পা রেখে বললেন ‘আমীন’। তৃতীয় সিঁড়িতে পা রেখে বললেন ‘আমিন’। তিনি মিম্বর থেকে নামার পর সাহাবীরা তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (স.), আমরা আপনার কাছে আজ এমন জিনিস শুনতে পেলাম যা আগে কখনও শুনতে পাইনি। তখন মহানবি (স.) বললেন, জিব্রাইল (আ.) এসেছিলেন। জিব্রাইল (আ.) বললেন, সে ব্যক্তি আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হউক, যে রমজান পাওয়া সত্বেও তার গুনাহ মাফ হয়নি, আমি (মহানবি স.) তখন বললাম ‘আমিন’। দ্বিতীয় সিঁড়িতে পা রাখার পর জিব্রাইল (আ.) বললেন, সেই ব্যক্তি আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হউক, যার কাছে আপনার নাম উচ্চারিত হয়েছে কিন্তু সে আপনার উপর দরুদ পাঠ করেনি। তখন আমি (মহানবি স.)  বলেছি ‘আমিন’। তৃতীয় সিঁড়িতে পা রাখার পর জিব্রাইল (আ.) বললেন, সেই ব্যক্তিও আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হউক, যে ব্যক্তি তার বৃদ্ধ মা-বাবা দুইজনকে কিংবা একজনকে পাওয়া সত্ত্বেও তাদের সেবা, তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাতে পারেনি। আমি (মহানবি স.)  তখন বললাম, আমীন।

রোজার মর্যাদা ও উপকারিতা:

১) জাহান্নাম থেকে রক্ষা পাওয়ার ঢাল।
২) জান্নাতে যাওয়ার উৎকৃষ্টতম উপায় এবং রাইয়ান নামক বিশেষ দরজা দিয়ে জান্নাতে প্রবেশের সুযোগ।
৩) গুনাহ মোচনের অন্যতম মাধ্যম।
৪) রোজা কিয়ামতের দিন মুমিন ব্যক্তির জন্য সুপারিশকারী হবে।
৫) রোজার পুরষ্কার আল্লাহ নিজ হাতে প্রদান করবেন।
৬) রোজার মাধ্যমে আচার-আচরণ ও চরিত্র সুন্দর হয়।
৭) রোজা মানুষকে আখিরাত মুখী করে।
৮) সামাজিক সহমর্মিতা ও ভ্রাতৃত্ব বোধ সৃষ্টি করে।
৯) এটি আল্লাহ ও বান্দার মাঝে নিতান্ত গোপন ইবাদত তাই এর মাধ্যমে আল্লাহ ও বান্দার মাঝে সম্পর্ক দৃঢ়তর হয়।
১০) আল্লাহর ইবাদতের এক অভূতপূর্ব ট্রেনিং স্বরুপ।

রাসুল (স.) বলেছেন রমজান মাসে আমার উম্মত কে পাঁচটি নিয়ামত দান করা হয়েছে, যা আগের কোনো উম্মতকে দেওয়া হয়নি
১. রোজাদারের মুখের দুর্গন্ধ আল্লাহর কাছে মেশকের চেয়ে বেশী ঘ্রানযুক্ত।
২. ইফতার পর্যন্ত রোজাদারের জন্য ফেরেশতারা দোয়া করেন।
৩. রোজাদারের জন্য প্রতিদিন জান্নাতকে সজ্জিত করা হয়।
৪. শয়তানকে বন্দি করা হয়।
৫. রমজানের শেষ রাতে সকল উম্মতকে মাফ করা হয়।

রমজান মাসে আমাদের যে কাজগুলো বেশী বেশী করা উচিৎ:

০১. রমজান রাত্রি জাগরণের মাস। এই মাসে সালাতুল কেয়াম অর্থাৎ তারাবীর নামায পড়া হয়। তারাবীর নামায দ্বারা অতীতের সকল গুণাহ মাফ হয়ে যায়। তাই আমাদেরকে তারাবীহ পড়ায় গুরুত্বারোপ করতে হবে।
০২. রমজান মাসে কুরআন নাজিল হয়েছে, তাই এটি কুরআনের মাস। ফলে আমাদের বেশী বেশী কুরআন তিলাওয়াত করা উচিত।
০৩. আল্লাহর কাছে জান্নাত কামনা করা এবং জাহান্নাম থেকে পানাহ চাওয়া।
০৪. রোজার উপবাসের মাধ্যমে ক্ষুধা-পিপাসায় কাতর অভাবী মানুষের দুঃখ বুঝা সহজ এবং এভাবেই রোজা মুসলিমদের মধ্যে সহানুভূতি, মমত্ব ও ভ্রাতৃত্বের সৃষ্টি করা যায়।
০৫. রমজান তাকওয়ার মাস। তাই সিয়াম সাধনার মাধ্যমে অধিকতর তাকওয়া অর্জন সম্ভব।
০৬. এই মাসে বড় বড় শয়তানদেরকে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়। জান্নাতের দরজা খুলে দেওয়া হয় এবং
জাহান্নামের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়। রমজানের প্রতি রাত্রে রোজাদার মুমিনদেরকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। রমজানের শেষ এক রাত্রেই সারা মাসের সমান সংখ্যক লোককে মুক্তি দেওয়া হয়। সেজন্য আমাদের বেশী করে নেক আমল করা উচিত।
০৭. এই মাসে কদরের রাত রয়েছে, যা হাজার মাসের চাইতেও উত্তম। শ্রমিক কর্মদিবসের শেষে যেমন পারিশ্রমিক পায়, রোজাদারও তেমনি রমজানের শেষ দিন ক্ষমা লাভ করে। সূতরাং আমাদের উচিত কদরকে অন্বেষণ করা।
০৮. অন্য মাসে যে কোনো নেক কাজের বিনিময়ে দশ থেকে সাত’শো গুণ। কিন্তু রমজানের রোজার প্রতিদান এর চাইতেও অনেক বেশি। আল্লাহ নিজ হাতে সেই সীমা-সংখ্যাহীন পুরষ্কার দান করবেন। তাই আমাদের বেশী করে নেক আমল করা উচিত।
০৯. এই মাস দান-সদকার মাস। এই মাসে রাসূলুল্লাহ (স.) সর্বাধিক দান করতেন। অতএব আমাদের উচিত এ মাসে যাকাত আদায় করা এবং সার্মথানুযায়ী নফল দান সাদকাহ করা।
১০. রমজান হচ্ছে তাওবার মাস। তাওবার মাধ্যমে গুণাহ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
১১. রমজান হচ্ছে জেহাদের মাস। এই মাসে মুসলিমদের বড় বড় ঐতিহাসিক বিজয় সাধিত হয়েছে। তাই এটাকে কুরআনে বিজয়ের মাসও বলা হয়েছে।
১২. এই মাসে এতেকাফ করা হয়। রাসূলুল্লাহ (স.) প্রতি রমজানে এতেকাফ করতেন।
১৩. ইফতার রমজানের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। ইফতারের সময় দো‘আ কবুল হয়। সুতরাং আমাদের কর্তব্য হলো বেশী করে ইফতারের সময় আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করা।
১৪. এই মাসের ওমরায় হজ্জের সমান সওয়াব পাওয়া যায়। অতএব, আমাদের যাদের সামর্থ আছে তাদের এ মাসে ওমরার সুযোগ নেয়া ।
১৫. রমজান সবর ও ধৈর্য্যের মাস। আমাদের সবার এ থেকে ধৈর্যের শিক্ষা নেয়া আবশ্যক।
১৬. রোজার মাধ্যমে মুখ-চোখ ও কানকে সংযত রাখার মাধ্যমে মুসলিম সমাজ থেকে নিন্দা-গীবত, অপবাদ ও চোগলখুরীর মতো সামাজিক ব্যাধি হ্রাস পাওয়া সম্ভব হয়।
১৭. রমজানে সাদাকাতুল ফিতর দিতে হয়। এর মাধ্যমে রোজার ত্রুটি-বিচ্যুতি দূর হয়।

আমরা যেন রমজানের মূল শিক্ষা যথাযথভাবে গ্রহণ করতে পারি। রমজান যেন আমাদের জীবনে গতানুগতিক না হয়ে কল্যাণ ও মুক্তির প্রতীক হতে পারে সে চেষ্টা সবাইকে করতে হবে। আল্লাহ আমাদের জীবনে রমজানকে বারবার ফিরিয়ে আনুক, এটাই হোক আমাদের প্রার্থনা।