বাড়ছে রড-সিমেন্টের দাম

ভোক্তাকণ্ঠ রিপোর্ট: দেশে প্রতিনিয়ত বাড়ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় সহ বিভিন্ন পণ্যের দাম। বিশ্ববাজারের চেয়ে বাংলাদেশে অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে দাম। এবার নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সঙ্গে দেশের বাজারে বেড়েছে রড ও সিমেন্টের দাম। দেড় মাসের ব্যবধানে প্রতি টন রডের দাম ৫ হাজার থেকে ৯ হাজার টাকা বেড়েছে। প্রতি বস্তা সিমেন্টের দাম বেড়েছে ৫০ টাকারও বেশি।

নির্মাণকাজের প্রধান দুটি উপাদানের দাম বাড়ার জন্য ডলার, জাহাজ ভাড়া, বিশ্ববাজারে কাঁচামালের দাম, পরিবহন ও উৎপাদন খরচ বাড়াকে দায়ী করছেন উৎপাদনকারীরা। এ কারণে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন আবাসন খাতের ব্যবসায়ীরা। প্রকল্পের খরচ বেড়ে যাওয়ায় বাধাগ্রস্ত হচ্ছে সরকারের উন্নয়নমূলক কাজও।

রড উৎপাদনকারীরা জানান, বাজারে এখন তিন ধরনের এমএস রড পাওয়া যায়। সবচেয়ে ভালো মানের হলো অটো কারখানাগুলোতে তৈরি ৭৫ গ্রেডের রড। এটাই বেচাকেনা হয় বেশি। এ ছাড়া রয়েছে সেমি-অটো কারখানাগুলোতে তৈরি ৬০ গ্রেড এবং সাধারণ বা ৪০ গ্রেডের রড।

রাজধানীর কাজীপাড়া, তেজতুরী বাজার, নয়াবাজারসহ কয়েকটি এলাকার রড-সিমেন্ট ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মাস দেড়েক আগে খুচরা পর্যায়ে বিএসআরএম ব্র্যান্ডের প্রতি টন (৭৫ গ্রেড) রডের দাম ছিল ৮৫ থেকে ৮৬ হাজার টাকা। কয়েক ধাপে ৭ হাজার টাকা বেড়ে তা পৌঁছায় ৯১ থেকে ৯২ হাজার টাকায়। তবে কয়েকদিন আগে ১ হাজার টাকা কমে এখন বিক্রি হচ্ছে ৯০ থেকে ৯১ হাজার টাকায়। কেএসআরএম ও বায়েজিদ স্টিল ব্র্যান্ডের রড দেড় থেকে দুই মাস আগে বিক্রি হতো ৮০ থেকে ৮২ হাজার টাকায়। এখন বিক্রি হচ্ছে ৮৯ থেকে ৯০ হাজার টাকায়। একইভাবে রানী ও বন্দর স্টিল ব্র্যান্ডের রড টনে ৪ থেকে ৫ হাজার বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৮৩ হাজার টাকায়। এ ছাড়া তুলনামূলক নিম্নমানের বিভিন্ন ব্র্যান্ডের রড প্রতি টন বিক্রি হচ্ছে ৮২ থেকে ৮৩ হাজার টাকায়।

সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য বলছে, গত এক মাসে প্রায় ৫ শতাংশ দাম বেড়েছে রডের। তবে এক বছরের হিসাবে দাম বাড়ার হার আরও বেশি। এক বছরে দাম বেড়েছে প্রায় ২২ শতাংশ।

রডের পাশাপাশি খুচরা পর্যায়ে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সিমেন্টের বস্তাপ্রতি দাম বেড়েছে ৫০ টাকার মতো। বাজারে প্রতি বস্তা শাহ সিমেন্টে ৫৫০ থেকে ৫৭০, মেট্রোসেম ও আকিজ ৫৪০ থেকে ৫৫০, স্ক্যান ৫৭০ থেকে ৫৮০, ফ্রেশ ৫৩০ থেকে ৫৪০ এবং সুপারক্রিট সিমেন্ট ৫৫০ থেকে ৫৬০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। মাস দেড়েক আগে এসব সিমেন্ট ৪৯০ থেকে ৫৩০ টাকার মধ্যে বিক্রি হয়েছে বলে জানান এ খাতের ব্যবসায়ীরা।

সম্প্রতি রড ও সিমেন্টের দাম নিয়ে প্রস্তুত করা একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনেও বিশ্ববাজারের চেয়ে দেশের বাজারে দাম বাড়ার অস্বাভাবিক চিত্র দেখা গেছে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী গেল এক মাসে বিশ্ববাজারে ১ শতাংশেরও কম বেড়েছে রডের দাম। তবে দেশের বাজারে বেড়েছে ৩ শতাংশ।

অন্যদিকে সিমেন্টের দাম ২ শতাংশের সামান্য বেশি বাড়লেও বাংলাদেশের বাজারে তা বেড়েছে ১৩ শতাংশ। সরকারের উচ্চপর্যায়ে পাঠানো ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে বছরে ৮০ লাখ টন রড ও ৩৩৬ লাখ টন সিমেন্টের চাহিদা রয়েছে। এসবের সিংহভাগ উৎপাদন হয় দেশে। বিশেষ ধরনের অল্প কিছু রড ও সিমেন্ট আমদানি হয়।

কাজীপাড়া এলাকার এস এস করপোরেশনের বিক্রয়কর্মী মো. মামুন বলেন, প্রায় দুই মাস আগে বিএসআরএম রডের টন ৯২ থেকে ৯৩ হাজার টাকায় উঠেছিল। মাঝে কিছুটা কমেছিল। তবে মাসখানেক ধরে বেড়ে এখন ৯১ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

তেজতুরী বাজারের মেসার্স গুডনেস সাপ্লাই কোম্পানির স্বত্বাধিকারী নুর উদ্দিন আহমেদ বলেন, এক-দেড় মাসে প্রতি বস্তা সিমেন্টের দাম বেড়েছে ১০০ থেকে ১৩০ টাকা। দাম বেড়ে যাওয়ায় রড ও সিমেন্টের বিক্রি কমেছে।

উৎপাদনকারীরা বলেন, ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ ও ডলারের দাম বাড়ার কারণে দেশে রডের দাম কিছুটা বেড়েছে। পিএইচপি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম বলেন, যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে অন্য পণ্যের সঙ্গে রড তৈরির কাঁচামাল স্ট্ক্র্যাপের দামও বেড়েছে। অন্যদিকে ডলারের বিপরীতে টাকার মান অনেক কমে গেছে। দুই মাস আগে প্রতি টন স্ট্ক্র্যাপ বুকিং দেওয়া হয়েছিল ৭৫০ ডলারে। তখন ডলারের দর ছিল ৮৫ থেকে ৮৬ টাকা। দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন প্রতি ডলারে ২০ টাকার বেশি অতিরিক্ত পরিশোধ করতে হচ্ছে। আমদানি ও উৎপাদন- সব মিলিয়ে প্রতি টন রডের খরচ ১ লাখ টাকার কাছাকাছি পড়ে যায়। সে হিসাবে লাভে নয় বরং লোকসান দিয়ে রড বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীরা। তবে এখন বিশ্ববাজারে দাম কমতে শুরু করেছে। অবশ্যই দেশেও দাম কমবে। আগামী দুই-এক মাসের মধ্যে রডের বাজার নিম্নমুখী হতে পারে বলে মনে করেন তিনি।

সিমেন্ট উৎপাদনকারীরা জানান, সিমেন্ট তৈরিতে ক্লিংকার, জিপসাম, স্ল্যাগ, চুনাপাথর ও ফ্লাই অ্যাশ- এসব কাঁচামাল ব্যবহার করা হয়। আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচামালের দাম বাড়ার প্রভাব পড়েছে দেশে। প্রিমিয়ার সিমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিরুল হক বলেন, কাঁচামাল, ডলারের দাম, জাহাজ ভাড়া, উৎপাদন খরচ সবই বেড়েছে। তাহলে সিমেন্টের দাম বাড়বে না কেন?

রড-সিমেন্টের দাম বাড়লে আবাসন খাতের প্রসার সবচেয়ে বেশি বাধাগ্রস্থ হয় বলে জানান এ খাতের উদ্যোক্তারা।

রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) প্রথম সহসভাপতি কামাল মাহমুদ বলেন, অযৌক্তিক কিছু কারণ দেখিয়ে প্রতি বছর ঘরবাড়ি তৈরির মৌসুম এলে দাম বাড়িয়ে দেন রড-সিমেন্ট ব্যবসায়ীরা। এ কারণে ডেভেলপাররা দুই বছরের প্রকল্প পাঁচ বছরেও শেষ করতে পারেন না। পাশাপাশি স্কুল-কলেজসহ সরকারের সব ধরনের উন্নয়নমূলক কাজও থমকে যায়। বেড়ে যায় প্রকল্পের খরচ। সরকারের উচিত, আমদানি পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজারদর যাচাই করা। একই সঙ্গে দেশে উৎপাদিত পণ্যের দর বাড়ার কারণও তদারকি করা। নির্মাণসামগ্রীর বাজারে বড় ধরনের সিন্ডিকেট কারসাজি করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। যৌক্তিক দরে রড-সিমেন্ট বিক্রির বিষয়ে সরকার যতদিন পর্যন্ত হস্তক্ষেপ না করবে, ততদিন তাঁদের এই দৌরাত্ম্য থাকবেই।