ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া

ভোক্তাকণ্ঠ রিপোর্ট: ‘স্যার ফজলে হাসান আবেদ আমাদের কাছে খুবই সম্মানের। আমাদের পরিচয় ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। নাম পরিবর্তন করা হলে আমাদের পরিচয় হারিয়ে যাবে। একইসঙ্গে আমার সনদেও সমস্যা হবে।’

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়ায় এসব কথা বলেন নাইমুর রহমান দীপ নামের বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সাবেক শিক্ষার্থী।

তিনি বলেন, ‘স্যারের নামে একটা স্বতন্ত্র রিসার্চ ইনস্টিটিউট বা পুরো একটা আইটি ইনস্টিটিউট বানিয়ে দিতে পারে। যা ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্ত থাকবে। এতে কারো কোনো সমস্যা হবে না।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন নাম হিসেবে ‘স্যার ফজলে হাসান আবেদ ইউনিভার্সিটি’ বা সংক্ষেপে ‘আবেদ ইউনিভার্সিটি’ দিতে চায় বিশ্ববিদ্যালয়টির বোর্ড অব ট্রাস্টিজ। ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত স্যার ফজলে হাসান আবেদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এই নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। নাম পরিবর্তনের বিষয়ে মতামত চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে (ইউজিসি) চিঠি দিয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ।

তবে নাম পরিবর্তনের এমন সিদ্ধান্তের খবরে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থীরা।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব ট্রাস্টিজ ও ইউজিসি চাইলে নাম পরিবর্তন করতে পারবেন বলে মনে করছেন শিক্ষাবিদরা।

জানা যায়, ২০১৯ সালের ৩১ অক্টোবর বোর্ড অব ট্রাস্টিজের ৩১তম সভায় বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করে ‘স্যার ফজলে হাসান আবেদ ইউনিভার্সিটি’ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তখন স্যার ফজলে হাসান আবেদ জীবিত ছিলেন। একই বছরের ২০ ডিসেম্বর তিনি মারা যান।

ওই সিদ্ধান্তের তিন বছর পর চলতি বছরের ২৮ মে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের অনুমতি নিয়ে নাম পরিবর্তনের আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া শুরু করে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন নাম হিসেবে স্যার ফজলে হাসান আবেদ ইউনিভার্সিটি বা সংক্ষেপে আবেদ ইউনিভার্সিটি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব ট্রাস্টিজ সূত্রে জানা গেছে, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর ও প্রেসিডেন্ট ভিনসেন্ট চ্যাং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির নাম পরিবর্তনের প্রস্তাব দেন। একাডেমিক কাউন্সিল এবং সিন্ডিকেট সদস্যরা ব্র্যাকের স্বপ্নদর্শী প্রতিষ্ঠাতার অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ইউনিভার্সিটির নাম পরিবর্তনের প্রস্তাবকে সমর্থন করেন।

বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সদস্য এ এম আর চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেন, ‘তার অনন্য অবদানের প্রতি সম্মান জানানোর জন্য এর চেয়ে ভালো উপায় আর হতে পারে না।’

এদিকে, নাম পরিবর্তনের বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মতামত চাওয়ার পর ইউজিসি আবেদনটি আইন সেলে পাঠিয়েছে। কিন্তু প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট-২০১০ শিক্ষামূলক কার্যক্রম চলমান থাকা অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করার অনুমতি দেওয়া হয়নি। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করতে কিছুটা সময় লাগতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

ইউজিসি সূত্র বলছে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুসারে শিক্ষা কার্যক্রম চলমান থাকা অবস্থায় কোনো প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি নাম পরিবর্তনের বিধান নেই। তাই এ বিষয়ে আইন শাখার মত চাওয়া হয়েছে। নাম পরিবর্তনের প্রক্রিয়াটি সময় সাপেক্ষ হতে পারে।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তনের বিষয়ে জানতে চাইলে ইউজিসি’র সাবেক চেয়ারম্যান এ কে আজাদ চৌধুরী বলেন, ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় চাইলে নাম পরিবর্তন করতে পারবে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়টির বোর্ড অব ট্রাস্টিজের অনুমতি লাগবে। একইসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনেরও (ইউজিসি) অনুমতি লাগবে। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তনের আবেদনের কথা শুনেছি। নাম পরিবর্তন সম্ভব।’

তিনি বলেন, ‘বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তনের নজির রয়েছে।’

নাম পরিবর্তনে শিক্ষার্থীদের কোনো সমস্যা হবে কি না জানতে চাইলে আজাদ চৌধুরী বলেন, ‘নাম পরিবর্তনে শিক্ষার্থীদের কোনো সমস্যা হবে না।’

যদিও নাম পরিবর্তনের এই উদ্যোগে বর্তমান ও প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের একটি অংশ উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তাদের শঙ্কা- নাম পরিবর্তন করা হলে তাদের সার্টিফিকেট নিয়ে কিছু জটিলতা তৈরি হতে পারে।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সাইন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী দেওয়ান মুশফিক বলেন, ‘ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় নামটি আমাদের আবেগের। এই নাম পরিবর্তনের কোনো যুক্তিই দেখি না। আমরা সাবেক শিক্ষার্থী হিসেবে আমাদের পরিচয় কি হবে? আজ থেকে ১০-২০ বছর পরে আমরা যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়েছি তার নামই হয়তো কেউ জানবে না। সাবেক শিক্ষার্থী হিসেবে আশা করছি এমন সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসবেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।’

ইংরেজী বিভাগের শিক্ষার্থী সালমান ফারসী বলেন, ‘৯৩-৯৫ শতাংশ শিক্ষার্থী এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। নিঃসন্দেহে ব্র‍্যাক অনেক বড় একটা ব্রান্ড। এটার নাম পরিবর্তন করে প্রতিষ্ঠাতার নাম দেওয়াটা কোনো ভাবেই মেনে নিতে পারছে না কেউ। স্যার ফজলে হাসান আবেদ যিনি ব্র‍্যাক প্রতিষ্ঠা করেছেন আমরা সবাই তাঁকে অনেক সম্মান করি। আমার বিশ্বাস ব্র‍্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের যারা অধ্যয়ন করছে প্রত্যেকে স্যারকে অনেক বেশি সম্মান করে। এমনকি সব শিক্ষকরা স্যারকে অনেক সম্মান করেন। কিন্তু স্যারকে সম্মান দেওয়ার জন্য একটা ইউনিভার্সিটির নাম পরিবর্তন করা খুবই অযাচিত, একটা সিদ্ধান্ত। রিপোর্টে বলা হয়েছে স্যার বেঁচে থাকা অবস্থায় ২০১৯ সালের ৩১ অক্টোবর এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তখন তাহলে পরিবর্তনের জন্য কেন ইউজিসিতে প্রস্তাব পাঠানো হলো না? কেনো তার তিন বছর পর হঠাৎ এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে?’

তিনি বলেন, ‘রেজিস্টার অফিস থেকে বলা হয়েছে নাম পরিবর্তন করলে পূর্বের সবার সার্টিফিকেট পরিবর্তন করে দেওয়া হবে এই সিদ্ধান্ত কি খুবই বাস্তব সম্মত? যারা পাস করে বের হয়েছেন প্রত্যেককে ডেকে এনে তাদের সার্টিফিকেট পরিবর্তন করা কি সম্ভব? যেখানে হয়তো বিদেশে তারা অনেক বড় প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন। তাদের সাটিফিকেট এক্সপায়ার্ড ব্যাপারটা খুবই হাস্যকর।

ব্র‍্যাক ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা জানায়, শুধুমাত্র বোর্ড অব ট্রাস্টিজ যা সিদ্ধান্ত নেবে তাই যদি হয়ে থাকে তাহলে নিশ্চয়ই তা ভালো কিছু হবে না। একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে তার সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়েছে কতটুকু? শিক্ষার্থী, শিক্ষক সবার মতামতের পরোয়াই করা হলো না। যেখানে ৯৩-৯৫ শতাংশ শিক্ষার্থী ও শিক্ষক এই অযাচিত সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।

আর যদি স্যারকে সম্মান দিতেই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করা হয় তাহলে ব্র‍্যাকের অন্যান্য প্রতিষ্ঠান যেমন ব্র‍্যাক ব্যাংকের নাম আবেদ ব্যাংক, বিকাশের নাম আবেদ ক্যাশ, আড়ং এর নাম আবেদ ডেইরি, ব্র‍্যাক এনজিও এর নাম আবেদ এনজিও করা হবে? যদি এগুলো না করা হয় তাহলে কেন শুধু ইউনিভার্সিটির নাম পরিবর্তন করা হবে সম্মান দেখাতে? সব ছাত্ররা এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। নাম পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে আন্দোলনের ডাক দেওয়া হবে। যার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।

নাম পরিবর্তনে যেসব সমস্যা হতে পারে
যারা এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে সনদ নিয়েছেন, নাম পরিবর্তন করা হলে তাদের পরিচয়গত সমস্যা হতে পারে। ভবিষ্যতে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো আইনগত বিষয় যেমন- শিক্ষক, শিক্ষার্থী, ট্রাস্টি বোর্ডের মধ্যে কোনো মামলা-মোকদ্দমা হলে নাম পরিবর্তনের কারণে আইনি জটিলতা তৈরি হতে পারে।

যারা এই বছর পাস করে বের হয়েছেন তারা হয়তো প্রথমেই চাকরির ইন্টারভিউ থেকে বাদ পড়বেন কারণ এখন আর কয়েক দিনের মধ্যে নাম পরিবর্তনের একটা মাঝামাঝি অবস্থায় থাকবে।

যারা বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য যাবেন তারা সবচেয়ে বড় হোঁচট খাবে কারণ তারা যখন বিদেশে কোনো ইউনিভার্সিটিতে যখন এপ্লাই করবে তখন তাদের সার্টিফিকেট অনুযায়ী ভেরিফিকেশনে বাংলাদেশে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির নাম খুঁজেই পাওয়া যাবে না। হয়তো শুধু এই কারণে অনেক অনেক শিক্ষার্থীর উচ্চশিক্ষা আটকে যাবে।

বিদেশে ব্র‍্যাক ইউনিভার্সিটির যে রেপুটেশন তা নাম পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে যে সবটাই মলিন হয়ে যাবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ব্র‍্যাকের ব্র‍্যান্ড দেখে, ব্র‍্যান্ড ব্যবহার করার জন্য এই ইউনিভার্সিটি বেছে নেয় অনেক শিক্ষার্থীরা।

তবে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির রেজিস্ট্রার ড. ডেভিড ডাউল্যান্ড শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে আশ্বস্ত করেছেন, নাম পরিবর্তনের ফলে কারও একাডেমিক সার্টিফিকেট, ডিগ্রি বা কনফার্মেশন লেটার হালনাগাদ করার প্রয়োজন হলে কর্তৃপক্ষ যথাযথ ব্যবস্থা নেবে।

এদিকে, স্যার ফজলে হাসান আবেদকে সম্মান প্রদর্শনের জন্য নাম পরিবর্তন না করে বিকল্প কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে বলে প্রস্তাবনা করেছে শিক্ষার্থীরা। সেগুলো হলো-

১. স্যার ফজলে হাসান আবেদ কে সম্মান দিতে আমাদের নতুন ক্যাম্পাসের কোনো একটা বিল্ডিং এর নাম ‘স্যার ফজলে হাসান আবেদ বিল্ডিং’ করা যেতে পারে (যেমন অন্য স্বনামধন্য কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠাতার নাম অনুসারে ভবনের নামকরণ করে প্রতিষ্ঠাতাকে সম্মান দেওয়া হয়েছে)।

২. নতুন ক্যাম্পাসের বড় একটা দেওয়াল বা অংশ জুড়ে স্যার ফজলে হাসান আবেদের মোরাল বানানো যেতে পারে।

৩. স্যারকে সম্মান দিতে প্রতি বছর একটা অংশ করে স্যারের জীবনীর উপর কিংবা স্যারের কর্মজীবনের উপর বই ছাপানো যেতে পারে এবং সেটা থেকে স্বেচ্ছায় মূল্যায়ন করা যেতে পারে।

২০০১ সালে যাত্রা শুরু করে ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটিতে প্রায় আট হাজার শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছে।

রাজধানীর বনানীতে বেসরকারি ‘রয়েল ইউনিভার্সিটি অব ঢাকা’র নাম বদলে ‘ডা. মমতাজ বেগম রয়েল ইউনিভার্সিটি অব ঢাকা’ করতেও আবেদন করা হয়েছিল। সিলেট মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করে ‘বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট’ নামকরণের প্রস্তাব করা হয়েছিল। এছাড়া ভারতের মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করে রাজা কৃষ্ণনাথ বিশ্ববিদ্যালয় করার প্রস্তাব করা হয়েছিল। তবে এখন পর্যন্ত এসব প্রস্তাব বাস্তবায়ন হয়নি।

-এসআর