মেহগিনির ছাল-বাকল-ফল দিয়ে তৈরী হচ্ছে প্রাকৃতিক বালাইনাশক

মেহগিনি গাছের ছাল-বাকল আর ফল দিয়ে তৈরী হচ্ছে কৃষিতে ব্যবহারের বালাইনাশক। সেটি ব্যবহারে সফলও হয়েছেন জেলার কিশোরগঞ্জ উপজেলার শতাধিক কৃষক। এসব কৃষকের দাবি রাসায়নিকের পরিবর্তে কৃষিতে জৈব ওই বালাইনাশক ব্যবহারে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের দিকে এগিয়ে যাবে দেশ।

কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মেহগনির ফল, বাকল ও পাতা দিয়ে ওই জৈব বালাইনাশক তৈরী করা হচ্ছে। সেটি প্রথমে সবজি চাষে ব্যবহার হলেও এবার ব্যবহার হয়েছে আমন ধান ক্ষেতে। নিয়মিত ব্যবহারের ফলে ক্ষেত রক্ষা পেয়েছে পাতা মোড়ানো, শীষ কাটা, লেদা পোকার আক্রমণ থেকে। জৈব ওই বালাই নাশক ব্যবহারে খাদ্যের গুণগত মান যেমন ভালো হচ্ছে, অন্যদিকে খরচও সাশ্রয় হচ্ছে।

জেলার কিশোরগঞ্জ উপজেলার পুটিমারী ইউনিয়নের কালিকাপুর গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে- কয়েকজন কৃষক তাদের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে মেহগনি ফল, বাকল ও পাতা দিয়ে জৈব বালাইনাশক তৈরীতে ব্যস্ত। ফল থেকে খসা ছড়িয়ে এবং ছাল-বাকল ও গাছের পাতাসহ একত্রে চুর্ণ করছিলেন তারা।
এসময় ওই গ্রামের কৃষক নাজমুল খান (২৫) বলেন, ‘গতবছর সবজি চাষে মেহগিনির ফল, পাতা আর ছাল বাকলের তৈরী বালাইনাশক ব্যবহার করে ভালো ফল পেয়েছি। এবার আমন ধানের আবাদেও ব্যবহার করছি।’

তিনি বলেন,‘জৈব ওই বালাইনাশক ব্যবহারে খরচ যেমন কমেছে, খাদ্যের গুনগত মানও ভালো থাকছে।’
একই গ্রামের কৃষক আব্দুল মান্নান (৫৫) বলেন,‘ গত জানুয়ারি মাসে ওই বালাইনাশক ব্যবহার করে করলা, ঝিঙ্গা, চিচিংগা, চালকুমড়া, শষা, তরমুজ, সিম, লাউ আবাদ করে ভালো ফল পেয়েছি। স্থানীয় বাজারে এসব সবজির চাহিদাও প্রচুর। এমন সফলতায় ওই বালাইনাশক তৈরী করে এবার চার বিঘা জমিতে আমন ধান ক্ষেতে ব্যবহার করছি। ধান বের হওয়া পর্যন্ত চার বার ব্যবহার করায় কোন পোকা-মাকড়ের আক্রম হয়নি।’
তিনি বলেন,‘বাজার থেকে বালাইনাশক কিনে এ পরিমাণ ক্ষেতে চার বার ব্যবহারে খরচ হতো অন্তত
৫ হাজার টাকা। সেখানে আমার সামান্য শ্রমে ওই পরিমাণ টাকা সাশ্রয় করা সম্ভব হয়েছে।’

অপর কৃষক আতাউর রহমান (৫০) বলেন,‘আমি এবছর চার বিঘা জমিতে আমন ধান আবাদ করেছি। ওই চার বিঘার মধ্যে দেড় বিঘায় আমি বাড়িতে তৈরী করা জৈব বালাইনাশক ছিটাচ্ছি, বাকি আড়াই বিঘা জমিতে বাজার থেকে কেনা রাসায়নিক বালাইনাশক ছিটাচ্ছি। কিন্তু বাড়ির তৈরী বালাইনশাকের ফলাফল ভালো পচ্ছি।’
জৈব ওই বালাইনাশকের উদ্ভাবক জেলার কিশোরগঞ্জ উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা তুষার কান্তি রায়। তিনি বলেন,‘দেশের জিডিপিতে কৃষির অবদান ১৩ দশমিক ৫১ শতাংশ। দেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ন হলেও নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্নতা অর্জণ করতে পারেনি। আগে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্নতা অর্জণ করা ছিল মূল লক্ষ্য। ওই স্বয়ংসম্পূর্নতা অর্জণের পর এখন নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। আগামী প্রজন্মকে একটি সুন্দর ও বাসযোগ্য পৃথিবী উপহার দেয়ার ক্ষেত্রে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের কোন বিকল্প নেই।’
জৈব ওই বালাইনাশক উদ্ভাবনের বিষয়ে বলেন, ‘দেশকে সেবা দানের লক্ষ্যে দুই বছর যাবৎ নিরাপদ সবজি উৎপাদনের বিভিন্ন কলাকৌশল সম্পর্কে গবেষণা শুরু করি। বিভিন্ন জার্নাল, বই, ওয়েবসাইট অনুসন্ধান করে মেহগনির ফল, বাকল ও পাতার ভেষজ গুণকে কাজে লাগিয়ে নিরাপদ ফসল উৎপাদনের কথা অবগত হয়ে এবছরের জানুয়ারি মাসে গোটা উপজেলার ২০০ জন কৃষকের সবজি প্লটে ওই জৈব বালাইনাশক ব্যবহার করে ভালো ফল পাই। এবার কালিকাপুর গ্রামে চারজন কৃষকের আমন ক্ষেতে পরীক্ষামূলক ব্যবহার করে ভালো ফল পাওয়া গেছে। এতে করে এলাকার অনেক কৃষক আগ্রহী হয়েছেন। আগামীতে এর বহুগুণ ব্যবহার বাড়ার আশা করছি।’
জৈব ওই বালাইনাশকের প্রস্তুতের বিষয়ে বলে,‘মেহগনির ফল, বাকল ও পাতার নির্জান দিয়ে দুইভাবে প্রস্তুত করা যায়।

প্রথমত চার কেজি মেহগনির হতে প্রাপ্ত ফল, এক কেজি পরিমান গাছের বাকল ও পাতা ভালো ভাবে গুড়া করে নিতে হবে। তারপর দুই লিটার পানিতে ওই গুড়া ঢেলে দিতে হবে। তাতে কয়েকটি রসুন কোয়ার গুড়াসহ মিশ্রিণ করে পাঁচ থেকে সাত দিন রেখে দিতে হবে। এরপর মিশ্রণটিকে ছাকনি দিয়ে ছেকে নিয়ে চার গুণ পানি এবং ২০ গ্রাম ডিটারজেন গুড়া মিশিয়ে ব্যবহার করতে হবে।’
দ্বিতীয়ত, তিন থেকে চার কেজি মেহগনির ফল হতে প্রাপ্ত বীজ, গাছের বাকল ও পাতা পাঁচ লিটার পানিতে মিশিয়ে তাতে ১০ গ্রাম তুতিয়া, ৫ গ্রাম সোহাগা ও কয়েকটি রসুন কোয়ার গুড়া মিশ্রণ করে আধা ঘণ্টা উচ্চ তাপে ফুটিয়ে নিতে হবে। এমনভাবে ফুটাতে হবে যাতে ৫ লিটার মিশ্রণ কমে গিয়ে অর্ধেকে পরিনত হয়। এরপর মিশ্রণটি ঠান্ডা করে নিতে হবে। এবার ছেকে নিয়ে ২০ গ্রাম ডিটারজেন গুড়া মিশিয়ে পাঁচ গুণ পরিমাণ পানি মিশিয়ে দুই থেকে তিন দিন পর ব্যবহার করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।
তিনি জানান, ধান ক্ষেতে সাত দিন পর পর তিন বার প্রয়োগ করলে ধানের মাজরা, পাতা মোড়া, শীষ কাটা লেদা পোকা দমন করা সম্ভব। এছাড়াও ফুলকপি, বাঁধাকপির লেদা পোকা, ভুট্টার লেদা পোকা, টমেটো, শিম ও বরবটির লেদা পোকা, উইপোকা, পিঁপড়া, মশা দমন করা সম্ভব। এই বালাইনাশক যে জমিতে ছিটানো হয়, সে জমিতে ইদুরের উপদ্রব কম হয়। বিভিন্ন গুদামজাত শস্যের বীজ সংরক্ষণের ক্ষেত্রেও এটি বেশ কার্যকর। বালাইনাশক প্রস্তুতের উচ্ছিষ্ট অংশ জমিতে সার হিসেবে ব্যবহার করা যায়। উক্ত সার মাটিতে প্রয়োগ করলে একদিকে যেমন মাটির স্বাস্থ্য ভালো থাকে অন্যদিকে বিভিন্ন মাটিবাহিত রোগ ও পোঁকার আক্রমণ কম হয়।

এ বিষয়ে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক মো. আবু বক্কর সিদ্দিক বলেন, ‘এটা আসলে গবেষণার ফল নয়। পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। কিশোরগঞ্জ উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা তুষার কান্তি রায় এটা উদ্ভাবন করেছেন। তাতে ভালো ফল পাওয়া যাচ্ছে।’

 

সূত্রঃ বাসস