রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উপর নির্ভরশীল না হলে হয়তো সংকট হতো না

ভোক্তাকণ্ঠ রিপোর্ট: অধ্যাপক এম এম আকাশ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অর্থনীতি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান। বর্তমানে তিনি ঢাবির ব্যুরো অব ইকোনমিক রিসার্সের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ১৯৮২ সাল থেকে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছেন। তিনি বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক কার্যকলাপের সঙ্গেও সম্পৃক্ত রয়েছেন। নানা বিষয়ে তার নানা ধরনের প্রবন্ধ ও রচনা নানা জার্নাল এবং পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।

বাংলাদেশের দ্বিতীয় প্রেক্ষিত পরিকল্পনা (২০২১-৪১) প্রণয়নের লক্ষ্যে গঠিত বিশেষজ্ঞ প্যানেলের একজন সদস্য এম এম আকাশ। বাংলা একাডেমি ও অর্থনীতি সমিতির আজীবন সদস্যও তিনি। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট ও সমসাময়িক বিষয় নিয়ে তিনি কথা বলেছে ভোক্তাকণ্ঠের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এস এম রাজিব।

ভোক্তাকণ্ঠ: ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটের বিষয়ে আপনার মন্তব্য কী?

অধ্যাপক এম এম আকাশ: এই বাজেট একটি চ্যালেঞ্জের বাজেট। এখানে মুদ্রাস্ফীতি প্রবল ছিল, ফরেন স্ট্রিট রিজাভ কমে এসেছিল, টাকার মান কমে যাচ্ছিল, বিদ্যুৎখাতে জ্বালানী সংকট ছিল। জ্বালানী আমদানি করতে না পারায় বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছিল না এবং প্রবৃদ্ধি কমে যাচ্ছে, টাকা পাচার হচ্ছে, সর্বোপরি ফিনান্সিয়াল সেক্টরে একটা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে। সুতরাং কতোগুলো ইকোনমিক রিফরম্যাট চ্যালেঞ্জ ছিল আর কতোগুলো মুদ্রাস্ফীতির চ্যালেঞ্জ ছিল এবং স্ট্যাবিলিটির চ্যালেঞ্জ ছিল, স্থিতিশীলতার চ্যালেঞ্জ ছিল। এছাড়াও বাইরের জিওপলিটিক্যাল চ্যালেঞ্জ ছিল। আবার একইসঙ্গে অতি সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে শর্ত আরোপ করায় পলিটিক্যাল বিষয়েও চ্যালেঞ্জ ছিল।

ভোক্তাকণ্ঠ: এবারের বাজেটের পরিচালন ব্যয় সম্পর্কে আপনার মন্তব্য কী?

অধ্যাপক এম এম আকাশ: আপনার যদি দেড় টাকার বাজেট হয়, তাহলে আপনি ট্যাক্সসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে তুলেছেন এক টাকা। কিন্তু খরচ করবেন দেড় টাকা। তার মানে আপনাকে এক টাকার অর্ধেক ৫০ পয়সা ধার করতে হবে। ধার করে আপনাকে কাজ করতে হবে। আবার ওই ৫০ পয়সা ধার করেও আপনি পুরোটা উন্নয়ন ব্যয় করতে পারবেন না। ওই এক টাকার মধ্যে থেকে কিছুটা উন্নয়ন ব্যয় করবেন। ‍কিন্ত ১ টাকার মধ্যে ৭৫ পয়সাই চলে যাবে পরিচালন ব্যয়ে।

ভোক্তাকণ্ঠ: এবারের বাজেট কতোটা ভোক্তাবান্ধব হয়েছে?

অধ্যাপক এম এম আকাশ: চাপের মুখে সরকার যা পদক্ষেপ নিয়েছে তা যথেষ্ট নয় এবং আশঙ্কা আছে যদি এটা ঠিক মতো সংস্কার না করা হয় তাহলে শ্রীলঙ্কার মতো হয়ে যেতে পারে। তবে শ্রীলঙ্কার মতো হয়নি এখনো। আর হবে না বলেই মনে হয়। কিন্তু এটা নির্ভর করছে- অব্যাহত ভাবে যদি ডলারের ক্রাইসিস এভাবে বাড়তে থাকে তার উপর।

ভোক্তাকণ্ঠ: এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় কি?

অধ্যাপক এম এম আকাশ: প্রথমত দুই রকম। একটি হলো- রপ্তানি আয় বৃদ্ধি করা। আরেকটি হলো আমদানি ব্যয় কমানো। আমদানি ব্যয় কমাতে হলে আমদানি প্রতিস্থাপন করতে হবে। আর আমদানি প্রতিস্থাপন যদি জ্বালানীখাতে আমরা করতে যাই, তাহলে এলএনজি গ্যাস না ব্যবহার করে দেশীয় গ্যাস ব্যবহার করতে হবে। কয়লা আমদানি না করে দেশীয় কয়লার সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার করতে হবে। অথবা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কমিয়ে দিয়ে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে এবং রিনিউয়েবল এনার্জির (নবায়নযোগ্য জ্বালানি) দিকে গুরুত্ব দিতে হবে। এই হলো একটা পদ্ধতি।

এছাড়াও আরেকটি বিষয় হলো- বিভিন্ন জায়গায় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু এটা যদি না কমাতে পারে তাহলে জনগণ ক্ষুব্ধ হবে, রাজনৈতিক ক্ষমতা তথা নির্বাচনী ব্যবস্থা অনিশ্চিত হয়ে পড়বে। সুতরাং চাল, জ্বালানী দ্রব্য এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্য পণ্যের দাম কম রাখতে হবে। আর যারা করোনা এবং ইত্যাদি কারণে একেবারে হতদরিদ্র হয়ে গেছে স্বল্প মূল্যে তাদের কাছে সেবা পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে। দুর্নীতি কমাতে হবে ওই চ্যালেঞ্জে যাতে সিস্টেম লস না হয়। সামাজিক সুরক্ষার কথাগুলো যাতে ঠিকমতো পৌঁছায় এবং পথিমধ্যে যাতে দুর্নীতি না হয় সেটাও নিশ্চিত করতে হবে। ডলার যেটা আয় হচ্ছে সেটা যেন ব্যাংক থেকে বাদ দিয়ে অন্যরা না নিয়ে যেতে পারে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে।

ভোক্তাকণ্ঠ: দেশে জালানী সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। এই সংকটের কারণ কী?

অধ্যাপক এম এম আকাশ: এটা পলিসির ব্যর্থতা। সরকার প্রথম থেকেই যদি উচ্চ খরচের প্রাইভেট বিদ্যুৎ কেন্দ্র বা রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরি করে তাদের উপর নির্ভরশীল না হয়ে পড়তো তাহলে এই সংকট মনে হয় না তৈরি হতো। এখন দেখা যাচ্ছে বিদ্যুতের কারখানা আছে কিন্তু ক্যাপাসিটি ব্যবহার করার মতো জ্বালানী নেই। কারণ ওই জ্বালানী সংগ্রহ করার জন্যে যে ডলারের দরকার, সরকার সেটা সংগ্রহ করতে পারছে না। তার কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারছে না, ‍অথচ তাদেরকে রেন্টাল ফি (ক্যাপাসিটি চার্জ) দিতে হচ্ছে। এখানে সরকারের না হচ্ছে বিদ্যুৎ উৎপাদন অথচ হচ্ছে খরচ। আর এলএনজি গ্যাসের উপর অত্যাধিক নির্ভরতার কারণে গ্যাস এক্সপ্লোরেশনের দিকে সরকার মনযোগ দেয়নি। যদি দিতো তাহলে সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধানের যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে সেটা অনেক আগেই করা যেতো এবং সেখান থেকে আমরা গ্যাস পেতাম।

১০ বছর আগের থেকেই আমরা বলছি- এটা জাতীয় উদ্যোগে করা যায় কি না। তখন করা হয়নি। এখন করতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে যে- আমেরিকান এক্সিন মবিল কোম্পানি নানা শর্ত চাপিয়ে দিচ্ছে এবং সরকার সেই শর্ত গিলতেও পারছে না। যার ফলে মাঝখানে আটকে আছে। তবে এখনো যদি সরকার জাতীয় স্বার্থ দেখে তাহলে মালয়েশিয়ার পেট্রোনাস কোম্পানীর মতো জাতীয় কোম্পানীকেই এই দায়িত্ব দিতে পারে এবং তাদের সহযোগিতা করতে পারে এবং বাইরের থেকে কনসালটেন্সি ভাড়া করে এনে সেটা করতে পারে এবং সেটা করাই বাঞ্চনীয় হবে। আর যেটা করা উচিৎ- যেসব গ্যাস ফিল্ডগুলো স্বল্প ব্যাবহৃত হচ্ছে সেগুলোর সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে এবং যে গ্যাস ফিল্ডগুলোতে গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে সেখানে গ্যাস উত্তোলনে গুরুত্ব দিতে হবে। কিন্তু এবারের বাজেটে দেখা যাচ্ছে- বিদ্যুৎ, জ্বালানী ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের জন্য বরাদ্দ দেওয়া ৩৪ হাজার ৮১৯ কোটি টাকার মধ্যে বিদ্যুৎ বিভাগেই চলে যাচ্ছে ৩৩ হাজার ৭৭৫ কোটি টাকা। এখানে জ্বালানী খাতের উন্নয়নের জন্য তো এক হাজার কোটি টাকারও কম ধরা হয়েছে। সুতরাং চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা না করে সংকট মোকাবেলায় সব চলে যাচ্চে।

ভোক্তাকণ্ঠ: এক্সিন মবিলের সঙ্গে কি ধরনের চুক্তি করা গেলে দেশীয় স্বার্থ রক্ষা করা যাবে?

অধ্যাপক এম এম আকাশ: এখানে সর্বপ্রথম দেশীয় পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন কোম্পানীগুলোর জন্যও সুযোগ করে দিতে হবে এবং উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে এই চুক্তি করতে হবে। এছাড়াও এখানে বিদেশী একাধিক কোম্পানীকে এই টেন্ডারে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিতে হবে এবং আন্তর্জাতিক নিয়ম মেনে যে সর্বনিম্ন দর ঘোষণা করবে তাকেই সমুদ্রের গ্যাস এক্সপ্লোরেশনের কাজ দিতে হবে। এখানে আমলারা যাতে ঘুষ খেতে না পারে এবং পুরো প্রক্রিয়াটা যাতে স্বচ্ছ হয়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে।