করোনায় স্কুল ছেড়েছে ৩৫ শতাংশ শিক্ষার্থী

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

করোনা মহামারি সংকটে দীর্ঘসময় স্কুল বন্ধ থাকায় কিশোর-কিশোরীদের জীবনে বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তন এসেছে। ‘অ্যাডোলেসেন্ট গার্লস ভালনারাবিলিটিজ অ্যান্ড ট্রানজিশান ইন দ্য কনটেক্সট অফ কোভিড-১৯’ শীর্ষক এক গবেষণার ফলাফল উপস্থাপন অনুষ্ঠানে এমন তথ্য উঠে এসেছে।

দেশের পূর্বাঞ্চল, দক্ষিণ ও উত্তরাঞ্চলের তিন জেলা গাইবান্ধা (চরম দারিদ্র্যতার ভিত্তিতে), কুমিল্লা (অধিক পরিমাণে প্রবাসীর ভিত্তিতে) ও নড়াইলের (অধিক পরিমাণে বাল্য বিবাহের ভিত্তিতে) ২৬টি উপজেলার ২ হাজার ৭৫৮টি পরিবারের ৩ হাজার ১৩৯ জন কিশোর-কিশোরীর সাক্ষাৎকারভিত্তিক জরিপ করা হয়।

বুধবার (১ জুন) রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টার ইনে গবেষণার ফলাফল উপস্থাপন অনুষ্ঠানে এ বিষয়ে বিশদ তথ্য তুলে ধরেন বক্তারা। ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অফ গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট (বিআইজিডি) এবং জিআইজেডের রুল অব ল প্রোগ্রাম যৌথভাবে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। জার্মান ফেডারেল মিনিস্ট্রি ফর ইকোনমিক কো-অপারেশান অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিএমজেড) এবং ইউকে ফরেন, কমনওয়েলথ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফিসের (এফসিডিও) সহায়তায় গবেষণাটি পরিচালিত হয়েছে।

অনুষ্ঠানে জানানো হয়, করোনার কারণে শিক্ষাগ্রহণে আগ্রহ হারিয়ে ফেলা, মনো-সামাজিক টানাপোড়ন, সহিংসতার ঝুঁকি বৃদ্ধি, প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগেই কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ- এমন বিভিন্ন পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে কিশোর-কিশোরীদের। কোভিডের সময়ে শিক্ষার ব্যাপারে অভিভাবক ও কিশোর-কিশোরীদের নেওয়া সিদ্ধান্ত তাদের ভবিষ্যতের পথকে প্রভাবিত করবে। শুধু তাই নয়, তাদের জীবিকা ও প্রজনন স্বাস্থ্যও এর দ্বারা প্রভাবিত।

মিশ্র পদ্ধতির এই গবেষণাটি করা হয়েছিল ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বর পর্যন্ত। করোনার সংকট কিশোর-কিশোরীদের জীবনে কীভাবে পরিবর্তন এনেছে তা বিশ্লেষণ করা ও ন্যায়বিচার প্রাপ্তিতে এ দেশের নারী ও কিশোরীদের অবস্থা কেমন, বিশ্লেষণের মাধ্যমে তা জানা ছিল উক্ত গবেষণার লক্ষ্য।

গবেষণা বলছে, ৩৫ শতাংশ কিশোর-কিশোরী মহামারির আগে ৩-৫ ঘণ্টা পড়াশোনা করত। মহামারির সময়ে কিশোর-কিশোরীদের এই হার ১৪ শতাংশে নেমে গেছে। যদিও কোভিড-১৯ এর কারণে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার খুব একটা বেশি নয়। তবুও অন্তত ৩৫ শতাংশ ঝরে পড়া শিক্ষার্থী জানিয়েছে, কোভিড-১৯ এর কারণে তারা লেখাপড়া ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। অন্যদিকে ১৬ শতাংশ ঝরে পড়া কিশোর-কিশোরী জানিয়েছে, তারা পড়াশোনার খরচই আর চালাতে পারছে না। করোনার আগে ও পরে ৭.৫ শতাংশ কিশোর-কিশোরী বিভিন্ন কাজের সঙ্গে সংযুক্ত হয়েছে। এর মধ্যে ছেলে ১২ শতাংশ ও মেয়ে ৫ শতাংশ।

মহামারির আগে ও পরে বাল্যবিবাহের হারে সামান্য ব্যবধান হয়েছে বলেও গবেষণায় তথ্য পাওয়া গেছে। গবেষণায় অংশ নেওয়া প্রায় ৫০ শতাংশ মা-বাবা জানিয়েছেন, মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তের পেছনে কোভিড-১৯’র প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভূমিকা ছিল। মেয়েদের ও তাদের পরিবারের সম্মানকে সুরক্ষিত রাখতে দ্রুত বিয়ে দিতে হবে- কোভিডের সময়ে প্রতিনিয়ত এমন সামাজিক চাপের মুখে ছিল কিছু পরিবার। ফলে সেসব পরিবারের মা-বাবারা তাদের মেয়েদের বিয়ের বয়স হওয়ার আগেই বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

সমীক্ষা অনুসারে, বাল্যবিবাহ এবং স্কুল ছেড়ে দেওয়ার পেছনে দারিদ্র্যের চেয়ে নিরাপত্তা এবং পারিবারিক সম্মান হারানোর ঝুঁকি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। স্কুল বন্ধের প্রেক্ষাপটে ছেলেদের কাজে পাঠাতে অভিভাবকরা সিদ্ধান্ত নেন। সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে নিরাপত্তার বিবেচনা এবং কেবল দারিদ্র্যই গুরুত্বপূর্ণ ছিল না।

বিআইজিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ইমরান মতিন তার উদ্বোধনী বক্তব্যে বলেন, কোভিডের সময়ে কিশোর-কিশোরীদের ব্যাপারে খুব একটা গবেষণা ও নীতিনির্ধারণী আলোচনা হয়নি। অর্থনৈতিক কারণ ও স্কুল বন্ধ থাকা- এই দুইয়ে মিলে তাদের জন্য আগে থেকেই চলমান ঝুঁকি বৃদ্ধি করেছে এবং নতুন ঝুঁকির ক্ষেত্র তৈরি করেছে। অর্থনৈতিক সমস্যাকে পর্যালোচনা করা, শিক্ষার মানের ওপর গুরুত্বারোপ করা এবং সামাজিকীকরণের শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে স্কুলকে গড়ে তোলা হতে পারে আমাদের নীতিগত অগ্রাধিকার।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগের সচিব মো. গোলাম সারওয়ার বলেন, আমাদের নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে সমস্যা থেকে উত্তরণ এবং একইসাথে মানুষের সক্ষমতা ও সুস্থতাকে সামগ্রিকভাবে গুরুত্ব দিতে হবে। আরও স্থিতিস্থাপক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবস্থা প্রণয়নে সরকার, উন্নয়ন অংশীদার এবং সুশীল সমাজ একসঙ্গে কাজ করতে পারে। সেই ব্যবস্থাই আমাদের লিঙ্গ ও আর্থ-সামাজিক অবস্থা নির্বিশেষে ন্যায়বিচার প্রাপ্তিকে একটি মৌল মানবিক অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগের যুগ্ম সচিব (মতামত) এবং জিআইজেড প্রকল্পের জাতীয় প্রকল্প পরিচালক উম্মে কুলসুম বলেন, এটি খুব স্পষ্ট যে সরকার ৮ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় কোভিড-১৯ থেকে পুনরুদ্ধারের কৌশল এবং লৈঙ্গিক সমতা ও নারীর ক্ষমতায়ন কাঠামোকে চিহ্নিত করেছে। আলোচক-দর্শকদের মতামত এবং গবেষণা দলের কাছ থেকে গবেষণার মূল বিষয়বস্তু জানার পর আমি মনে করি, কোভিড থেকে উত্তরণের উপায় হিসেবে লৈঙ্গিক সমতা এবং নারী ক্ষমতায়ন কাঠামোকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া দরকার। এ গবেষণায় নারী ও কিশোরীদের যেসব সমস্যা উঠে এসেছে তা মোকাবিলায় এ কাঠামো বড় ভূমিকা রাখবে।

ব্রিটিশ হাইকমিশনের ডেপুটি হাইকমিশনার জাভেদ প্যাটেল বলেন, ইউকে ফরেন, কমনওয়েলথ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফিস (এফসিডিও) ও জার্মান ফেডারেল মিনিস্ট্রি ফর ইকোনমিক কো-অপারেশান অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিএমজেড) সহায়তায় বিআইজিডি যে গবেষণাটি করেছে তাতে বোঝা যায় মহামারি কীভাবে কিশোর-কিশোরীদের ওপর প্রভাব বিস্তার করেছে। কোভিড পরবর্তী সময়ে তাদের স্কুলে ফিরিয়ে নেওয়া একটি বড় চ্যালেঞ্জ হবে। বিশেষ করে কিশোরীদের শিক্ষায় ফিরিয়ে নেয়াটা হয়তো আরও অনিশ্চিত হবে।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক সীমা মুসলেম বলেন, করোনার অভিঘাতে সবচেয়ে বেশি কাজ হারিয়েছে নারী। লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাওয়া ও বাল্যবিবাহে আবদ্ধ হয়েছে কোভিডকালীন সময়ে। কেননা বাল্যবিবাহ মানবাধিকার লঙ্ঘন। নারীরা নানা ধরনের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। এসব কারণে সামাজিক সূচকে রাষ্ট্র পিছিয়ে যাচ্ছে।

তিনি বলেন, বাল্যবিবাহ বন্ধ ও প্রতিরোধ দুটি আলাদা বিষয়। এটি বন্ধের চেয়ে প্রতিরোধে নানা ধরনের কর্মপরিকল্পনা নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে জন্ম সনদ ডিজিটাল করতে হবে। কেননা এসব মিথ্যার কারণে বয়স বাড়ানো হয় বলে তিনি জানান। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণায়ের প্রতিটি জেলায় দায়িত্ব কর্মকর্তা থাকলেও তাদের কাজের কোনো মনিটরিং নেই।

তিনি আরও বলেন, ইউকে সরকার সম্প্রতি একটি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন কৌশল গ্রহণ করেছে। নারী ও কিশোরীরা তাদের সফলতার পথটি যাতে স্বাধীনভাবে বেছে নিতে পারে সে ব্যাপারে এ ধরনের গবেষণা অনেক সহায়তা করবে।

জার্মান দূতাবাসের উন্নয়ন সহযোগিতা বিভাগের উপপ্রধান ক্যারেন ব্লুম বলেন, এ বছর বাংলাদেশ-জার্মান অংশীদারিত্ব ৫০ বছরে পদার্পণ করল। আজকের গবেষণার মতো অন্যান্য গবেষণাগুলো উন্নয়ন অংশীদারিত্বের কেন্দ্রবিন্দু। উন্নয়ন উদ্যোগের মূল লক্ষ্য হচ্ছে প্রত্যেক মানুষের নিজস্ব সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেওয়ার জন্য সুযোগ তৈরি করা। এ গবেষণার মাধ্যমে আমরা জানতে পারি, কোভিডের কারণে কিশোর-কিশোরীদের সম্ভাবনা ও সুযোগ কীভাবে সীমাবদ্ধ হয়েছে।

জিআইজেডের কান্ট্রি ডিরেক্টর ড. অ্যাঙ্গেলিকা ফ্লেডারমান বলেন, কিশোর-কিশোরীদের ওপর করা গবেষণা আমাদের ভবিষ্যৎ গড়ায় একটি অন্যতম ভূমিকা পালন করে, যেহেতু বাংলাদেশের জনগণের ২১ শতাংশই তরুণ। অর্থাৎ, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ তরুণ জনগোষ্ঠীর হাতে। বাকিটা আমাদের দায়িত্ব। আমাদের সরকার আছে, এনজিও আছে। আমরা আসলে কি করতে পারে, সেটা ভাবতে হবে। শিশুদের জন্য সময়মত এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নিলে সেটা তাদের জীবন ও দেশের ভবিষ্যৎ গতিপথ নির্ধারণ করবে।