যে কারণে কমে না দ্রব্যমূল্য

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা: গত ২৮ ফেব্রুয়ারি সংসদে প্রশ্নোত্তর পর্বে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ইচ্ছাকৃত ভাবে নিত্যপণ্যের দাম কেউ বেশি নিলে তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ঠিক একইদিনে রমজানে নিত্যপণ্যের উৎপাদন, আমদানি, মজুত, সরবরাহ ও মূল্য পরিস্থিতি নিয়ে এক মতবিনিময় সভায় দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন (এফবিসিসিআই) নানা পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে।

রমজান মাসে নিত্যপণ্যের দামে লাগাম টানা সম্ভব হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী। আর এফবিসিআই সভাপতি বলছেন, অতি মুনাফা ও মজুতদারি থেকে বেরিয়ে আসতে ব্যবসায়ীদের মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে।

খুবই ইতিবাচক কথা দুই দিক থেকে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, রমজান মাস শুরুর আগেই আরেক দফা বেড়েছে বেশকিছু নিত্যপণ্যের দাম এবং কার্যত বাজারে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ দৃশ্যমান নয়।

সত্যি কথা বলতে কি, প্রায় তিন বছর ধরে লাগামহীন ভাবে বাড়ছে দ্রব্যমূল্য। দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধিতে সাধারণ মানুষ একেবারে দিশেহারা হয়ে পড়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম এমন অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে যে সাধারণ মানুষ এখন হতাশায় ভুগছে। সরকারের কোনো কথাতেই তারা আশ্বস্ত হতে পারছে না।

অতি সামান্য কিছু সচ্ছল ও অবস্থা সম্পন্ন মানুষ ছাড়া নিম্ন আয়ের মানুষ থেকে শুরু করে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষের জীবনযাত্রা দিন দিন দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। তাদের কাছে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি কেনাকাটা করা আতঙ্কের নাম। ০৭ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে শাসক দল আওয়ামী লীগ যে নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেছিল, সেখানে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণকে একটি বড় প্রতিশ্রুতির জায়গায় রেখেছিল।

নির্বাচনের পর নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করেও এই কাজকে অগ্রাধিকার হিসেবে দেখছে বলে আমাদের জানিয়েছিল সরকার। নিয়মিত ব্রিফিং-এ আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকও কয়েক দফায় বলেছেন যে, বিএনপি নয়, তাদের ভাবনা দ্রব্যমূল্য।

এই পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বাজারে ভোক্তা অধিকারকে কিছুটা সক্রিয় হতে দেখেছি, চালের মোকামে স্বয়ং খাদ্যমন্ত্রীকেই অভিযান পরিচালনা করতে দেখেছি। কিন্তু বাস্তবতা হলো দাম কমছে না, মানুষের কষ্ট কেবল বাড়ছেই। কোভিড-পরবর্তী পরিস্থিতিতে বহু মানুষেরই হয় চাকরি নেই, অথবা কর্মক্ষেত্রে কাজের সংকোচন ঘটেছে। ফলে উপার্জন প্রায় তলানিতে এসে ঠেকেছে।

সেইখান থেকে উত্তরণ ঘটার আগেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ আরেক দফা অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছে। তবে বাংলাদেশে দ্রব্যমূল্য বাড়ার পুরো কারণটাই কোভিড আর ইউক্রেন যুদ্ধের ওপর ছেড়ে দিলে অবিবেচনার কাজ হবে।

কারণ আমরা দেখেছি মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির জন্য সরকার যখন আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধিকে দায়ী করছে, তখন আশ্চর্যজনক ভাবে বিশ্ববাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কমলেও এর প্রভাব বাংলাদেশের বাজারে পড়ছে না। মূল্যস্ফীতি বাড়ার ক্ষেত্রে অনেক সম্ভাব্য কারণ আছে।

এফবিসিসিআই, এই মূল্যবৃদ্ধির জন্য চারটি কারণ চিহ্নিত করে। তা হলো ডলার- সংকট ও এর বাড়তি দাম, চাঁদাবাজি, সিন্ডিকেট এবং উচ্চ শুল্ক। কিন্তু একটি বড় কারণের কথা কেউ বলছে না। সরকারও না, ব্যবসায়ীরাও না।

বর্তমানে জ্বালানি তেলের দাম আকাশ ছুঁয়েছে, যার প্রত্যক্ষ প্রভাব এসে পড়ছে বাজারে। বিশ্ববাজারে কমলেও সরকার কমায়নি। অন্যদিকে সরকার নিয়মিতভাবে বাড়িয়ে চলেছে বিদ্যুতের দাম। ফেব্রুয়ারি থেকে বিদ্যুতের নতুন বাড়তি দাম কার্যকর করছে এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রাকৃতিক গ্যাসের দামও বাড়িয়েছে। ফলে এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে দ্রব্যমূল্যে।

এত বছর ধরে একটা সরকার ক্ষমতায়, অথচ তারা মানুষের এই মৌলিক চাহিদার জায়গায় সফল হতে পারছে না বড় করে উন্নয়নের কথা বলেও। সিন্ডিকেট, কারসাজি কিংবা মজুদদারি এসবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলছে সরকার। আগের বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি নানা হাস্যকর কথা বলে মানুষের মাঝে ক্ষোভ বাড়িয়ে দিয়েছিলেন।

একবার তো বলে ফেললেন যে, বাজারে সিন্ডিকেট এত শক্তিশালী যে সরকার কিছু করতে পারবে না। বর্তমান বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু প্রথম কয়েকদিন দৌড়ঝাঁপ করে এখন বলছেন, বাজারে কোনোকিছু অবিক্রীত থাকছে না, মানুষের হাতে অনেক টাকা। ভয়ংকর অসংবেদনশীল কথা কখন বলা যায় তা ভাবনার বিষয়।

সরকার একদিকে বলে, কিছু মধ্যসত্ত্বভোগী কারসাজি করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করছে। আবার বলে বাজার অর্থনীতিতে ব্যক্তিখাত নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। তাই যদি হয়, তাহলে জ্বালানি খাতে বাজার অর্থনীতি কেন অনুসরণ করা হচ্ছে না?

জ্বালানি তেলের মতো একটি অতি প্রয়োজনীয় পণ্য এককভাবে সরকারি কোম্পানি বিপিসি আমদানি করে, বিপণন করে এবং তাও বিশ্ববাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিক্রি করে না। বাড়লে এক লাফে বাড়িয়ে ফেলে, কমলে কমায় না। এখন প্রশ্ন জাগে যে, ভোক্তা অধিদপ্তর কোথায়?

খুচরা বাজার, বড় বাজারে ঢুকে ছোট ছোট ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে নানা কিছু করতে পারে আমাদের ভোক্তা অধিদপ্তর। তাহলে বিপিসির বেলায় ভোক্তা অধিদপ্তরের আইন প্রয়োগ হবে না কেন? বিপিসিও তো একটি কোম্পানি, এরা তো ব্যবসা করে।

আরেকটি হলো কয়েকটি মাত্র কোম্পানির হাতে ভোগ্যপণ্যের বাজার। চিনি, তেল এগুলো নিয়ন্ত্রণ করে বড় ৩/৪টি কোম্পানি এবং ডিমের বাজারও বড় দুটি কোম্পানির হাতে। তারাই আবার দাম ঠিক করার ক্ষেত্রেও এদেরই প্রভাব। ফলে বাজারে সরকারের কর্তৃত্ব নেই বললেই চলে। এই একচেটিয়া কর্মকাণ্ড বন্ধ করতেই হবে।

আর এই মুহূর্তে ডলার সংকট নিরসন ও শুল্ক কমিয়ে দাম কমাতে না পারলেও সরকার চাঁদাবাজি তো বন্ধ করতে পারে। স্থানীয় বাণিজ্য সংগঠনগুলোর মাধ্যমে চাঁদাবাজির তথ্য সংগ্রহ করে তা সরকার রাজনৈতিকভাবে এই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করতে পারে।

লিপ সার্ভিস তথা শুধু মুখে কথা বলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে না। মানুষের ভাবনাটা মাথায় এনে অনুধাবন করতে হবে যে, দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক বৃদ্ধির ফলে মানুষের জন্য সংসার চালানোই সমস্যার।

দিনমজুররা, ছোট ছোট কর্মীরা আগের চেয়ে অনেক কম দিন কাজ পাচ্ছেন। অনেক কর্মক্ষেত্রে ওভারটাইমও বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক ব্যক্তিখাতে ঠিকমতো বেতনও হচ্ছে না। ফলে আয় অনেক কমে গেছে মানুষের। মানুষের পকেটে অনেক টাকা এই জাতীয় কথা না বলে মানুষের কষ্ট অনুধাবন করতে হবে গুরুত্ব দিয়ে।

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ।। প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন।

সৌজন্যে, ঢাকা পোস্ট।