ভোক্তা নাকি ভুক্তভোগী!

।। শুভ কিবরিয়া ।।

ভোক্তার প্রয়োজন বদলে যাচ্ছে। বিশেষায়িত পণ্যের যুগ ভোক্তার দৃষ্টিভংগিতে এনেছে ব্যাপক পরিবর্তন। বাজারব্যবস্থার বিকাশও প্রভাব ফেলছে ভোক্তার মননে। শুধু প্রয়োজনই যে কেবল ভোক্তার চাহিদা নিরুপন করছে তাও নয়। নানা প্রচারণা আর গণউৎপাদনের কারণে স্বাভাবিকভাবেই ‘প্রয়োজন’-এর সংজ্ঞাও বদলেছে। পোলিশ গবেষক জিগমুন্ড বাওমাঁর মতে, উত্তর-আধুনিকতায় নিরাপত্তা আর স্বাধীনতার মাঝে যে টানাপোড়েন, তার প্রভাবে চাহিদা আর ভোগের পার্থক্য এখন রীতিমত ঘোলাটে। তাঁর ভাষায় – ‘লিক্যুইড’।

জার্মান-আমেরিকান দার্শনিক হার্বার্ট মারক্যুসা, আরও একধাপ এগিয়ে বলছেন, শিল্পায়িত সমাজে প্রযুক্তি যে যুক্তি তুলে ধরে ভোক্তার সামনে তা স্বৈরশাসকের ভূমিকা নেয়। সেটা ভোগবাদকেই সামনে আনে।

বাংলাদেশের ভোক্তার মনজগতের এই পরিবর্তনও লক্ষ্যণীয়। এক তথ্য বলছে, বর্তমানে বাংলাদেশে প্রতিদিন গড়ে ৬৩টি করে গাড়ি বিক্রি হয়। বাংলাদেশ রিকন্ডিশন্ড ভিহিক্যালস ইমপোর্টার্স অ্যান্ড ডিলার্স অ্যাসসিয়েশনের সভাপতি হাবিবুল্লাহ ডনের ভাষ্যানুযায়ী, ২০১৭’র জুলাই থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ১১হাজার ৪৭৬টি গাড়ি দেশে আমদানি করতে হয়েছে বর্ধিত চাহিদা মেটাতে। এই সূত্র অনুসারে, ২০১২-২০১৩ অর্থবছরে ৭ হাজার৩৫৩টি রিকন্ডিশন্ড গাড়ি বিক্রি হয়। ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে তা বেড়ে দাড়ায় ২০ হাজার ১৪৯টিতে।

বাহন থেকে ভোজনে নজর দেয়া যাক। বাংলাদেশ ব্যুরো অব স্ট্যাটিসটিক্সের (২০১২) তথ্যমতে, ২০০১ সালে সাধারণ মানুষ ফাস্ট ফুডের পেছনে যে পরিমাণ টাকা খরচ করেছে ২০১০ সালে তা আড়াই গুণ বেড়ে যায়।

নব্বইয়ের দশকে ইন্টারনেটের আবির্ভাবের পর লেনদেনের চিরাচরিত রূপ নতুন মাত্রা পায়। সেইসাথে ভোক্তা-আচরণের মাঝেও ঘটে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন। লাইটক্যাসেল পার্টনার্স নামে এক সংস্থা ২০১৬ সালে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাঁদের তথ্যমতে, অন্য যে কোনো পণ্যের চাইতে ডিজিটাল মাধ্যমে সারা বছরই ভোক্তাদের নজর বেশি থাকে ইলেক্ট্রনিক্স পণ্য এবং পোশাকের দিকে।

এসব উদাহরণ বর্তমান সামাজিক জীবনের বিশেষ এক মাত্রাকে তুলে ধরে। বিশেষজ্ঞরা যার নাম দিয়েছেন ‘কন্সপিকিউয়াস কনজাম্পশন’। ভোক্তার প্রয়োজন বা চাহিদার সাথে এই প্রাপ্তি কতটা মৌলিক তা প্রশ্নবিদ্ধ। এ ধরণের প্রবণতা সমাজে তৈরি করে আপেক্ষিক দারিদ্র্যের। তা অনেক সময় ডেকে আনে বিপদও। যেমন, ২০১৪ সালে বাংলাদেশে ঈদ উদযাপনের জন্য ‘পাখি ড্রেস’ কেনা নিয়ে বেশ কিছু আত্মহত্যার খবরও আমরা নজরে আসে।

ভোক্তার এই বায়বীয়, অসীম, অমিত চাহিদা একটা জায়গায় থিতু করতে না পারলে তা ভোক্তার জীবনে দারুণতর বিপদও ঘটিয়ে ফেলতে পারে। ভোক্তা তখন ভুক্তভোগীতে পরিণত হতে পারে। তাই দরকার ভোক্তার সচেতনতা। ভোক্তার জন্য সমাজ ও পরিবেশ সম্পর্কে নিজস্ব অভিজ্ঞান তৈরি তাই খুব জরুরি।