প্যাকেটের নামে ‘গলা কাটা’

ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: সরকার বলছে, মিনিকেট নামে কোনো ধান নেই। তাই এই নামে চাল বিক্রি করা যাবে না। তারপরও রশিদ, সাগর, মনজুরসহ বিভিন্ন কোম্পানি বস্তায় ভরে ভোক্তার কাছে ৬৮-৭২ টাকা কেজি বিক্রি করছে। সেই মিনিকেট চাল প্রাণ প্যাকেটজাত করে বিক্রি করছে ৯২ টাকা কেজি (৫ কেজি ৪৬০ টাকা)। একইভাবে প্রাণ, স্কয়ারের চাষী ও এরফান গ্রুপ এক কেজি চিনিগুঁড়া চাল প্যাকেটজাত করে বিক্রি করছে ১৭৫ টাকায়, আকিজের এসেনসিয়াল চিনিগুঁড়া চালের কেজি ১৭০ টাকা। তাদের বস্তার এই চালই খুচরা বিক্রেতারা ১২০-১৩৫ টাকায় বিক্রি করছেন।

বাজারে খোলা মুড়ি ৮০ টাকা কেজি। সেই মুড়িই প্রাণ দ্বিগুণ দামে অর্থাৎ ৫০০ গ্রাম বিক্রি করছে ৮০ টাকা, স্কয়ারের ৪০০ গ্রামের রুচি মুড়ি ৬৫ টাকা। ভোক্তারা খোলা আটা ৪৫ টাকা কিনলেও স্কয়ার, তীর, বসুন্ধরা দুই কেজি আটা প্যাকেটজাত করে ১৩০ টাকা বিক্রি করছে। একইভাবে খোলা চিনি ১৪০ টাকা বিক্রি হলেও ফ্রেশ, তীরের প্যাকেটজাত চিনি ১৪৫ টাকা। সয়াবিন তেলও প্যাকেটজাত হলেই লিটারে ১৮ টাকা বেশি গুনতে হচ্ছে ভোক্তাদের। কারণ খোলা সয়াবিন তেল বাজারে ১৪৫ টাকা। তা প্যাকেটে ১৬৩ টাকা লিটার বিক্রি করছেন খুচরা বিক্রেতারা। 

রোববার বিভিন্ন বাজার ঘুরে সংশ্লিষ্ট ক্রেতা-বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, করপোরেটরা প্যাকেটের নামে বেশি করে দাম আদায় করছে। এতে ভোক্তারাই বেশি ঠগছে। তারা ভোক্তাদের গলা কাটছে।

বিভিন্ন রাইস মিলমালিকরা দাবি করছেন, মিনিকেট নামে ধান থেকেই মিনিকেট নামে সরু চাল তৈরি করা হয়। কিন্তু সরকার বলছে, মিনিকেট নামে কোনো ধানের জাত নেই বাংলাদেশে। আটাশ ধান কেটে সরু করে তা বেশি দামে বাজারজাত করা হচ্ছে। এই নিয়ে দেশে হইচই শুরু হলে খাদ্য মন্ত্রণালয় বলছে তা করা যাবে না। তা ঠেকাতে কঠোর অবস্থানে গেছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে গত ২১ ফেব্রুয়ারি খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে বিভিন্ন মিলমালিকদের সঙ্গে বৈঠক করে স্পষ্ট জানিয়ে দেয় চালের বস্তায় জাত ও মূল্যসহ সাত নির্দেশনা মানতে হবে, যা ১৪ এপ্রিল থেকে বাস্তবায়ন করতে বলা হয়। 

কিন্তু সরেজমিনে দেখা যায়, রাজধানীতে চালের পাইকারি মোকাম কৃষি মার্কেট, কারওয়ান বাজারসহ কোনো দোকানে নতুন বস্তার চাল আসেনি। আগের মতোই মিনিকেট চাল ৬৮-৭২ টাকা কেজি বিক্রি করছেন খুচরা বিক্রেতারা। রশিদ গ্রুপ, সাগর গ্রুপ, মনজুর গ্রুপসহ বিভিন্ন কোম্পানির চাল এই দামে (৩৪০০-৩৫৫০ টাকা ৫০ কেজির বস্তা) বিক্রি করছেন খুচরা বিক্রেতারা। কিন্তু প্রাণ কোম্পানি সেই মিনিকেট চাল প্যাকেটজাত করে খুচরা বিক্রেতাদের মাধ্যমে ৯২ টাকা কেজি (৫ কেজি ৪৬০ টাকা) বিক্রি করছে। 

এ ব্যাপারে কারওয়ান বাজারের হাজি রাইস এজেন্সির মালিক মাঈন উদ্দিন বলেন, আগের বস্তাতেই চাল বিক্রি করা হচ্ছে। কোনো দাম কমেনি। মিনিকেট ৬৮-৭৫ টাকা, আটাশ চাল ৫৫-৫৮ টাকা ও মোটা চাল ৪৮-৫২ টাকা কেজি। বিভিন্ন কোম্পানির চাল এসব দামে বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু প্রাণসহ বিভিন্ন কোম্পানি প্যাকেটজাত করে অনেক বেশি দামে বিক্রি করছে। কেজিতে ২০ টাকার বেশি। 

একই বাজারের হাজি ইসমাইল রাইস এজেন্সির মো. জসিম উদ্দিনও বলেন, ‘সাধারণ ভোক্তাদের জন্য প্যাকেটজাত করা হয় না। বিভিন্ন করপোরেট কোম্পানি বেশি করে লাভ করার জন্যই প্যাকেটজাত করছে। বেশি দাম আদায় করছে। এতে আমাদের গালি খেতে হচ্ছে। কম দামের চাল বিক্রি করেও আমাদের কেজিতে যে ১-২ টাকা লাভ। বেশি দামের চাল বিক্রি করেও সেই লাভ। আমাদের দিয়ে তারা ভোক্তাদের পকেট কাটছে।’ 

এই পাইকারি চাল ব্যবসায়ী দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, ‘প্রাণ, মোজাম্মেল চিনিগুঁড়া চাল এক কেজি ১৭০-১৭৫ টাকা বিক্রি করছে। তাদের ৫০ কেজির বস্তার চাল ৬ হাজার টাকা বা ১২০ টাকা কেজি। প্যাকেটের খরচ কি ২০-২৫ টাকা? এটা কি সরকারের অফিসাররা জানেন না। খাদ্য মন্ত্রণালয় অফিসে বসে দামের ব্যাপারে সব বলে। কিন্তু বাস্তবে তা দেখে না। তাই মিলমালিকরা যা ইচ্ছা তাই করে। রমজান মাসেও চালের দাম বাড়ায়।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘কৃষকরা কি খুব বেশি দামে পোলাও ধান বিক্রি করছে। যে চালের দাম এত। সরকার শুধু আমাদের ধরে। করপোরেটদের ধরা দরকার। তাহলে এত দাম বাড়বে না বাজারে।’ 

তার কথা অনুযায়ী নওগাঁ জেলার নিয়ামতপুরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সেখানে পোলাওয়ের ধান ২ হাজার থেকে ২ হাজার ২০০ টাকা মণ বিক্রি হচ্ছে। প্রতি মণে ২০ কেজি চাল হয়। তাতে প্রতি কেজির দাম পড়ে ১০০-১১০ টাকা। ঢাকায় পৌঁছতে সব মিলে খরচ কেজিতে ৫ টাকা হতে পারে। সেই পোলাওয়ের চাল ১৩০-১৪০ টাকা কেজি ও প্যাকেটজাতটা ১৭০-১৭৫ টাকা ভোক্তাদের কিনতে হচ্ছে। 

বিভিন্ন বাজারে দেখা গেছে, বিক্রেতারা বস্তার মুড়ি ৮০ টাকা কেজি বিক্রি করছেন। কিন্তু বরিশালের প্যাকেটজাত করে ৫০০ গ্রাম ৬০ টাকা, স্কায়ারের ৪০০ গ্রাম রুচি মুড়ি ৬৫ টাকা ও প্রাণের ৫০০ গ্রাম মুড়ি ৮০ টাকায় বিক্রি করছেন খুচরা বিক্রেতারা। জানতে চাইলে টাউনহল বাজারের মনির স্টোরের আনোয়ার বলেন, কোম্পানির মুড়ি আছে। তা ৪০০-৫০০ গ্রামের ৬৫-৮০ টাকা। খোলা মুড়ির কেজি ৮০ টাকা। 

সরেজমিনে কারওয়ান বাজারে গেলে মেসার্স মায়ের দোয়ার ইমন বলেন, ‘খোলা মুড়ির কেজি ৮০ টাকা, প্রাণের হাফ কেজি ৮০ টাকা, রুচি মুড়ি ৬৫ টাকা। এত দাম হলেও আমাদের লাভ বেশি হয় না। কোম্পানিই প্যাকেটজাত করে বেশি দাম নিচ্ছে। আমাদের কেজিতে ২-৩ টাকা থাকে।’ 

বর্তমানে গমের মৌসুম চলছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দিনাজপুর, কুড়িগ্রাম, চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিভিন্ন হাট-বাজারে ১ হাজার ৫৫০ থেকে ১ হাজার ৬০০ টাকা মণ। কেজি ৪০ টাকার মতো। রাইস মিলে এই গম ভাঙাতে কেজিতে ৫ টাকা নেয়। সেই গমের আটা ৪৫ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে বিভিন্ন বাজারে। কিন্তু সিটি গ্রুপের তীর, এসিআইয়ের দুই কেজির প্যাকেটজাত আটা ১৩০ টাকা। এসব কোম্পানির গায়ে লেখা আছে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য (এমআরপি) ১৩০ টাকা। খুচরা বিক্রেতারাও এসব দামে বিক্রি করছেন। কারওয়ান বাজারের ইয়াসিন স্টোরের ইয়াসিন এ প্রতিবেদককে বলেন, খোলা আটা ৪৫ টাকা কেজি। দুই কেজির প্যাকেট আটা ১৩০ টাকা। তবে একটু কম দামে দেওয়া যাবে। এই খুচরা বিক্রেতা চিনির ব্যাপারে বলেন, ফ্রেশসহ বিভিন্ন কোম্পানির খোলা চিনি ১৩০-১৪০ টাকা কেজি। কিন্তু প্যাকেটজাতটা ১৪৫ টাকা কেজি বিক্রি করা হচ্ছে। প্যাকেটজাতে তাদের বেশি লাভ

অন্য পণ্যের মতো বিভিন্ন কোম্পানি প্যাকেটজাত সয়াবিন তেলও বিক্রি করছে। তবে খোলা তেলের চেয়ে লিটারে ১৮ টাকা বেশি। কারণ খোলা তেল ১৪৫ টাকা লিটার হলেও প্যাকেটজাত তেল ১৬৩ টাকা ভোক্তাদের কিনতে হচ্ছে। 

বিভিন্ন বাজারে ভালো মানের শুকনা মরিচের কেজি ৪০০-৪৫০ টাকা। তা ভাঙাতে নিচ্ছে ২৫ টাকা। এভাবে মরিচের কেজি ৪৫০-৫০০ টাকা পড়ে। বিভিন্ন মসলা ব্যবসায়ীরাও বলছেন, ১০০ গ্রাম ৫০ টাকা বা কেজি ৫০০ টাকা। কিন্তু স্কয়ারের হাফ কেজি বা ৫০০ গ্রাম রাঁধুনী গুঁড়া মরিচ বিক্রি হচ্ছে ৪৫০ টাকায়। এ ব্যাপারে কৃষি মার্কেটের ইউসুফ স্টোরের ইউসুফ খবরের কাগজকে বলেন, কৃষকরা কি এত দাম পান? এসব সরকারকে দেখা দরকার। কারণ ভোক্তারা বেশি ঠকছেন। 

অভিযোগের ব্যাপারে প্রাণ গ্রুপের পরিচালক ইলিয়াস মৃধা  বলেন, ‘আমাদের পোলাওয়ের চাল, মুড়ি অথেনটিক। কোনো ধরনের মিক্স নেই। এ জন্য দাম বেশি। রপ্তানি করার জন্য এভাবে প্যাকেটজাত করা হয়েছে। কিন্তু সরকার রপ্তানি বন্ধ রেখেছে। তাই বিভিন্ন বাজারে দেখা যাচ্ছে।’ মিনিকেট চালের বেশি দামের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘বর্তমানে আমরা এই চাল বাজারে দিচ্ছি না। যা আছে আগের। টাইমের গ্যাপ থাকতে পারে। তার জন্য দামও বেশি মনে হচ্ছে।’

স্কয়ার গ্রুপের গুঁড়া মরিচ, চিনিগুঁড়া চাল ও মুড়ির বেশি দামের ব্যাপারে জানতে যোগাযোগ করা হলেও ব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন চৌধুরীর ফোন বন্ধ থাকায় কোনো মন্তব্য জানা সম্ভব হয়নি। সিটি গ্রুপের তীর আটা বেশি দামে বিক্রির ব্যাপারে পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, খোলা বাজারে দুই কেজি ৯০ টাকা বিক্রি হলে প্যাকেটজাত দুই কেজি ১৩০ টাকা বেশি না। কারণ প্যাকেট খরচ ১০ টাকা, পরিবেশকের ৫ টাকা ও খুচরা বিক্রেতাদের লাভ ৫ টাকা দেওয়া হয়। সব খরচের পর লাভ ১০ টাকা করতে হবে। লোকসান করে তো ব্যবসা করা যায় না। তেল-চিনিরও একই অবস্থা। প্যাকেট খরচ, পরিবেশক ও খুচরা বিক্রেতাদের লাভ দেওয়ার পর কিছু লাভ থাকে। তা করতে হবে। খবরের কাগজ।