ডিজেলেই ঘাটতি দিনে ১০৭ কোটি টাকা

এস এম রাজিব
বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে দেশেও দাম বাড়ানোর কথা ভাবছে সরকার। আর ঘাটতি বহন করতে না পেরে ভর্তুকি চেয়েছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি)।

তবে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) গণশুনানি ছাড়া একতরফা ভাবে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি করলে সেটা আইনের বিপর্যয় হবে। এ জন্য ভোক্তাদের মতামতের প্রেক্ষিতে মূল্য নির্ধারণের দাবি জানিয়েছে কনজুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)।

এদিকে, আনুষ্ঠানিক ভাবে আবেদন না করলেও ঘাটতির বিষয়ে সরকারকে অবগত করেছে বিপিসি। তবে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর বিষয়ে এখনো কোন প্রস্তাব করেনি বলে জানিয়েছেন বিপিসি চেয়ারম্যান এ বি এম আজাদ রহমান।

বিপিসির তথ্যমতে, সর্বশেষ গত বছরের ০৩ নভেম্বর ডিজেল ও কেরোসিনের দাম লিটারে ১৫ টাকা বাড়ায় সরকার। বর্তমানে ডিজেল ও কেরোসিন ৮০ টাকা, পেট্রোল ৮৬ টাকা এবং অকটেন ৮৯ টাকা লিটারে বিক্রি হচ্ছে।

অন্যদিকে, সর্বশেষ ২০১৪ সালে জ্বালানী তেল বিক্রিতে ২৩ কোটি ২১ লাখ টাকার বেশি লোকসান গুনতে হয়েছিল রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান বিপিসিকে। এরপর থেকে বিপিসিকে আর লোকসান গুনতে হয়নি। যার কারণে পরের অর্থবছরে ভর্তুকি প্রবাহও বন্ধ হয়ে যায়। ওই বছর (২০১৫) বিপিসি মুনাফা করেছে চার হাজার ১২৬ কোটি টাকা। ২০১৬ সাল থেকে বিপিসি নিয়মিত ভাবে লাভ দেখতে শুরু করায় সরকারকে কোন ভর্তুকি প্রদান করতে হয়নি।

তবে ক্ষতির দাবি করে সাত বছর পর আবারও ভর্তুকি চেয়েছে সরকারের জ্বালানি তেল আমদানি ও সরবরাহকারী এ প্রতিষ্ঠানটি। এর পরিপ্রেক্ষিতে আগামী ০১ জুলাই থেকে বিপিসিকে ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সূত্র থেকে।

এ বিষয়ে গত সোমবার (২০ জুন) ক্যাবের উদ্যোগে ‘জ্বালানি তেলের মূল্য আবারও অবৈধ উপায়ে বৃদ্ধি না করার দাবি’ শীর্ষক ভার্চ্যুয়াল সংবাদ সম্মেলনে ক্যাবের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রফেসর ড. এম শামসুল আলম বলেছিলেন, ‘ব্যবসায়ীরা এলপিজির দাম একতরফা ভাবে বাড়াতো। কিন্তু আমরা হাইকোর্টের রায়ের মাধ্যমে সেটা বাতিল করেছি। এখন দাম বিইআরসির মাধ্যমে নির্ধারিত হয়।’

তিনি আরও বলেছিলেন, ‘এতো বড় একটা জলজ্যান্ত উদাহরণ থাকা সত্ত্বেও তারা (বিপিসি) বিইআরসির গণশুনানি বাদ দিয়ে অবৈধ ভাবে দাম চাপিয়ে দিচ্ছে। এটা বড় ধরনের আইনের বিপর্যয় এবং আইন থাকা সত্ত্বেও আইন না মানা একটি অসভ্য দৃষ্টান্ত বলতে হবে।’

এ বিষয়ে বিপিসির চেয়ারম্যান এ বি এম আজাদ রহমান ভোক্তাকণ্ঠকে বলেন, আবেদন বলতে যেটা বোঝায় আমরা অফিসিয়াল ভাবে সেটা করিনি। তবে নিয়ম অনুযায়ী আমরা সরকারকে আমাদের সর্বশেষ অবস্থান জানিয়েছি। কারণ এটাও তো সরকারি প্রতিষ্ঠান। তাই লিখিত আবেদনের কোন বিষয় নেই।

জুলাই থেকে বিপিসি দৈনিক বা মাসিক হিসাবে কি পরিমাণ ভর্তুকি পেতে পারে? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ভর্তুকি কথাটা এই মুহূর্তে বলতেই চাচ্ছি না। কারণ ভর্তুকি চাওয়ার জন্য একটা নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া রয়েছে। এটার অনেকগুলো আনুষ্ঠানিক বিষয় আছে। আসলে ভর্তুকির যে ব্যাপার আসবে- সে পর্যায়টা এখনো আসেনি। যে কারণে ওই ভাবে নির্দিষ্ট কোন সজ্ঞা বা বিষয় উল্লেখ করে কোন কিছু সরকারের কাছে বলা হয়নি। কারণ আমার কি পরিমাণ টাকা লাগতে পারে, কি পরিমাণ ব্যয় হয়, আগামীতে কি লাগতে পারে- এই ধরনের সকল সম্ভাবনাময় তথ্য আমি সরকারকে দিয়েছি।

গত ১৪ জুন বিদ্যুৎ ভবনের এক সেমিনারে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু বলেছিলেন, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিপিসি প্রতিদিন শত কোটি টাকা লোকসান দিচ্ছে। ধারাবাহিক ভর্তুকির চাপে জ্বালানির দর সমন্বয়ের (বাড়ানো) কথা ভাবছে সরকার। তবে এটা গ্রাহকের জন্য সহনীয় পর্যায়ে রাখার বিষয়টি আগে দেখা হবে।

এ বিষয়ে বিপিসি চেয়ারম্যান বলেন, এই বিষয়ে আমার কোন সংশ্লিষ্টতা নেই। কে কি করেছে তা আমি জানি না। আমি বিপিসির পক্ষ থেকে এখনো কোন প্রস্তাব দেইনি।

ক্যাব বলেছে বিইআরসির গণশুনানি ছাড়াই একতরফা ভাবে দাম বৃদ্ধি করতে যাচ্ছে, যা বেআইনি- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘ক্যাব তো আর সরকারি কোন প্রতিষ্ঠান নয়। তারা আমাদের বদনাম করলেও কিছু করার নেই। আবার প্রশংসা করলেও কিছু বলার নেই। আর যেহেতু দাম বাড়ানোর বিষয়ে আমরা কোন প্রস্তাব দেয়নি, তাহলে এ বিষয়ে কিছু বলারও নেই।

এই মুহুর্তে কি পরিমাণ অর্থ ঘাটতি হচ্ছে- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এটাতো প্রতিদিনই চেহারা বদলাচ্ছে, আমার তো আন্তর্জাতিক বাজারকে সামনে রেখে হিসাব করি। গতকালকের (২২ জুন) হিসাবে একদিনে শুধু ডিজেলেই ১০৭ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। এছাড়াও অকটেনে অন্তত ৪/৫ কোটি টাকা ঘাটতি রয়েছে। তবে অন্যান্য জ্বালানি তেলে সামান্য কিছু ঘাটতি থাকে, যে কারণে সেটা বলতে করতে চাই না।

বিপিসি বলছে, আন্তর্জাতিক বাজারের তেলের অস্থিরতার কারণে দেশে ডিজেল বিক্রিতে বিপিসির লিটারপ্রতি লোকসান যাচ্ছে ৪২-৪৫ টাকা। আর অকটেনে বর্তমানে লোকসান হচ্ছে লিটার প্রতি ৩২-৩৫ টাকা। এটির দাম আন্তর্জাতিক বাজার পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে উঠানামা করে।

তবে জেট ফুয়েলে কোন লোকসান নেই এই মুহূর্তে। জেট ফুয়েলের বর্তমান দর অভ্যন্তরীণ রুটে লিটার প্রতি ১১১ টাকা ও আন্তর্জাতিক রুটে ১ ডলার ৯ সেন্ট।

তবে বার বার জেট ফুয়েলের দাম বাড়ানো নিয়েও এভিয়েশন কোম্পানিগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রতিক্রিয়া। এমনকি এভাবে চলতে থাকলে দেশের বিমান পরিবহন সেবা হুমকির মুখে পড়বে বলেও জানান বিমান সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

বিপিসির তথ্যমতে, এ বছরের জানুয়ারিতে দেশে প্রতি লিটার ফুয়েলের দাম ছিল ৭৩ টাকা। কিন্তু ০৯ জানুয়ারি আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ার অজুহাতে ৮০ টাকা করা হয়। এরপর ধারাবাহিক ভাবে ০৮ মার্চ সাত টাকা বাড়িয়ে ৮৭ টাকা এবং ০৭ ফেব্রুয়ারি ১৩ টাকা বাড়িয়ে ১০০ টাকা, ১৫ মে আরও ছয় টাকা বাড়িয়ে ১০৬ টাকা এবং সর্বশেষ এ মাসের ১০ তারিখে ১১১ টাকা করা হয়।

উল্লেখ্য, দেশে সবচেয়ে বেশি পরিবহন জ্বালানি হিসেবে ডিজেল ব্যবহৃত হয়। প্রতিদিন ডিজেলের চাহিদা অন্তত পৌণে দুই কোটি লিটার। তাই ঘাটতি পোষাতে ডিজেলের দাম বাড়ালে বড় বিপদে পড়বে সাধারণ জনগণ। এছাড়াও বাস ভাড়া বেড়ে গেলে আবারও অরাজকতা সৃষ্টি হবে বলে আশঙ্কা করছেন যাত্রীরা।