দামে নাভিশ্বাস: প্রয়োজনের অর্ধেক ঔষধ কিনছেন রোগীরা

ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: কিডনি আর লিভারজনিত রোগে কয়েক বছর ধরে ভুগছেন খুলনা মহানগরীর টুটপাড়া ঘোষেরভিটা এলাকার তারা বিবি (৭০)। প্রতি মাসেই তাকে পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকার ঔষধ কিনতে হয়। একমাত্র উপার্জনক্ষম ছেলে ডিম বিক্রেতা রফিকুল ইসলাম যে আয় করেন তা দিয়েই চলে পাঁচ জনের সংসার।

কোন রকমে দিন চললেও ঔষধের দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে রফিকুলকে। দুই সন্তানের লেখাপড়া আর মায়ের ঔষধ কিনতে গিয়েই দেনায় পড়েছেন তিনি। দেনা শোধ করতে গিয়ে পরিশ্রম আরও বেশি করতে হচ্ছে তাকে।

শুধু রফিকুল নন, একই অবস্থা ওই এলাকার জাহানারা বেগমের। প্রতি মাসে আট হাজার টাকার বেশি ঔষধ প্রয়োজন তার। জীবনরক্ষাকারী ঔষধের দাম বেড়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন তিনিও। ভাত-কাপড় না কিনলেও নিয়মিত ঔষধ কিনতে হয় তাকে।

নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির পাশাপাশি ঔষধের দাম বেড়ে যাওয়ায় যেন মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোম্পানিগুলো মূল্যবৃদ্ধির পর অসাধু ব্যবসায়ীরাও সাপ্লাই কমের অজুহাতে হাতিয়ে নিচ্ছেন বাড়তি টাকা। তবে ঔষধের দাম বাড়লেও মুখ খুলতে চাইছেন না ব্যবসায়ীরা। বাড়তি দামের বিষয়ে কোন কথা জানতে চাওয়ার আগেই বলছেন, ‘ভাই এই বিষয়ে কোন কথা জানতে চাইবেন না।’

খুলনার খুচরা ব্যবসায়ীরা জানান, গত কয়েক মাসের মধ্যে প্রায় সব ধরনের ঔষধের দাম ২০ থেকে ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। বিশেষ করে প্যারাসিটামল গ্রুপের সবকিছুর দাম বাড়ানো হয়েছে। এই ঔষধটি এত বেশি চলে যে মাঝে মাঝে তা বাজারেও খুঁজে পাওয়া যায় না।

নগরীর ময়লাপোতা এলাকার খুচরা এক ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, দাম বাড়লেও কোন কিছু করার নেই রোগীদের। বেঁচে থাকতে হলে ঔষধ সেবন করতে হবে।

এই ব্যবসায়ী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বাজারে সবজির দাম বাড়লেও তা মেনে নিতে চায় না ক্রেতা। কিন্তু ঔষধের দাম বাড়লে কেউ কোন প্রতিবাদ করে না।

তিনি বলেন, সবজি বিক্রেতারা সারা দিনে এক প্রকার সবজিতে ১০০ টাকা লাভ করতে পারে। কিন্তু ঔষধ কোম্পানিগুলো মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেললেও তা কারও নজরে পড়ে না। তারা একটা ট্যাবলেটে মাত্র এক টাকা লাভ করলে দিনে হাজার কোটি টাকা তুলে নিতে পারে বাজার থেকে। কিন্তু টাকার পরিমাণ এক টাকা হওয়ায় তা সহজে কেউ অনুমান করতে পারে না।

ওই বিক্রেতা জানান, বাজারে নাপা ট্যাবলেট, এইস প্লাস ট্যাবলেট, নাপা সিরাপ, প্রেশারের ঔষধ, কাশির সিরাপ, ওরস্যালাইন, অ্যান্টিবায়োটিকসহ প্রায় সব ধরনের ঔষধের দাম বেড়েছে। কিছু দিন আগেও নাপা ট্যাবলেট প্রতি পাতা কিনেছেন আট টাকা, কিন্তু এখন কিনতে হচ্ছে ১২ টাকায়; নাপা সিরাপ ছিল ২০ টাকা, তা বেড়ে হয়েছে ৩৫ টাকা; ওরস্যালাইন দাম বেড়ে হয়েছে ছয় টাকা; টোফেন সিরাপ ৬০ টাকা থেকে হয়েছে ৭৫ টাকা; প্রেশারের যেকোনো ঔষধের দাম পাতাপ্রতি ১৫ থেকে ২০ টাকা পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। ঘুমের ট্যাবলেটের দাম প্রতিটিতে দুই টাকা, ব্যথা উপশমকারী মেমো ট্যাবলেটের দাম বাড়ানো হয়েছে তিন টাকা। এছাড়া যেকোনো ধরনের অ্যান্টিবায়োটিকের দাম প্রতিটিতে পাঁচ থেকে ১৫ টাকা পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।

নগরীর হেরাজ মার্কেটের একাধিক ব্যবসায়ী অভিযোগ করে বলেন, কোম্পানিগুলো যে দাম বাড়িয়েছে তার ওপর আরও একদফা বাড়িয়েছে পাইকারি বিক্রেতারা।

ঔষধের বাজার নিয়ন্ত্রণে কোন তদারকি না থাকার সুযোগে ফার্মেসি মালিকরা বেশি দাম নিচ্ছেন বলে অভিযোগ। এছাড়া উচ্চমূল্যের পাশাপাশি আছে ভেজাল ঔষধও। ঔষধের বাজার ঘিরে নৈরাজ্য থামানো যাচ্ছে না। এ অবস্থায় টাকা জোগাতে ব্যর্থ হয়ে অনেক রোগী কষ্ট আর দীর্ঘশ্বাস চেপে ফার্মেসির সামনে থেকে শূন্য হাতে ফিরছেন। কেউ কেউ সামান্য ঔষধ কিনলেও বাকিগুলো খাওয়া ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন।

খুলনার হেরাজ মার্কেটে ঔষধ কিনতে আসা ডুমুরিয়া উপজেলার বাঁদুড়গাছার শ্যামল মিত্র জানান, তার মা সাবিত্রী মিত্র (৭৮) দীর্ঘদিন ধরে নানা রোগে শয্যাশায়ী। প্রতি মাসেই তার জন্য সাত থেকে আট হাজার টাকার ঔষধ কিনতে হয়। প্রতি সপ্তাহে এই ঔষধগুলো খুলনার হেরাজ মার্কেটে কিনতে আসেন। শনিবার (২৫ ফেব্রুয়ারি) ঔষধ কিনতে এসে তাক বিপাকে পড়তে হয়েছে। হঠাৎ করে কয়েকটি ঔষধের দাম বেড়ে যাওয়ায় এক সপ্তাহের পরিবর্তে তাকে পাঁচদিনের ঔষধ নিতে হচ্ছে। একটা ইনহেলার রিফিলে একবারে ২০ টাকা বেড়েছে বলেও জানান তিনি।

নগরীর ইকবাল নগর এলাকার আবু হাসান (৬৩) জানান, তার ওপেন হার্ট সার্জারি করা। বয়স হওয়ায় এখন শরীরে নানা ব্যাধি বাসা বেঁধেছে। নিয়ম করে কিছু ঔষধ সেবন করতে হয়। দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন তিনি প্রয়োজনের অর্ধেক ঔষধ সেবন করেন। এতে আবার সমস্যাও হচ্ছে। কিন্তু কিছু করার নেই।

এ বিষয়ে কথা হয় জেলা ঔষধ তত্ত্বাবধায়ক অফিসের সহকারী পরিচালক রহমত উল্লাহ’র সঙ্গে। তিনি যশোরের সহকারী পরিচালক হলেও প্রেষণে খুলনায়ও অফিস করেন। বললেন, ঔষধের দাম বাড়লে সে বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে পারে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। কারণ দাম বাড়ানো হয় কোম্পানি থেকে। তা দেখার দায়িত্ব প্রধান কার্যালয়ের। আমাদের যে আদেশ দেওয়া হয় আমরা শুধু সেইটুকু পালন করতে পারি।

সৌজন্যে, জাগো নিউজ।