গ্যাসের চাহিদা বাড়লেও নেই সংস্থানের উদ্যোগ 

ভোক্তাকন্ঠ ডেস্ক:

ক্রমান্বয়ে গ্যাসের চাহিদা বাড়লেও সংস্থানের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনও পথ এখনও পাওয়া যায়নি। একদিকে দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন কমছে, অন্যদিকে চাহিদা বাড়ছে। এই বাড়তি গ্যাস সংস্থান নিয়ে চিন্তায় রয়েছে সরকার। গ্যাস সংকটের সমাধান নিয়ে পেট্রোবাংলার দায়বদ্ধতা নেই, পরিকল্পনা থাকলেও তার বাস্তবায়না নেই বলেই সংকট কাটছে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

আগামী তিন বছর দেশের গ্যাসের চাহিদা বিশ্লেষণ করে পেট্রোবাংলা বলছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে মোট ৪ হাজার ৭৮৭ বিসিএফ গ্যাসের চাহিদা রয়েছে। অন্যদিকে ২০২৩-২৪ সালে দেশে গ্যাসের মোট চাহিদা ৪ হাজার ৯৩১ বিসিএফ। এর মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন, শিল্প, আবাসিক ও সিএনজিতে গ্যাসের চাহিদা বৃদ্ধির পূর্বাভাস দিয়েছে পেট্রোবাংলা। সরকার কয়লা থেকে সরে এসে গ্যাসে বিদ্যুৎ উৎপাদনে নজর দেওয়ায় এই বাড়তি চাহিদা সৃষ্টি হবে বলে মনে করা হচ্ছে।

পেট্রোবাংলা বলছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বার্ষিক গ্যাসের চাহিদা ছিল ২ হাজার ১৯৭ বিসিএফ। এরপর ২০২১-২২-এ এসে দাঁড়ায় ২ হাজার ২১০ বিসিএফ, ২০২২-২৩-এ ২ হাজার ২৬৬ বিসিএফ এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এসে এ খাতে গ্যাসের চাহিদা দাঁড়াবে ২ হাজার ২৯৭ বিসিএফ।

সিএনজিতে ২০২০-২১ অর্থবছরে ১৩৯ বিসিএফ, ২০২১-২২-এ ১৪৫ বিসিএফ, ২০২২-২৩-এ ১৫২ বিসিএফ এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১৫৯ বিসিএফ চাহিদা সৃষ্টি হবে।

আবাসিকে নতুন সংযোগ বন্ধ থাকলেও এখনকার ৪২৫ বিসিএফ বাল্কি চাহিদা ২০২২-২৩-এ হবে ৪৫৭ বিসিএফ। এর পরের বছর যা বেড়ে দাঁড়াবে ৪৯০ বিসিএফ। তবে ক্যাপটিভে ক্রমান্বয়ে চাহিদা কমবে বলে আশা করা হচ্ছে। ধারণা করা হচ্ছে, গ্রিডে বিদ্যুৎ উৎপাদন স্থিতিশীল হলে শিল্প মালিকরা গ্রিডের বিদ্যুৎ ব্যবহার করবে। তবে চা বাগানে ৩৮ বিসিএফ চাহিদা বরাবর বজায় থাকবে। সার কারখানার চাহিদা ৩১৬ বিসিএফই থাকবে।

বার্ষিক দেশীয় গ্যাসের যে উৎপাদন তাতে দেখা যাচ্ছে, গড়ে প্রতিমাসে ৭১ বিসিএফ করে দেশীয় খনি থেকে গ্যাস তোলা হচ্ছে। অর্থাৎ বার্ষিক হিসাবে যা দাঁড়ায় ৮৫২ বিসিএফ। কিন্তু পেট্রোবাংলা যে গ্যাসের হিসাব দিচ্ছে, তাতে আমদানি-নির্ভরতা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু আমদানি করার মতো অবকাঠামো এখনও গড়ে ওঠেনি।

পেট্রেবাংলার একজন সাবেক কর্মকর্তা জানান, এখন মহেশখালীতে আর ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল করা সম্ভব নয়। মহেশাখলীতে যে দুটি টার্মিনাল রয়েছে তার সর্বোচ্চ ব্যবহার করেও দিনে ৮৫০ মিলিয়ন ঘনফুটের বেশি গ্যাস আনা সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে সরকারকে বিকল্প চিন্তা করতে হবে। এ জন্য পায়রাতে এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কিন্তু করোনাসহ নানামুখী জটিলতায় সেই কাজও খুব একটা গতিশীল নয়। অন্যদিকে স্থায়ী এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের জন্য যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল তার একটির কাজও এখনও শুরু হয়নি। এ জন্য সরকার পরামর্শক নিয়োগ দিলেও বাদবাকি কাজ খুব একটা আগায়নি।

তিনি জানান, সরকারের তরফ থেকে এর আগে দাবি করা হয়, স্থায়ী এলএনজি টার্মিনাল ২০২৫ সালে উৎপাদনে আসবে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টার্মিনাল নির্মাণ শুরু হলেও কাজ শেষ করতে অন্তত চার বছর সময় প্রয়োজন হবে। ফলে টার্মিনাল নির্মাণ কাজ এখনই শুরু করলেও ২০২৫ সালে সম্পন্ন হওয়া সম্ভব নয়।

মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, বিদ্যুৎ বিভাগের তরফ থেকে পায়রাতে টার্মিনাল নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পেট্রোবাংলা এতে আপত্তি জানায়। পরে দেশের একটি বেসরকারি কোম্পানি এবং পেট্রোবাংলা ওই টার্মিনাল নির্মাণ করবে—এখন পর্যন্ত এই আলোচনা চলছে। যদিও এ বিষয়ে এখনও সুনির্দিষ্ট কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি। ওই কর্মকর্তা বলেন, পায়রাতে সাগরের ৫০ কিলোমিটার ভেতরে টার্মিনাল নির্মাণ করতে হবে। এ জন্য ৫০ কিলোমিটার সাগরের তলদেশ দিয়ে গ্যাস সঞ্চালন লাইন নির্মাণ করতে হবে। এছাড়া পায়রা থেকে খুলনা পর্যন্ত পাইপ লাইন নির্মাণ করে জাতীয় গ্যাস গ্রিডে যুক্ত করতে হবে। এর কোনও কাজই এখনও শুরু করেনি পেট্রোবাংলা। ফলে আগামী তিন বছরে যে গ্যাসের চাহিদা সৃষ্টি হবে, তা পূরণ করা দূরুহ হবে পেট্রোবাংলার পক্ষে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ম. তামিম বলেন, ‘পেট্রোবাংলার হিসাব অনুযায়ী ২০২৫ সাল পর্যন্ত গ্যাসের ঘাটতি বেড়েই যাবে। এরপর তারা এলএনজি আমদানি করবে আরও বেশি করে। তারা জানে যে, গ্যাস সংকট হবে, কিন্তু সেই সংকট মোকাবিলায় তাদের কোনও দায়বদ্ধতা নেই। সংকট মোকাবিলা করার অনেক পরিকল্পনা তারা করেছে। কিন্তু তার কোনোটিই বাস্তবায়িত হয়নি। এদিকে দেশে কাজ করা আইওসিগুলো (আন্তর্জাতিক কোম্পানি) বিশেষ করে শেভরনের বিবিয়ানার গ্যাসের সরবরাহ কিন্তু একবারও কমেনি। গত কিছুদিন কিছুটা কমলেও তা ঠিক রাখতে আরও একটি কূপ খনন করতে যাচ্ছে তারা। যদিও বিদেশি কোম্পানিগুলোর গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানোর আগ্রহ থাকে তাদের লাভের জন্য। কিন্তু তারা তো নানা প্রযুক্তি ব্যবহার করে রিজারভার ম্যানেজমেন্ট করছে। পেট্রোবাংলার সেই রিজারভার ম্যানেজমেন্ট পরিকল্পনাই নেই। প্রযুক্তি আর অভিজ্ঞতাও নেই।’

তিনি বলেন, ‘এখনও যদি উদ্যোগ নেয়, সেটির ফল পেতে আমাদের কমপক্ষে দুই বছর সময় প্রয়োজন। কিন্তু তাও তারা করবে কিনা সন্দেহ আছে। কারণ তাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, কোনও দায়বদ্ধতা না থাকা।’