বিদ্যুৎ-জ্বালানির চ্যালেঞ্জ নিয়ে শেষ ২০২২

ভোক্তাকণ্ঠ রিপোর্ট: অর্জন দিয়ে শুরু করে চ্যালেঞ্জ নিয়ে ২০২২ সাল শেষ করতে যাচ্ছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত। চলতি বছরের মার্চে শতভাগ বিদ্যুতের মাইলফলকে পৌঁছে যায় দেশ। এরপরই বৈশ্বিক যুদ্ধ পরিস্থিতি টালমাটাল করে তোলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত। ধাক্কা সামলাতে সাশ্রয়ী হওয়া, আইএমএফের প্রেসক্রিপশনে ভর্তুকির নীতি পরিবর্তন ও দাম বাড়িয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা শুরু হয়। তবে বছরের শেষান্তে এসে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে গ্যাসের উৎপাদন বৃদ্ধি, জ্বালানি তেলের নতুন বাজার অনুসন্ধান এবং বিদ্যুৎ খাত পরিকল্পনা সংশোধন করে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ঘুরে দাঁড়িয়েছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত। 

করোনার ধাক্কা সামলে নতুন উদ্যমে ২০২২ সালে পথচলা শুরু হয়েছিল বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের। বছরের শুরুতেই উৎপাদনে আসে দেশের সবচেয়ে বড় পায়রা কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র। দেশের দুর্গম ও প্রত্যন্ত এলাকায় সেবা পৌঁছে দিয়ে শতভাগ বিদ্যুতায়নও নিশ্চিত করেছিল সরকার।

কিন্তু চলতি বছরের জুনে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতি থমকে দেয় বিদ্যুতের অগ্রগতিকে। বিশ্ববাজারে তেলের দাম বাড়ার প্রভাব পড়ে বাংলাদেশেও। আমদানি কমানো, দাম বৃদ্ধি, রুটিন লোডশেডিং ও বিদ্যুৎ ব্যবহারে সাশ্রয়ের কৌশল অবলম্বন করে সরকার। এর ফলে জনজীবনে কিছুটা স্বস্তি ফিরে এলেও, নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস-বিদ্যুৎ না পাওয়ায় অস্বস্তি ছিল শিল্পখাতে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষমতা বাড়লেও বছরজুড়েই সমালোচনা ছিল সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থাপনা নিয়ে। এরই মধ্যে গ্রিড ফেইলর ছিল মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো।

পাওয়ারসেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, ২০২২ সালে সফলতার সঙ্গে আমরা লোডশেডিংমুক্ত বিদ্যুতায়ন নিশ্চিত করেছি। একই সঙ্গে আমরা এ বছর ডিজিটাল বাংলাদেশ পুরস্কারও অর্জন করেছি। তবে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সেই ধারাবাহিকতা আমরা ধরে রাখতে পারিনি। তাই জুলাইয়ে আমাদের ঘাটতি শুরু হয়। অক্টোবরে এসে গ্রিড ফেইল করায় আমরা বড় ধাক্কা খাই। তবে দ্রুতই সেটা থেকে উত্তরণ করতে পেরেছি। 

 তথ্য মতে, একাত্তরের মার্চে শুরু হলো বাঙালির স্বাধীনতা যুদ্ধ। ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত হলো বাংলাদেশ। ফলে ইতিহাসে এই সালে ঠিক কত পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ছিল, তার বিশ্বাসযোগ্য সঠিক হিসাব পাওয়া যায় না। বিদ্যুৎ বিভাগ জানায়, ১৯৭০ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা ছিল মাত্র ৪৭৫ মেগাওয়াট। ১৯৭২ সালে দেশে স্থাপিত বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ৫০০ মেগাওয়াট। তবে এই ক্ষমতার অর্ধেক বিদ্যুৎও উৎপাদন করা যেত না। এই সামান্য পরিমাণ বিদ্যুৎ নিয়েই বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশের যাত্রা শুরু। স্বাধীনতার ৫১ বছরে এসে এখন উৎপাদন ক্ষমতা ২৫ হাজার মেগাওয়াটেরও বেশি। বর্তমানে সক্ষমতা সংযোগ চাহিদার দ্বিগুণ।

 উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি বিদ্যুৎ হলেও এ খাতে বিনিয়োগ অত্যন্ত ব্যয়বহুল। স্বাধীনতার আগে থেকেই বিদ্যুৎ খাত ছিল সরকারনির্ভর। বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ ছিল না। ফলে বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়ন ছিল অত্যন্ত ঢিমেতালে। আশির দশকে এরশাদ সরকারের আমলে দুর্নীতি-অনিয়মের কারণে উন্নয়ন সহযোগীরা এ খাতে বিনিয়োগ থেকে বিরত থাকে। ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় এলে এ খাতে কমবেশি বিনিয়োগ শুরু হয়। কিন্তু বিদ্যুৎ উৎপাদন সময়সাপেক্ষ। ফলে রাতারাতি এ খাতে উল্লেখযোগ্য উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হয়নি। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিদ্যুৎ খাতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসে। এ সময় বিদ্যুৎ খাত বেসরকারি মালিকানার জন্য উন্মুক্ত করা হয়। আইপিপি অর্থাৎ ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার নীতিমালা করা হয়। এ সরকারের আমলেই দেশি-বিদেশি অনেক বিনিয়োগ হয় বিদ্যুৎ উৎপাদন খাতে। বেসরকারি খাত থেকেই ১২৯০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের চুক্তি করা হয়। বিদ্যুৎ খাতে এটি ছিল একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। এর পর ক্রমেই উৎপাদন বাড়তে থাকে। বর্তমানে বেসকারি খাতের বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা ৮৯। আর সরকারি খাতে কেন্দ্রের সংখ্যা ৫৪।

১৯৭৭ সালে গঠিত হয় আরইবি অর্থাৎ রুরাল ইলেকট্রিফিকেশন বোর্ড। উদ্দেশ্য ছিল দেশের গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ বিতরণ করা। এটি বিদ্যুৎ খাতে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। এ সংস্থার দায়িত্ব ছিল পল্লী অঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইন নির্মাণ করা। এ বিতরণ অবকাঠামো নির্মাণে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন করতে থাকে। কিন্তু উৎপাদন ঘাটতি থাকার কারণে গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ ছিল খুবই কম। পরবর্তী সময়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে পল্লী অঞ্চলে বিতরণ অবকাঠামোও দ্রুত বাড়তে থাকে। এখন সারা দেশের ৯৯ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় আছে। শুধু পাহাড়ি ও দুর্গম কিছু এলাকা ছাড়া সারা দেশেই পল্লী বিদ্যুতের লাইন আছে। বর্তমানে আরইবির গ্রাহকই ৩ কোটি ১১ লাখ। ৮০টি সমিতির মাধ্যমে সারা দেশের গ্রামাঞ্চলে এ বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে।

স্বাধীনতার পর গত ৩৮ বছরে যা হয়েছে; গত ১৩ বছরে বিদ্যুৎ খাতে তার চেয়ে অনেক গুণ উন্নতি হয়েছে। গত ১৩ বছরে এ খাতে যুগান্তকারী উন্নয়ন হয়েছে। সে ধারা এখনও চলমান। এই ১৩ বছরকে বিদ্যুৎ খাতের সোনালি অধ্যায় হিসেবে বর্ণনা করা হচ্ছে। জনগণের বিশাল ম্যান্ডেট নিয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট সরকারের যাত্রা শুরু হয় ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে। এর পর বিদ্যুৎ খাতের চেহারা দ্রুত পাল্টে যেতে থাকে। ২০০৯ সালের শুরুতে দেশে বিদ্যুৎকেন্দ্র ছিল মাত্র ২৭টি। বর্তমানে ১৪৪টি। ১২ বছরে বেড়েছে ১১৭টি। বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ছিল ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট। বর্তমানে উৎপাদন ক্ষমতা ২৪ হাজার ৯৮২ মেগাওয়াট। বেড়েছে ২০ হাজার মেগাওয়াটের বেশি। সঞ্চালন লাইন ছিল ৮ হাজার সার্কিট কিলোমিটার; বর্তমানে ১২ হাজার ৬৯২ কিলোমিটার। বেড়েছে ৪ হাজার ৬৯২ কিলোমিটার। গ্রিড উপকেন্দ্র ছিল ১৫ হাজার ৮৭০টি। বর্তমানে ৪৯ হাজার ৩৮৪টি। বেড়েছে ৩৩ হাজার ৫১৪টি। বিতরণ লাইন ছিল ২ লাখ ৬০ হাজার কিলোমিটার। বর্তমানে ৬ লাখ ৩ হাজার কিলোমিটার। বেড়েছে ৩ লাখ ৪৩ হাজার কিলোমিটার। বিদ্যুৎ গ্রাহক ছিল ১ কোটি ৮ লাখ। বর্তমানে ৩ কোটি ৯৬ লাখ। বেড়েছে ২ কোটি ৮৮ লাখ। সিস্টেম লস ছিল ১৪ দশমিক ৩৩ শতাংশ। বর্তমানে ৮ দশমিক ৭৩ শতাংশ। কমেছে ৫ দশমিক ৬০ শতাংশ।

 বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা ২৫ হাজার মেগাওয়াট হলেও এ অবধি সর্বোচ্চ উৎপাদন হয়েছে ১২ হাজার ৮৯৩ মেগাওয়াট। ব্যাখ্যা হলো-বিদ্যুৎ এমনই একটা পণ্য, এটা মজুদ করা যায় না। যখন যতটুকু উৎপাদন হয়, তখন ততটুকুই বিতরণ হয়ে যায়। সারা দেশে বর্তমানে যে সংযোগ আছে (আবাসিক, বাণিজ্য, শিল্প মিলিয়ে), সেখানে সংযোগ চাহিদা ওই ১২ হাজার ৮৯৩ মেগাওয়াট। অর্থাৎ বিদ্যুৎ সরবরাহ কাঠামো সর্বোচ্চ ওই পরিমাণ বিদ্যুৎ কোনো একদিন সরবরাহ করতে সক্ষম হয়েছে। যদিও বর্তমানে এর দ্বিগুণ পরিমাণ উৎপাদন করার সুযোগ আছে। বর্তমানে চাহিদা বাড়লেও তা পূরণ করা কোনো সমস্যা হবে না। কারণ ২৫ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদনের সক্ষমতা আছে। বিশ্লেষকরা জানান, উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে উৎপাদন ক্ষমতা সব সময় কিছুটা উদ্বৃত্ত রাখা হয়। কারণ যে কোনো সময় বিদ্যুৎকেন্দ্র একটি অচল হয়ে পড়তে পারে। তবে আমাদের দেশে চাহিদার চেয়ে অতিরিক্ত উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ। হাজার হাজার কোটি টাকার এই বিনিয়োগ অলস বসে থাকলে তার জন্য আর্থিক ক্ষতি হয়। চাহিদার সঙ্গে সমন্বয় করে উৎপাদন সঞ্চালন ও বিতরণ লাইন নির্মাণ হয়নি বলেই এ অবস্থা হয়েছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।

 বিদ্যুৎ উৎপাদনে এখন বহুমুখী জ্বালানির ব্যবহার নিশ্চিত করা হচ্ছে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও এ নীতি অনুসরণ করা হয়। কারণ বিশ্ববাজারে বিভিন্ন রকম জ্বালানির মূল্য ওঠানামা করে। আমাদের দেশে এক সময় অধিকাংশ বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি ছিল প্রাকৃতিক গ্যাস। এখন গ্যাসের পাশাপাশি কয়লা, ফার্নেস অয়েল, পারমাণবিক শক্তি, ডিজেল, পানি, সৌরশক্তি, বায়ু ইত্যাদির ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। ভবিষ্যতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে পরিবেশবান্ধব জ্বালানির কথা বিশেষ বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। এ জন্য সোলার বা সৌর, বায়ু, পানির ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।

তবে বিদ্যুৎ খাতের মাস্টারপ্ল্যানে ভিশন-২০৩০ তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, দেশের অভ্যন্তরীণ মুখ্য জ্বালানির উৎস তৈরি করতে হবে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ৫০ শতাংশ জ্বালানির চাহিদা মেটাতে হবে, যার ২৫ শতাংশ হবে কয়লা, ২০ শতাংশ হবে প্রাকৃতিক গ্যাস ও বাকি ৫ শতাংশ হাইড্রো ও নবায়নযোগ্য শক্তি।

এদিকে বিশ্ববাজারে তেল-গ্যাসের দামের অস্থিরতায় টনক নড়ে সরকারের। বছরের শেষ দিকে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে গ্যাসের উৎপাদন বাড়ানো, নতুন উৎস অনুসন্ধান ও দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে তেল-গ্যাস আমদানির পরিকল্পনা নেয় সরকার। তবে সমালোচনা আছে, এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন আইনের সংশোধন ও দাম সমন্বয়ের মাধ্যমে ভর্তুকি কমিয়ে আনার প্রক্রিয়া নিয়ে।

এ বিষয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, সততা ও নিষ্ঠার মাধ্যমে জ্বালানি খাতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। জ্বালানি খাতকে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের মধ্যে কাজ করতে হয়। সমন্বিত ও সম্মিলিত উদ্যোগে বিদ্যমান এবং আগত প্রতিকূলতা নিরসন করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।