বঙ্গবন্ধুর নীতির বিপরীতে চলছে জ্বালানি খাত

ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: আজ ৯ আগস্ট, জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তা দিবস। জ্বালানির সাশ্রয়ী ব্যবহারের লক্ষ্যে ২০১০ সালের ১২ আগস্ট মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এক পরিপত্রে ৯ আগস্টকে জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

দিবসটির তাৎপর্য হচ্ছে, ১৯৭৫ সালের এই দিনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শেল অয়েল কোম্পানির কাছ থেকে ৪৫ লাখ পাউন্ড স্টার্লিংয়ে (তখনকার ১৭ কোটি ৮৬ লাখ টাকা) পাঁচটি গ্যাসক্ষেত্র রাষ্ট্রীয় মালিকানায় কিনে নেন। ক্ষেত্রগুলো হচ্ছে- তিতাস, বাখরাবাদ, রশিদপুর, হবিগঞ্জ ও কৈলাসটিলা। এরপর এই গ্যাসক্ষেত্রগুলো দেশের জ্বালানি নিরাপত্তার বড় নির্ভরতা হয়ে ওঠে।

তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমানে দেশে জ্বালানির যে পরিস্থিতি এবং জ্বালানি যে নীতিতে পরিচালিত হচ্ছে, তা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। বঙ্গবন্ধুর গৃহীত জ্বালানি নীতির সঙ্গে বর্তমানে পরিচালিত জ্বালানি ব্যবস্থার কোনো মিল নেই। সে কারণে দিবসটি শুধু শুধু পালনেরও কোনো অর্থ নেই।

বিশ্বজুড়ে নানামুখী সংকটের মাঝে জ্বালানি তেল নিয়ে দেশেও অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। এ পরিস্থিতির কারণে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তার বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় এসেছে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের গত ২৭ জুলাইয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে ডিজেল মজুত রয়েছে চার লাখ ৩১ হাজার ৮৩৫ মেট্রিক টন। দৈনিক গড় বিক্রি ১৩ হাজার ৬০৭ মেট্রিক টন হিসেবে ৩২ দিনের; জেট-এ-১ মজুত রয়েছে ৪৪ দিনের ও ফার্নেস অয়েল মজুত রয়েছে ৩২ দিনের। পেট্রল পুরোটাই বাংলাদেশ উৎপাদন করে আর অকটেনের চাহিদার প্রায় ৪০ ভাগ উৎপাদন করে বাংলাদেশ।

এসব নিয়ে আলোচনার মধ্যেই গত ৫ আগস্ট ডিজেল, পেট্রল, কেরোসিন, ও অকটেনের  দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেওয়া হয়। প্রতি লিটার ডিজেলে ৩৪, কেরোসিনে ৩৪, অকটেনে ৪৬, পেট্রলে ৪৪ টাকা দাম বেড়েছে।

যদিও জ্বালানির এমন অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণ হিসেবে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ জানিয়েছে, বৈশ্বিক বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য বাংলাদেশের তুলনায় অনেক বেশি হওয়ার কারণে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি), ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডে (ইআরএল) পরিশোধিত এবং আমদানি করা ডিজেল, কেরোসিন, অকটেন ও পেট্রলের মূল্য সমন্বয় করা হয়েছে।

তবে বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবদরা বলছেন, জ্বালানি নীতিতেই গলদ দেখা যাচ্ছে। এ কারণে আজকের এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, বঙ্গবন্ধু যে জ্বালানি নীতি প্রণয়ন করেছিলেন, সেটি সংবিধানের সঙ্গে সমন্বয় করে, সামঞ্জস্য রেখে প্রণীত। কিন্তু বর্তমানে যেভাবে পরিচালিত হচ্ছে, সেটি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও বিপরীতমুখী। এ কারণে জ্বালানি নিরাপত্তা দিবস পালন করা প্রহসনমূলক বলে আমি মনে করি।

তিনি বলেন, সে সময়ে জ্বালানি খাতকে একটি সেবামূলক খাত হিসেবে তৈরি করা হয়েছিল। কথা ছিল এটি কোনো বাণিজ্যিক খাত হবে না। কিন্তু বর্তমানে এটি বাণিজ্যিক খাত হিসেবে পরিণত হয়েছে, ব্যক্তি মালিকানা, ব্যক্তি প্রতিষ্ঠান বণিজ্য করে যাচ্ছে এই খাতে। যা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। অতএব দিনটিকে ঘটা করে পালন করে মানুষকে সাংঘর্ষিক বিষয়টা বার বার মনে করিয়ে দেওয়ার মধ্যে কী যৌক্তিকতা আছে, তা আমার জানা নেই।

বর্তমান জ্বালানি নীতি  উৎপাদনমুখী নয় বরং আমদানি নির্ভর যা একেবারেই ভুল সিদ্ধান্ত, এমন মন্তব্য করেছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক বদরুল ইমাম।

তার দৃষ্টিতে বর্তমান জ্বালানি পরিস্থিতির মূল্যায়ন জানতে চাইলে অধ্যাপক বদরুল ইমাম বলেন, আমি আর ‘মার্কস’ কী দেবো? বছরের পর বছর ‘মার্কস’ দিয়ে আসছি, আমার কথা কেউ শোনে না।

তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু দেশের জ্বালানি খাতকে সমৃদ্ধ করতে বিদেশিদের কাছ থেকে পাঁচটি গ্যাস ফিল্ড কিনে নিয়েছিলেন। তার নীতি ছিল নিজেরা ফিল্ড কিনে সেটার মাধ্যমে নিজেরা গ্যাস উৎপাদন করবো। কিন্তু এখন তো তার উল্টো হচ্ছে। উৎপাদনমুখী না হয়ে বরং অন্যের উৎপাদিত জ্বালানি আমরা আমদানি করছি। এটি একেবারেই ভুল সিদ্ধান্ত।

‘আমরা আমাদের নিজস্ব জ্বালানি খাতকে দীর্ঘদিন ধরে অবহেলা করেছি। এই খাতে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা দুর্নীতি করে নিজেদের পেট বড় করেছেন। আমরা তারপর নিজেদের সংকট মেটাতে এলএনজির বাজারে ঢুকে গেছি। অথচ গিয়ে দেখি এলএনজির এতটাই মূল্য যে, আমাদের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। এ কারণে ভর্তুকি দিতে গিয়ে অর্থনীতিতে বড় একটি ধাক্কা লেগেছে। আমরা কয়লা উত্তোলন বাদ দিয়ে শতভাগ আমদানির দিকে চলে যাচ্ছি। নীতিগতভাবেই এটা ভুল সিদ্ধান্ত।’

বর্তমান জ্বালানি পরিস্থিতিকে পরিবর্তন করতে বিপরীত পথে হাঁটার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, আমরা এখন যে পথে হাঁটছি, এই পথে আমদানি নির্ভরশীল হচ্ছি। আমাদের তার বিপরীতে গিয়ে উৎপাদনের পথে হাঁটতে হবে। ভবিষ্যৎটা কীভাবে যাবে সেটি আমাদের ভাবতে হবে। দেশীয় গ্যাসকে ওঠানোর জন্য সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালাতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক বলেন, আমাদের দেশটা বৈজ্ঞানিকভাবেই গ্যাস সমৃদ্ধ। এটাকে অস্বীকার যে করে, সে বিজ্ঞানের সঙ্গে নেই। এটা আন্তর্জাতিকভাবে মূল্যায়নও হয়েছে। ইউনাইটেড স্টেট জিওলজিক্যাল সার্ভে বা যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ প্রতিষ্ঠান। এরা পেট্রোবাংলার সঙ্গে জরিপ করে ৬০ শতাংশ সম্ভাবনা দেখিয়েছিল, ৩২ টিসিএফ গ্যাস বাংলদেশে এখনো পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। অন্যদিকে নরওয়ের সরকারি তেল-গ্যাস কোম্পানি আমাদের জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যৌথ জরিপে জানিয়েছে এটা ৩২ টিসিএফ নয় বরং পাওয়ার সম্ভাবনা ৪২ টিসিএফ গ্যাস। তারা বলেছে ১০ টিসিএফ গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা ৯০ শতাংশ। বাংলাদেশ প্রতি বছর এক টিসিএফ গ্যাস খরচ  করে। তাহলেও তো আমাদের ১০ বছরের গ্যাস আমরা নিশ্চিত পেয়ে যাচ্ছি।

একই কথা বলেন ঢাকার মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির সহযোগী অধ্যাপক ড. আমিরুল ইসলাম। বাংলাদেশের পেট্রলিয়াম খাত নিয়ে বিস্তর গবেষণা তার।

তিনি বলেন, স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে দেশের জ্বালানি ব্যবস্থার উন্নয়নে বঙ্গবন্ধু পাঁচটি গ্যাস ফিল্ড কেনার মধ্য দিয়ে যে পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, সেটি ছিল যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত। কিন্তু তারপর থেকে এ পর্যন্ত জ্বালানি খাতকে এগিয়ে নিতে উল্লেখযোগ্য কোনো উদ্যোগই নেওয়া হয়নি। বঙ্গবন্ধু যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন, তার পরবর্তী সময় থেকে বর্তমান পর্যন্ত বিবেচনা করলে দেখা যায়, তখন ওই পদক্ষেপ না নিলে আজকে বাংলাদেশের অবস্থা থাকতো ভয়াবহ। জাগো নিউজ।