ভালো সংসদ সদস্য হতে হলে প্রথমে ভালো মানুষ হতে হবে: সিমিন হোসেন রিমি এমপি

ভোক্তাকণ্ঠ রিপোর্ট: নারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একজন সংসদ সদস্যর ‘অভিজ্ঞতা বিনিময় ও কথোপকথন’ শিরোনামের এক অনুষ্ঠানে লেখক, সমাজসেবক, রাজনীতিবিদ গাজীপুর-৪ আসনের সংসদ সদস্য সিমিন হোসেন রিমি শিক্ষাজীবনেই সকল প্রকার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের দক্ষ ও ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার পরামর্শ দেন।

রোববার (২৯ অক্টোবর ২০২৩) নারী শিক্ষার্থীদের দেশপ্রেম ও আত্মনির্ভরশীল হওয়ার অনুপ্রেরণা দিতে এবং ভবিষ্যতে তরুণ প্রজন্ম যাতে দক্ষ সংসদ সদস্য হিসেবে নিজেদের গড়ে তুলতে পারে সেই লক্ষ্যে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে অনলাইনে যুক্ত হয়েছিলেন সিমিন হোসেন রিমি এমপি।

রাত সাড়ে ৮টা থেকে রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত তিনি নারী শিক্ষার্থীদের অভয় যুগিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে বলেন। এ সময়ে সফলতার পেছনে তার মায়ের সাহসিকতার প্রসঙ্গও তুলে ধরেন এই নারী সাংসদ।

কথোপকথনে ভার্চুয়ালী যুক্ত হয়েছিলেন ইডেন মহিলা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, বদরুন্নেছা সরকারি কলেজ, ঢাকা সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজসহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীরা।

অনুষ্ঠানের আয়োজন করে কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) ডিজিটাল প্লাটফর্ম ভোক্তাকণ্ঠ।

উল্লেখ্য, সিমিন হোসেন রিমি মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এবং রাজনীতিবিদ ও সমাজকর্মী সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনের মেয়ে।

এই অনুষ্ঠানে সিমিন হোসেন রিমি বলেন, ‘আমি যেহেতু রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান, তাই আমি সবসময় মানুষের মধ্যে থাকতাম। তবে ছোটবেলায় আমি যে বিষয়টি লক্ষ্য করেছি, তাহলো মানুষ প্রচুর মিথ্যা কথা বলে। তারা পরিবেশ অনুযায়ী কথা বলে। যে যে পরিবেশে আছে, সেই পরিবেশের সঙ্গে খাপ খেয়ে কথা বলে। সত্য কথা বলার সাহস তারা পায় না। ওই বিষয়গুলো আমায় কষ্ট দিতো। ভাবতাম মানুষ কেন সত্য বলতে ভয় পায়। তখন থেকেই আমি সত্য বলার চেষ্টা করেছি।’

এ সময়ে তিনি বলেন, ‘মায়ের সাহসীকতা আমাকে অনুপ্রেরণা দিত। আমার বাবা বেশির ভাগ সময়ই জেলে থেকেছেন। যার কারণে মা বাবাকে দেখতে যেতেন। একবার বাবা রাজশাহী জেলে ছিলেন। তখন বাবাকে দেখতে মা ট্রেনে যাচ্ছিলেন। এমন সময় ট্রেনে ডাকাত পরে। তখন মা সাহস করে ট্রেনের শিকল ট্রেনে ধরে ট্রেন চলা বন্ধ করে দেয়। এই কথা যখন আমরা জানলাম, তখন বিস্মিত হলাম! আবার একদিন মা মিছিল থেকে বাসায় ফেরার পর দেখি মায়ের চোখ-মুখ লাল। মা বললো পুলিশের টিয়ার গ্যাসে এমন হয়েছে। কিন্তু মাকে নার্ভাস হতে দেখিনি। মায়ের এ সাহসী কাজগুলো আমাকেও সাহস যুগিয়েছে।’

জীবনে বড় হতে হলে বই পড়ার বিকল্প নেই উল্লেখ করে সিমিন হোসেন রিমি বলেন, ‘তোমাদের যদি জানার আগ্রহ না থাকে বা প্রশ্ন করতে না পারো, তাহলে জানতে পারবে না। আমরা ভাই-বোনেরা প্রচুর বই পড়তাম, এখনো পড়ি। আমি এখনো রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় মানুষের দিকে তাকিয়ে থাকি যে তারা কি বলতে চায়। আমি জানতে চাই! ছোটবেলায় আমার বই পড়তে ভালো লাগতো। তার চেয়েও বেশি বই পড়তো আমার বড় বোন। আমরা প্রচুর বই পড়তাম। এমনও হয়েছে রাস্তার ল্যাম্পোস্টের নিচে বসেও বই পড়েছি। এখনো বই পড়ি। বিভিন্ন বিষয়ে জানার চেষ্টা করি।’

তিনি বলেন, ‘আমার বাবা তো সব সময় রাজনীতি নিয়েই থাকতো। তাই আমাদের উপার্জনের উৎস ছিল সামান্য কিছু বাসা ভাড়ার টাকা। রাজনীতি করার কারণে আমাদের বাড়িতে ভাড়াটিয়া থাকতে চাইতো না। আমি আম্মাকে দেখেছি বাসা ভাড়ার টাকা থেকে কিছু টাকা জমিয়ে গ্রামের বাচ্চাদের জন্যে খেলনা বা অন্য কিছু কিনেছে এবং সেটা গ্রামে গিয়ে দিয়ে এসেছে। তখন তো গ্রামে স্কুল ছিল না যে বাচ্চারা লেখাপড়া করবে। আবার নানা কুসংস্কার ছিল। একবার এক মেয়ে কন্যা সন্তান জন্ম দেওয়ায় তার শ্বশুর বাড়ি থেকে তাকে তালাক দেয়, তখন মা তাকে নিয়ে আসে। মায়ের এ সকল বিষয় দেখে আমরাও শিখেছি। তখন কারও অসুখ হলে নিজেই হাসপাতালে নিয়ে যেতাম।’

আলোচনাকালে তিনি আরও বলেন, ‘১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানী বাহিনীরা আমাদের বাড়িতে আসে। বাবাতো আগে থেকেই বাড়িতে নেই। তখন নিচতলায় আমরা থাকতাম আর দোতলা ভাড়া দেওয়া। আমরা সবাই দোতলায় চলে যাই। তারা এসে মায়ের বুকে এবং ভাড়াটিয়ার বুকে অস্ত্র ঠেকিয়ে উর্দুতে জিজ্ঞেস করে- কোথায় মিসেস তাজউদ্দীন। তখন মা সাহস করে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে উর্দুতে বলে, তারা তো নিচের তলায় থাকে, আমরা ভাড়াটিয়া। কোথায় গেছে আমরা জানি না। এ জন্যই বলেছিলাম এ বাড়িতে ভাড়া নেওয়ার দরকার নাই। তখন তারা বলে, ঠিক আছে আমরা চলে যাচ্ছি।’

শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে সিমিন হোসেন রিমি বলেন, ‘আমার সব সময় জানতে ইচ্ছে করে। আমি সব সময় জানতে চাই। যেমন ১৯৮৬ সালে হ্যালির ধূমকেতু হওয়ার কথা শুনে ভাবতাম- কবে হবে ধূমকেতু বা সেটা দেখতে কেমন হবে। আবার মহাশূন্য বা বিশ্ব জগৎ নিয়ে ভাবতাম। ভারতের চাঁদে যাওয়ার বিষয়ে জানার চেষ্টা করি- তারা কীভাবে গেল ইত্যাদি ইত্যাদি।’

তিনি বলেন, ‘জীবন মানেই সংগ্রাম। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সংগ্রাম করে যেতে হবে। এর জন্য যখন কোনো সমস্যার মধ্যে পড়ে যাবে, তখন নিজের শক্তিতেই কোনো বুদ্ধি বের করতে হবে। নিজেকে কখনোই অহংকারী ভাবা যাবে না। আবার আমি পারবো না- এটাও ভাবা যাবে না। নিজের যতটুকু শক্তি আছে তাই নিয়েই সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে হবে। এ জন্য তোমাকে পরিকল্পনা করতে হবে- আমি কোথায় যাব। এতে অনেক বাধা আসবে। তবে সেটা অতিক্রম করাই জীবনের তৃপ্তি। তাই তোমরা যারা এখানে আছো, তাদেরকে শক্তি-সাহস নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে।’

এক প্রশ্নের জবাবে এই সংসদ সদস্য বলেন, ‘আমার খুব আক্ষেপ ছিল, আমি মাকেও বলতাম- আমি কেন ছেলে হয়ে জন্মাইনি। ভাবতাম ছেলে হয়ে জন্মালে হয়তো আরও অনেক ভালো কিছু করতে পারতাম। কিন্তু এখন আর কোনো আক্ষেপ হয় না। নিজেকে সফল বলেই মনে হয়। তবে আমাকে অনেক পরিশ্রম করতে হয়।’

শিক্ষার্থীদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ভালো সংসদ সদস্য হতে হলে প্রথমে ভালো মানুষ হতে হবে। এলাকার মানুষ সম্পর্কে সরাসরি জানা থাকতে হবে। সংসদের নিয়মকানুন সম্পর্কে অবহিত হতে তবে। সাহসের সঙ্গে গুছিয়ে প্রশ্ন করার দক্ষতা অর্জন করতে হবে। প্রচুর পরিশ্রম করার শক্তি থাকতে হবে।’

উল্লেখ্য, সিমিন হোসেন রিমি গাজীপুর-৪ আসন থেকে তিন বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য এবং সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি। তিনি দুই পুত্র সন্তানের মা। তার স্বামী স্থপতি। বহু বছর ধরে তিনি পিতা তাজউদ্দীন আহমদের জীবন ও কর্মের ওপরে গবেষণা করছেন। তার লেখা ও সম্পাদিত একাধিক বই রয়েছে।

-এসএম