বোতলজাত পানিও ছোঁয়া নিষেধ!

ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: সরকারি চাকরি থেকে সদ্য অবসরপ্রাপ্ত খোরশেদ আলম কিছুদিন ধরে যকৃতের সমস্যায় ভুগছেন। চিকিৎসক তাকে পরামর্শ দিয়েছেন বোতলজাত মিনারেল পানি পান করতে। কয়েক মাস ধরে বোতলজাত পানি পান করছেন তিনি। কিন্তু হঠাৎ করে পানির দাম বেড়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন খোরশেদ আলম।

তিনি বলেন, বোতলজাত পানির দাম বেড়েই চলেছে, এটি কেউ দেখছেন না। যাদের নিয়মিত পানি কিনে পান করতে হয় দাম বাড়ার কারণে তাদের কষ্ট বেড়ে গেছে। আধা লিটারের বোতলজাত পানি ১৫ থেকে ২০ টাকা হয়েছে। বড় বোতলের দামও বেড়েছে। অবস্থা এমন হয়েছে যে বাজারে অন্য সব পণ্যের মতো পানির বাজারেও আগুন জ্বলছে। কিন্তু কেউই ব্যবস্থা নিচ্ছে না।

দেশে বেশকিছু কোম্পানি বোতলজাত পানি বিক্রি করছে। সব কোম্পানি আধা লিটার পানির দাম ১৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ২০ টাকা নির্ধারণ করেছে। এছাড়া এক লিটার, দেড় লিটার, দুই লিটার ও পাঁচ লিটারের বোতলজাত পানির দামও বাড়ানো হয়েছে।

বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বর্তমানে বাজারে দুটি কোম্পানির পানি ছাড়া সব কোম্পানির আধা লিটারের পানির বোতল বিক্রি হচ্ছে ২০ টাকায়। এক লিটার বোতলের আগের দাম ছিল ২০ টাকা, এখন তা বিক্রি হচ্ছে ২৫ টাকায়। আগে দুই লিটারের এক বোতল পানি বিক্রি হতো ৩০ টাকায়, প্রথম দফায় পাঁচ টাকা দাম বাড়িয়ে তা ৩৫ টাকা করা হয়। দ্বিতীয় দফায় দাম বাড়িয়ে বর্তমানে তা ৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। একইভাবে পাঁচ লিটারের পানির বোতল ৭৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৮০ টাকা করা হয়েছে।

দেশের বাজারে বোতলজাত পানি বিক্রি শুরু হয় ৯০-এর দশকে। তখন অভিজাত শ্রেণির মানুষ এ পানি পান করতেন। বর্তমানে সরকারি-বেসরকারি অফিসে, হোটেল-রেস্টুরেন্টে; যে কোনো অনুষ্ঠানে, ভ্রমণে, এমনকি চায়ের দোকানেও ক্রেতারা বোতলজাত পানি কিনে পান করেন।

যে কারণে দেশে কোকাকোলার কিনলে, মেঘনা গ্রুপের ফ্রেশ, পারটেক্সের মাম, পেপসিকোর অ্যাকুয়াফিনা, আকিজের স্পা, সিটি গ্রুপের জীবন, প্রাণ গ্রুপের প্রাণ ড্রিংকিং ওয়াটারসহ দেশি-বিদেশি প্রায় ৩০টি কোম্পানির বোতলজাত পানি বাজারে বিক্রি হচ্ছে। এসব কোম্পানির পানি যেমন সুপারশপ ও বড় বড় হোটেল-রেস্টুরেন্টে পাওয়া যায়, তেমনি পাড়া-মহল্লার মুদির দোকান, চায়ের দোকান, ফুটপাতেও পাওয়া যায়। এর মধ্যে প্রাণ ও সিটি গ্রুপের বোতলজাত পানি এখনও আগের দামে বিক্রি হচ্ছে।

শরীর সুস্থ রাখতে বিশুদ্ধ পানির বিকল্প নেই। ব্যস্ততার কারণে নগর জীবনে পানির চাহিদা পূরণে বাইরে বের হলে অনেকেই বোতলজাত পানি পান করেন। যে কারণে ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা বেড়ে যায় বোতলজাত পানির। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে এবং উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ার অজুহাত দেখিয়ে প্রথমে দু-একটি কোম্পানি বোতলজাত পানির দাম বাড়িয়ে দেয়। পরে প্রায় সব কোম্পানি তাদের পানির দাম বাড়িয়ে দিয়েছে।

বাজারে আধা লিটারের বোতলজাত পানির চাহিদা সবচেয়ে বেশি। কয়েক মাস আগে আধা লিটারের এক বোতল পানির দাম ছিল ১৫ টাকা, এখন সেটা ২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। পাশাপাশি এক লিটার, দেড় লিটার, দুই লিটার, পাঁচ লিটারের পানির বোতলের দাম বেড়েছে পাঁচ টাকা করে।

রাজধানীর বেসরকারি এক প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন প্রকৌশলী নূরুন নাহীদ। বলেন, এক লাফে প্রতি বোতল পানির দাম পাঁচ টাকা বাড়িয়ে দেওয়া অযৌক্তিক। এটি স্বেচ্ছাচারী সিদ্ধান্ত ছাড়া আর কিছুই নয়। ঢাকা শহরে লাইনের পানি সরাসরি মানুষ খেতে পারে না। রোগব্যাধি থেকে বাঁচতে বাইরে বের হলে বোতলজাত পানি পান করি। কিন্তু গত কয়েক মাসে সব ধরনের বোতলজাত পানির দাম বাড়িয়ে দিয়েছে কোম্পানিগুলো। প্রতি বোতলে একবারে পাঁচ টাকা বাড়িয়ে দেওয়া আমাদের উপর জুলুম করা ছাড়া আর কিছুই নয়।

গুলশান ফুটপাতের চায়ের দোকান থেকে আধা লিটার বোতলের পানি কেনা সাজ্জাদ হোসেন বলেন, হঠাৎ পানির দাম পাঁচ টাকা বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। আমরা কিছুই বলতে পারছি না। কোম্পানি বাড়িয়ে দিল, আর আমরাও কিনে পান করতে বাধ্য হচ্ছি। অভিযোগ জানানোর মতো, প্রতিবাদ করার মতো কোনো জায়গা আমাদের নেই।

রাজধানীর শান্তিনগর এলাকায় মুদি দোকান মালিক সুমন আহমেদ বলেন, প্রথমে দুটি কোম্পানি তাদের পানির দাম বাড়িয়ে দেয়। তাদের দেখে এখন সব কোম্পানি পানির দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে ক্রেতাপর্যায়ে বোতলজাত পানির দাম গড়ে পাঁচ টাকা বেড়েছে। ক্রেতারা পানির বোতল কেনার পর প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন। বলছেন, একবারে পাঁচ টাকা বাড়িয়ে দিলেন? কিন্তু আমাদের তো করার কিছু নেই। কোম্পানি বাড়িয়েছে, আমরা কী করতে পারি? অনেকে পানি কেনা কমিয়ে দিয়েছেন। তাই বোতলজাত পানির বিক্রিও কমেছে।

মাম পানির বিক্রয় ও বাজারজাতকরণের দায়িত্বে থাকা এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বোতলজাত পানির উৎপাদন খরচ বেড়েছে। যে কারণে ক্রেতাপর্যায়ে পানির দাম বাড়াতে হয়েছে। আমাদের ট্যাক্স বেড়েছে; গ্যাস, বিদ্যুৎ ও প্লাস্টিকের দামও বেড়েছে। তাই কোম্পানি পানির দাম বাড়াতে বাধ্য হয়েছে। ব্যবসা পরিচালনা করতে দাম না বাড়িয়ে কোনো উপায় ছিল না।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ সাধারণ নাগরিক সমাজের আহ্বায়ক মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, বোতলজাত মিনারেল ওয়াটারের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। এসব পানীয়র মূল্য কারা নির্ধারণ করে? আমরা জানতে চাই। কোনো কারণ দর্শানো ছাড়া, জবাবদিহিতা না রেখে ইচ্ছা মতো কোম্পানিগুলো দাম বৃদ্ধি করছে! ভোক্তার পকেট থেকে অযৌক্তিকভাবে তারা কোটি কোটি টাকা কেটে নিচ্ছে। আমরা এর মূল্য যৌক্তিক পর্যায়ে নির্ধারণের দাবি জানাচ্ছি।

পানির দাম বাড়ানোর সমালোচনা করে কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি ও জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, পানির দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আমরা মামলা করেছি। আইনের বিষয় মাথায় রেখে সাধারণ ক্রেতাদের সঙ্গে গণশুনানি করে পানির দাম বাড়াতে হবে। এটি ন্যায্য ও যৌক্তিক হচ্ছে কি না, তাও বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে। সরকারি প্রতিযোগিতা কমিশনের আইনে যেটি বলা আছে, প্রতিযোগিতা রক্ষা করার জন্য অনুমতি-সাপেক্ষে দাম বাড়াবে কোম্পানিগুলো। কিন্তু প্রতিযোগিতা কমিশনের মনিটরিং না থাকায় কোম্পানিগুলো হুট করে পানির দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। এখন এমন অবস্থা হয়েছে যে ব্যবসায়ীরাই নিজেদের মতো করে তাদের পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করছেন।

বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের চেয়ারম্যান প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী বলেন, পানির দাম হঠাৎ বাড়িয়েছে কোম্পানিগুলো। এটি আমাদেরও নজরে এসেছে। কিছু মার্কেট যাচাই করে তথ্য সংগ্রহ করছি। কত দাম ছিল, এখন সেই পানির বোতলের দাম কত, কারা কমিশন নেয়- বিষয়গুলো তদন্ত করে আমরা ভোক্তা অধিদপ্তরে চিঠি দিয়েছি। দাম অযৌক্তিক হলে কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সৌজন্যে, ঢাকা পোস্ট।