রাজধানীতে তীব্র গ্যাস সঙ্কট, এলপিজি বিক্রির কৌশল

ভোক্তাকণ্ঠ রিপোর্ট: রাজধানী সহ পাশ্ববর্তী অঞ্চলে প্রতিনিয়তই গ্যাসের সঙ্কট বাড়ছে। বাসাবাড়িতে দিনে থাকছে না গ্যাস। ভোরে-রাতে থাকলেও গ্যাসের চাপ থাকে কম। সিএনজি স্টেশনগুলোতেও কমেছে গ্যাসের চাপ। ফলে পরিবহন খাতও ভুগছে গ্যাসের সংকটে।

 এদিকে স্পর্ট মার্কেট থেকে এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) আমদানি বন্ধ থাকার  কারণে গ্যাসের চাপ কমেছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ তেল,গ্যাস,খনিজসম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা)। তবে বেসরকারি এলপিজি (তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস) ব্যবসাকে সুযোগ করে দিতেই এই সঙ্কট সৃষ্টি করা হয়েছে বলে দাবি করেছেন বিশেষজ্ঞরা। আর ভোক্তাদের স্বার্থে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহের আহবান জানিয়েছে কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)।

তিতাসের তথ্য মতে, ঢাকা ও ঢাকার আশপাশে গ্যাস সরবরাহ করে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান পেট্রোবাংলার নিয়ন্ত্রণাধীন তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন এন্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিঃ। এখন দিনে ১৮০ থেকে ১৯০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের চাহিদার বিপরীতে তিতাস পাচ্ছে ১৬০ কোটি ঘনফুটের মতো। ফলে তারা গ্রাহকদের প্রয়োজনীয় গ্যাস দিতে পারছে না।

রাজধানীর প্রায় সব এলাকাতেই গ্যাসের সংকট রয়েছে। এর মধ্যে মোহাম্মদপুর, মিরপুর, পাইকপাড়া, রামপুরা, যাত্রাবাড়ী, পুরান ঢাকা, কল্যাণপুর, পল্টন ও উত্তরা এলাকায় গ্যাস সংকট বেশী। 

এ বিষয়ে যাত্রাবাড়ী এলাকার বাসিন্দা জেসমিন বেগম ভোক্তাকণ্ঠকে বলেন, অনেকদিন ধরেই দিনের বেলায় গ্যাস থাকে না। খুব সকালে এবং রাতে গ্যাস পাওয়া গেলেও চাপ কম থাকে। গ্যাসের চাপ বেশি থাকলে রান্না করতে যেখানে ১ ঘন্টা লাগতো, সেখানে এখন অন্তত ৩ ঘন্টা সময় লাগে। 

একই দাবি করেন পল্টন এলাকার বাসিন্দা রুনা বেগম, তিনি বলেন সাধারণত পল্টন এলাকায় গ্যাসের সঙ্কট কম থাকে। কিন্তু এখন  দিনের বেলায় গ্যাস একদমই থাকে না। বিকল্প হিসেবে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) ব্যবহার করতে হয়। আবার এলপিজি সিলিন্ডারও কিনতে হচ্ছে সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দরে।

গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর বিভিন্ন যায়গায় অভিযান পরিচালনা করে জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তর। এসময় সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে এলপিজি বিক্রি করায় পাঁচ প্রতিষ্ঠানকে দুই লাখ ২০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। ১২ কেজির এলপিজি সিলিন্ডারের দাম ১২৩৫ টাকার পরিবর্তে ১৪৫০ টাকা নেওয়ার হয়েছিল বলে জানায় ভোক্তা অধিদপ্তর।

তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তিতাসের একজন কর্মকর্তা ভোক্তাকণ্ঠকে জানিয়েছেন, পেট্রোবাংলা থেকে তাদের যতটুকু গ্যাস দিচ্ছে, তারা সেটাই গ্রাহকদের দিচ্ছেন। তবে আবাসিক খাতে গ্যাস সরবরাহে অনিহা রয়েছে। আস্তে আস্তে বাসাবাড়িতে এলপি গ্যাসের ব্যবহার হয়ে যাবে। বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই এলপিজিতে গৃহস্থালি কাজ হয়। দেশেও এলপিজির ব্যবহার বাড়ানো হবে।  

তথ্য মতে, রাজধানী ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, ময়মনসিংহ, নরসিংদী, গাজীপুর, মানিকগঞ্জ, টাঙ্গাইল, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, শেরপুর ও জামালপুরে গ্যাস সরবরাহ করছে তিতাস । আবাসিক গ্রাহক রয়েছে ২৮ লাখ ৭৪ হাজার ৮৪৮ জন, বাণিজ্যিক গ্রাহক সংখ্যা ১২ হাজার ৭৫টি, সিএনজি ৩৯৬টি, ক্যাপটিভ পাওয়ার ১ হাজার ৭০১টি, শিল্পগ্রাহক রয়েছে ৫ হাজার ৩১৩ এবং ৩টি সার কারখানা ও ৪৬টি বিদ্যুৎকেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ করছে রাষ্ট্রীয় এ কোম্পানিটি।

মতিঝিল এলাকার নাভানা সিএনজি স্টেশন থেকে ভোক্তাকণ্ঠকে জানানো হয়, সিএনজি স্টেশন গুলোতে অনেক দিন ধরেই গ্যাসের চাপ কম। বিশেষ করে দিনের বেলায় একদমই থাকে না গ্যাস। ফলে অনেকেই গ্যাস নিতে এসে ফেরত যায়।

ঢাকার সিএনজি চালক ইউনিয়নের নেতা মোঃ মনির হোসেন ভোক্তাকণ্ঠকে বলেন, গ্যাসের দাম বেড়েছে। আমাদের মিটারে এখনো ভাড়া বাড়ে নাই। আবার সবসময় গ্যাস পাওয়া যায় না।  স্টেশনে গিয়ে সিরিয়ালে পড়ে থাকা লাগে। যার কারণে ঠিক মতো ভাড়াও মারতে পারছি না।  

তথ্য মতে, দেশে দিনে মোট ৩৮০ কোটি ঘনফুট চাহিদার বিপরীতে পেট্রোবাংলা সরবরাহ করতে পারত ৩০০ কোটি ঘনফুটের মতো। এখন পারছে ২৭৫ থেকে ২৮০ কোটি ঘনফুট। কারণ, চড়া দামের কারণে বৈশ্বিক খোলাবাজার থেকে এলএনজি কেনা বন্ধ রয়েছে গত আড়াই মাস ধরে।

অন্য সময় বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাস সরবরাহ কমিয়ে সিএনজি বা অন্য সেক্টর দেওয়া হতো। কিন্তু এখন সেই সুযোগটিও নেই। কারণ, বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিকল্প জ্বালানি ফার্নেস অয়েল ও ডিজেলের দাম বেড়ে গেছে। ফলে গ্যাস দিয়েই বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হচ্ছে সরকারের। 

তবে তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির নেতা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনু মোহাম্মদ ভোক্তাকণ্ঠকে বলেন, দেশে বেসরকারি কোম্পানির এলপিজির ব্যবসার সুযোগ করে দিতেই সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা  কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করেছে। এখানে স্পট মার্কেটে গ্যাসের দাম বেশি হওয়ার দায় দিয়ে আমদানি বন্ধ রেখে গ্যাস সরবরাহ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু  সেই গ্যাসের চাহিদা পূরণ করার জন্য গ্রাহকদের বাধ্য হয়ে বোতলের গ্যাস কিনতে হচ্ছে। এতে ক্ষতি হচ্ছে গ্রাহকের, আর লাভবান হচ্ছে ব্যবসায়ীরা।

অন্যদিকে ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন ক্যাবের  সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ও জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম সহ একাধিক সদস্যের মতে, সরকার ভোক্তা অধিকার লুন্ঠন করে সবসময় ব্যবসায়ীদের স্বার্থ দেখছে। সকল ক্ষেত্রেই ব্যবসায়ীদের প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। গ্যাসের দাম বিইআরসি নির্ধারন করে দিলেও ব্যবসায়ীরা ইচ্ছামত দাম বাড়িয়ে বিক্রি করছে। গ্যাস সংকটে ভোক্তারা ভুগছে, কিন্তু সরকারের জ্বালানি বিভাগের কার্যকর কোন ব্যবস্থা নজরে পড়ছে না।

এবিষয়ে পেট্রোবাংলার মহাব্যবস্থাক (উৎপাদন ও বন্টন) মোঃ আনোয়ারুল ইসলাম ভোক্তাকণ্ঠকে বলেন, আন্তর্জাতিক বাজার থেকে (স্পর্ট মার্কেট) বর্তমানে এলএনজি আমদানি বন্ধ থাকায় দেশে গ্যাসের ঘাটতি পড়েছে। আর সেই ঘাটতির জন্য সরবরাহ কমেছে। তবে অর্ন্তরীণ উৎস থেকে উৎপাদন বাড়াতে চেষ্টা চলছে। খুব শীঘ্রই গ্যাসের এই সঙ্কট দূর হয়ে যাবে। 

জানা গেছে, বর্তমান সরকার ২০০৯ সালে দায়িত্ব নেয়ার পরপরই আবাসিক গ্যাস সংযোগ বন্ধ করে দেয়। এরপর ২০১২ সালে আবার সংযোগ চালু হলেও ২০১৩ সালের শুরুতেই তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। যার ফলে দেশে বেড়েছে এলপিজির ব্যবহার, সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে গ্যাসের অবৈধ সংযোগ।

দেশে এলপিজি ব্যবসার সুযোগ দিতে এই সঙ্কট কিনা- এমন প্রশ্নে আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, এটা আমার জানা নেই। তবে এই অভিযোগ সঠিক নয়। (লোডশেডিং কমানোর জন্য) বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাস সরবরাহ বাড়ানো হয়েছে। তবে গ্যাসে স্বয়ংসম্পূর্ন হওয়ার লক্ষে সরকার ২০২৫ সালের পরিকল্পনা নিয়েছে এবং আমরা সেই লক্ষ্যেই কাজ করছি।

দেশে এলএনজি আমদানি করে পেট্রোবাংলার নিয়ন্ত্রণাধীন কোম্পানি আরপিজিসিএল (রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিঃ)। গণমাধ্যম সূত্র বলছে, দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় ওমান ও কাতার থেকে প্রতি মাসে পাঁচটি করে এলএনজি কার্গো (জাহাজ) আনা হচ্ছে। এতে প্রতি ইউনিট এলএনজির দাম পড়ছে এখন প্রায় ১৫ মার্কিন ডলার। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর আগে এই দর ছিল ১০ ডলারের কম। এখন বিশ্ববাজারে (স্পর্ট মার্কেট) প্রতি ইউনিট এলএনজির দাম ৬০ ডলারের বেশি। গত জুনেও তা ৩৬ ডলারে ছিল। গত বছর নেমেছিল ৪ ডলারে। তাই খোলা বাজারে এলএনজির দাম না কমা পর্যন্ত আমদানি বন্ধ রাখার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়।