ওষুধ বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়ছেন চিকিৎসকরা

শিমুল মাহমুদ: উপহারের লোভে রোগীর প্রেসক্রিপশনে মান বিবর্জিত অথবা প্রয়োজনের অতিরিক্ত কিছু ওষুধ লিখছেন চিকিৎসকরা। আর সেটির ছবি তুলে কোম্পানির কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠাচ্ছেন মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভরা (ওষুধ কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধি)।

কারণ এ তথ্যের ওপর নির্ভর করে ওষুধ কোম্পানিগুলোর উপহার পান তারা।

রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালের বহির্বিভাগ ঘুরে দেখে যায়, ওষুধ কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধিরা কোথাও কোন নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে যখন-তখন চিকিৎসকদের কক্ষে প্রবেশ করছেন। আবার রোগীরা চিকিৎসক দেখিয়ে বাইরে এলেই তাদের প্রেসক্রিপশন নিয়ে করছেন টানাহেঁচড়া।

ছবি তোলার কারণ জানতে চাইলে, কোন কথা না বলেই দ্রুত জায়গা ত্যাগ করেন এসব মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ।

চাকরি ঝুঁকির কারণে নাম না প্রকাশের শর্তে কথা বলতে সম্মত ওষুধ কোম্পানির একজন রিপ্রেজেন্টেটিভের কাছ থেকে জানাযায় নেপথ্যের কিছু তথ্য।

তিনি বলেন, ‘টাকা লেনদেনের মাধ্যমে চিকিৎসকদের সঙ্গে চুক্তি থাকে মাসিক নির্দিষ্ট সংখ্যক প্রেসক্রিপশন লেখার জন্য। একজন চিকিৎসক একাধিক কোম্পানির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হন। চিকিৎসকদের ম্যানেজ করতে প্রয়োজনীয় উপহার কোম্পানির পক্ষ থেকে সরবরাহ করা হয়। এরমধ্যে নগদ টাকার বাইরে সপরিবারে দেশে বিদেশে প্রমোদভ্রমণের ব্যবস্থা, এমনকি কোরবানির গরুর চাহিদা পর্যন্ত মেটাতে হয় কারো কারো। বিশেষ করে বড় কিছু ওষুধ কোম্পানি গাড়ি বাড়ি পর্যন্ত নিয়ে মাঠে নেমে এসব ক্ষেত্রে অন্যদের প্রতিযোগিতায় আসতে বাধ্য করেছে। আর এ কারণেই চিকিৎসকরা তাদের পছন্দের কোম্পানির ওষুধ লিখতে প্রভাবিত হন।’

প্রেসক্রিপশনের ছবি তোলায় ক্ষোভ প্রকাশ করে রোগী আরমান কায়সার বলেন, ‘আমি এ বিষয় কিছু জানি না। উনারা ডাক দিয়ে ছবি তুলতে চাইলে আমি দিয়ে দিয়েছি। এট বন্ধ করা উচিৎ।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বিক্রয় প্রতিনিধি বলেন, ‘প্রতি সপ্তাহে আমাদের একটা টার্গেট দেওয়া হয়। ওই টার্গেট অনুপাতে চিকিৎসকরা প্রেসক্রিপশন দিচ্ছেন কি না- তাও মনিটরিং করতে হয়। প্রতিষ্ঠানকে বিশ্বাস করানোর জন্য মোবাইলে প্রেসক্রিপশনের ছবি তুলে রাখতে হয় এবং রোগীর প্রেসক্রিপশন দেখতে হয়। আর এ জন্য আমাকে সকাল থেকে হাসপাতালে থাকতে হয়।’

এ বিষয়ে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হক বলেন, ‘হাসপাতালে মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ যারা আসে তাদের সময় এক ঘন্টা নির্ধারণ করে দিয়েছি। সেটা আবার হাসপাতালের বাইরে। কিন্তু কোন লাভ হয়নি। এখন আমরা একটা অ্যাপ তৈরি করেছি। ফল পাব বলে আশা করছি।’

শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. খলিলুর রহমান বলেন, ‘সকাল ৮ টা থেকে দুপুর একটা পর্যন্ত হাসপাতালে প্রবেশ নিষেধ করেছি, তারপরও উনারা (রিপ্রেজেন্টেটিভ) কথা শুনছেন না। শিগগিরই এ বিষয়ে মিটিং করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, ‘বাজারে নতুন ওষুধ এলে সেটির বিজ্ঞাপন পত্রিকা বা টেলিভিশনে দেওয়ার কোন সুযোগ নেই। তাই কোম্পানির প্রতিনিধিরা সরাসরি চিকিৎসকের কাছে যান। তবে নিয়মিত যাওয়ার কারণ ভিন্ন। যেটি সকলে জানে, বিশেষ করে চিকিৎসকদের মাসোয়ারা, ছেলে-মেয়ের লেখাপড়া, গাড়ি, বাড়ির সম্পর্ক জড়িত। এটি দেখার দায়িত্ব হলো ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের। একসময় জেনেরিক নামে প্রেস্ক্রিপশন লেখা বাধ্যতামূলক করার কথা উঠেছিল। বিভিন্ন অযুহাতে তা আর বাস্তবায়ন করেনি চিকিৎসকদের রেজিষ্ট্রেশন দাতা প্রতিষ্ঠান। মন্ত্রনালয়ের দায়িত্ব উভয় প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্ব্য় করে কিছু একটা ব্যবস্থা করার। সেটি কিন্তু করা হচ্ছেনা। তাদেরও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। কারন বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির মালিক এমপি-মন্ত্রীরা।’