গ্যাস সংকটে বাড়ছে লোডশেডিং

ভোক্তাকণ্ঠ রিপোর্ট: দেশজুড়ে চলছে বিদ্যুতের তীব্র লোডশেডিং। সারাদেশে তীব্র গরমের মধ্যে লোডশেডিং আরও অসহনীয় করে তুলছে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা।

তবে গ্যাস সঙ্কটের কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে বলে দাবি করছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। 

কিন্তু জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের মতে, এর জন্য সরকারের জ্বালানি নীতিতে ঘাটতি রয়েছে।

এ বছরের মার্চ মাসেই দেশের শতভাগ মানুষকে বিদ্যুৎ সুবিধায় আনার ঘোষণা দিয়েছিল সরকার। আর এই সফলতাকে কাজে লাগিয়ে বিপুল সংখ্যক জনগণকে সংযুক্ত করে টেকসই, নিরবচ্ছিন্ন এবং সাশ্রয়ী বিদ্যুৎসেবা নিশ্চিত করাই ছিল সরকারের চ্যালেঞ্জ।

তবে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে ভিন্ন চিত্র সামনে এসেছে। ঢাকার অবস্থা অনেকটা সহনীয় হলেও ঢাকার বাইরের চিত্র ভয়াবহ। বিশেষ করে চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহী, কুড়িগ্রাম, বগুড়া, রাজবাড়ীতে বাড়ছে বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের তীব্রতা।

বিদ্যুতের আসা-যাওয়ার খেলায় অতিষ্ঠ সাধারণ মানুষ। চরম ভোগান্তির মধ্যে রয়েছে শিক্ষার্থীরা। ব্যাহত হচ্ছে ক্ষুদ্র ও মাঝারী শিল্পের উৎপাদন। বিশেষ করে পোল্ট্রি, হ্যাচারী শিল্প দুরবস্থায় পড়েছে।

রাজবাড়ী থেকে শরিফ শেখ ভোক্তাকণ্ঠকে জানান, একদিকে গরম আরেক দিকে বিদ্যুতের লোডশেডিং, দুটো মিলে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। রাতে গরমে ঘুমানোই যাচ্ছে না। এছাড়াও যাদের ব্রয়লার মুরগির খামার রয়েছে তারা খুবই দুশ্চিন্তায় পড়েছে।

বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে চার কোটি ২১ লাখের বেশি বিদ্যুৎ সংযোগ রয়েছে। যার আওতায় জনগণ শতভাগ বিদ্যুৎ সুবিধা পাচ্ছে। এক যুগ আগে বিদ্যুৎ গ্রাহক সংখ্যা ছিল ১ কোটি ৮ লাখ। এই মধ্যবর্তী সময়ে ২ কোটি ১৩ লাখ বিদ্যুৎ সংযোগ বেড়েছে।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, দেশে বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২৫ হাজার ৫৬৬ মেগাওয়াট। মাথাপিছু বিদ্যুৎ উৎপাদন ৫৬০ কিলোওয়াট। বিদ্যুৎ সুবিধা পাওয়া জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ১০০ ভাগ। প্রি-পেইড মিটার স্থাপন করা হয়েছে ৪৭ লাখ ৩২ হাজার ৪৯টি। সোলার হোম সিস্টেম ৬০ লাখ। মোট সিস্টেম লস ৮ দশমিক ৪৮ শতাংশ।

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) তথ্য অনুযায়ী, আগের দিন ০৩ জুলাই পিক আওয়ারে সারাদেশে ১৫শ মেগাওয়াট লোডশেডিং করে পিডিবি। তার মধ্যে ঢাকায় ৪০০ মেগাওয়াট, চট্টগ্রামে ২০০ মেগাওয়াট, খুলনা ও রাজশাহী অঞ্চলে ২২০ মেগাওয়াট করে, কুমিল্লা অঞ্চলে ১৪০ মেগাওয়াট, ময়মনসিংহ অঞ্চলে ১২০ মেগাওয়াট, সিলেটে ৫০ মেগাওয়াট এবং রংপুর অঞ্চলে ১৫০ মেগাওয়াট লোডশেডিং করা হয়। 

তবে গত দুই দিনে বরিশাল অঞ্চলে কোন লোডশেডিং হয়নি বলে পিডিবির প্রতিবেদনে দেখা যায়।

পিডিবি বলছে, এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) আমদানি কমে যাওয়াতে সারাদেশে গ্যাসের সরবরাহ কমে যাওয়ার কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন কম হচ্ছে। এতে বাধ্য হয়েই লোডশেডিং করছে সরকারি বিদ্যুৎ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানটি।

সংস্থাটির তথ্যমতে, সর্বশেষ গত ০৩ জুলাই সারাদেশে ১১ হাজার ৯৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়। এর বাইরে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে ভারত থেকে আমদানিকৃত এক হাজার ১৯ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। তার মধ্যে ত্রিপুরা থেকে ১৬৬ মেগাওয়াট এবং ভেড়ামাড়া এইচভিডিসি (হাই ভোল্টেজ ডাইরেক্ট কারেন্ট) দিয়ে ৮৫৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ যুক্ত হয়েছে দেশের জাতীয় গ্রিডে। এইদিন পিডিবির নিজস্ব মালিকানাধীন ৪৬টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে ১৮টিতে পিক আওয়ারে কোন বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়নি। কম বেশি গ্যাস সংকট ছিল গ্যাস নির্ভর ২৩টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে।

সোমবার রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ঘন ঘন বিদ্যুৎ চলে যাওয়ার খবর গণমাধ্যমে এসেছে। ঢাকার দুই বিতরণ কোম্পানি জানিয়েছে, সব মিলিয়ে তাদের ৩০০ মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুৎ ঘাটতি হচ্ছে। ঘাটতি মেটাতে এলাকা ভেদে ৩০ মিনিট করে লোডশেডিং করা হচ্ছে।

মিরপুর-১২ থেকে রাতুল হোসেন ভোক্তাকণ্ঠকে বলেন, ‘গতকাল (সোমবার) কয়েকবার বিদ্যুৎ গেছে। রাতে বিদ্যুৎ যাওয়ার পরে তো গরমে চরম কষ্ট করতে হয়েছে। গত কয়েক বছরের মধ্যে ঢাকায় এমন লোডশেডিং দেখিনি। গ্রামের বাড়িতে ফোন দিয়েছিলাম সেখানে তো আরও খারাপ অবস্থা।’

বাংলাদেশ সরকারের ন্যাশনাল লোড ডেসপাচ সেন্টারের হিসাবে, সোমবার সারাদেশে ১৪ হাজার মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে সর্বোচ্চ ১২ হাজার ৮১৮ মেগাওয়াট উপাদনের পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। সোমবার চাহিদার তুলনায় প্রায় ৯ শতাংশ কম বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়, যা লোড ব্যবস্থাপনার (লোডশেডিং) মাধ্যমে সমন্বয় করতে হচ্ছে।

তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ কর্পোরেশনের (পেট্রোবাংলা)’ দৈনিক গ্যাস প্রতিবেদনে সোমবার বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর চাহিদার মাত্র ৪০ শতাংশ সরবরাহের পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে।

এতে সোমবার বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর জন্য চাহিদা ধরা হয়েছে দুই হাজার ২৫২ মিলিয়ন ঘন ফুট গ্যাসের। কিন্তু এর বিপরীতে গ্যাস সরবরাহ করা যাবে ৯১৩ মিলিয়ন ঘনফুট।

সোমবার সারাদেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি লোডশেডিং ধরা হয়েছে রংপুর অঞ্চলে। ওই অঞ্চলে চাহিদা ও সরবরাহে ১৯ শতাংশ ঘাটতি রয়েছে। এরপর চট্টগ্রামে ১২ শতাংশ, সিলেট ও ময়মনসিংহে ১১ শতাংশ করে, রাজশাহীতে ১০ শতাংশ, ঢাকা ও কুমিল্লা অঞ্চলে ৮ শতাংশ করে ঘাটতি দেখানো হয়েছে। তবে খুলনা ও বরিশাল অঞ্চলে চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে কোনও কমতি দেখানো হয়নি।

পিডিবির হিসাবে, ১৫২টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের স্থাপিত উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ২২ হাজার মেগাওয়াট। এর মধ্যে ভারত থেকে আমদানি করা বিদ্যুৎ রয়েছে ১ হাজার ১৬০ মেগাওয়াট। তবে ক্যাপটিভসহ মোট উৎপাদন ক্ষমতা ধরা হয় সাড়ে ২৫ হাজার মেগাওয়াটের মতো।

এর মধ্যে গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ৫১ শতাংশ, তেলভিত্তিক এইচএফও ও এইচডিও কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা প্রায় ৩৪ শতাংশ। কয়লা থেকে প্রায় ৮ শতাংশ, আমদানি থেকে ৫ শতাংশ বিদ্যুৎ আসে। বাকিটা পূরণ করে সৌর ও পানিভিত্তিক নবায়নযোগ্য জ্বালানি।

তবে শতভাগ বিদ্যুতের দেশের এ নাজুক পরিস্থিতির জন্য সরকারের জ্বালানি নীতিকেই দোষারোপ করছেন জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ নিয়ে কাজ করা একাধিক বিশেষজ্ঞ। তাদের মতে, সরকার দেশের ভূ-গর্ভে গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য নতুন করে সার্ভে করছে না। প্রাকৃতিক সম্পদের খোঁজে তারা সমুদ্রেও অনুসন্ধান করছে না। অথচ এখান থেকে প্রাকৃতিক সম্পদ পাওয়ার জোরালো সম্ভাবনা রয়েছে। তারা শুধু আমদানি নির্ভরতা বাড়াচ্ছে।

এ বিষয়ে তেল গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী কল্লোল মোস্তফা ভোক্তাকণ্ঠকে বলেন, ‘বিদ্যুতের লোডশেডিংয়ের জন্য অতিমাত্রায় গ্যাস আমদানি নির্ভরতাই দায়ী। কারণ একটা দেশের বিদ্যুৎ জ্বালানীতে উন্নয়নের জন্য প্রথমেই অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ক্ষমতা বাড়াতে হয়। কিন্তু আমাদের দেশে সেটা না করে আমদানি নির্ভরতা বাড়ানো হয়েছে। যার কারণে এই কঠিন পরিস্থিতির ফল ভোগ করতে হচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ইস্যুতে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম বেড়ে গেছে। যে কারণে ৩৫ ডলারে এলএনজি আমদানি করতে হচ্ছে। এছাড়াও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনের দিকেও গুরুত্ব দিচ্ছে না সরকার। অথচ বর্তমান যুগে নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদন বাড়ানো অতীব জরুরী।’

তিনি আরও বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজার কখনো স্থিতিশীল থাকবে আবার কখনো অস্থিরতা থাকবে। তাই যে দেশ শুধু আন্তর্জাতিক বাজারের উপর নির্ভর করবে, স্বাভাবিক ভাবেই তাদের বিভিন্ন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে। আর আমাদের দেশে যেহেতু স্থলভাগ-সমুদ্রভাগ মিলে (খনিজ) পরীক্ষা করার সুযোগ রয়েছে। তাই প্রথমেই এই দিকে নজর দেয়া দরকার। কিন্তু সরকার তা করছে না।’

পিডিবির উপসচিব (উৎপাদন) হেলালুর রহমান বলেন, ‘সরকারি পাওয়ার প্লান্টগুলোতে গ্যাসের সরবরাহ কমে গেছে। বাধ্য হয়েই গ্যাস নির্ভর অনেক পাওয়ার প্লান্ট বন্ধ রাখতে হচ্ছে। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে যাওয়ার কারণে সারাদেশে পরিমিত মাত্রায় কিছু লোডশেডিং হচ্ছে।’