ব্যয় কমিয়ে বিদ্যুতের ঘাটতি কমানোর ‘অনেক সুযোগ রয়েছে’

ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: বিদ্যুতের দাম পাইকারি হারে ৬৫ দশমিক ৫৭ শতাংশ বাড়ানোর জন্য বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের প্রস্তাবের বিপরীতে গত ১৮ মে গণশুনানি করে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন। শুনানিতে কমিশনের কারিগরি টিম ৫৭ দশমিক ৮৩ শতাংশ বাড়ানোর জন্য সুপারিশ করে। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের বাড়ানোর প্রস্তাব ও বিইআরসির কারিগরি টিমের সুপারিশ দুটোই প্রত্যাখ্যান করেছে কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ (ক্যাব)।

ক্যাবের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রফেসর ড. এম শামসুল আলম বলেন, ‘পাইকারি বিদ্যুৎ সরবরাহের বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যয় কমিয়ে ঘাটতি কমানোর কোন কৌশল প্রস্তাব করা হয়নি। কেবল মূল্যহার বৃদ্ধি দ্বারা ঘাটতি সমন্বয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে।

ব্যয় কমিয়ে ঘাটতি কমানোর কী কোন সুযোগ নেই নিজের এমন প্রশ্নে, নিজেই উত্তর দেন ‘অনেক সুযোগ রয়েছে’।

এসব কারণ দেখিয়ে যদি বলা হয়, আমরা বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে দেব। তাহলে তো হবে না। তাহলে ভর্তুকি দাও। এ বাড়ানো গ্রহণযোগ্য নয়। সরকারই করিয়েছে এগুলো। সেটার কারণে এখন বিদ্যুতের দাম বেড়ে যাচ্ছে। এখন ভর্তুকি তো দিতেই হবে। তা না হলে জনগণের ওপর চাপিয়ে দাও।

ক্যাবের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দরপতন বছরের পর বছর অব্যাহত থাকে। সে দরপতন অভ্যন্তরীণ বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্যে সমন্বয় না করায় বিপিসির প্রায় ৪৩ হাজার কোটি টাকা মুনাফা আছে। অন্যদিকে মুনাফায় থাকা সত্ত্বেও দফায় দফায় গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি অব্যাহত থাকে। এই মুনাফার অংশ যদি বিদ্যুতে ভর্তুকি দেওয়া হয়, তবে দাম না বাড়িয়েও বিদ্যুৎ উৎপাদনে যে জ্বালানি খরচে ব্যয় হয় তা সমন্বয় করা সম্ভব।

পিডিবির প্রস্তাব পর্যালোচনা করে ক্যাব জানায়, বিদ্যুৎ উৎপাদন প্ল্যান্টসমূহ ইকুইটি বিনিয়োগের ওপর পিডিবি ৩ শতাংশ, পাবলিক কোম্পানি ১২ শতাংশ এবং যৌথ মালিকানা কোম্পানি ১৬ শতাংশ রেকর্ড অব রাইটস (আরওআর) পায়। ব্যক্তি মালিকানাধীন আইপিপি, এসআইপিপি, রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল প্ল্যান্টের বিনিয়োগ সংক্রান্ত কোন তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে ধারণা করা যায়, এসব প্ল্যান্টের ইকুইটি বিনিয়োগের ওপর আরওআর ১৮ শতাংশের কম হবে না। বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্পসমূহের পণ্যসামগ্রী আমদানির জন্য পাঠানো অর্থ সংক্রান্ত কোন তথ্যও পাওয়া যায়নি। ফলে সে অর্থের কতটা পণ্য ক্রয়ে ব্যয় এবং কতটা পাচার হয়েছে, তা খতিয়ে দেখা সম্ভব হয়নি। কারণ, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের ক্যাপাসিটি চার্জ বেড়ে যাওয়ার অনেকটাই কারণ দুর্নীতি।

এদিকে, পিডিবির প্রস্তাব ও বিইআরসির কারিগরি কমিটির সুপারিশ দুটোরই সমালোচনা করেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সাবেক ডিন অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসাইন।

তিনি বলেন, পিডিবি যেভাবে চলে, তারা তাদের নিজেদের মতো করে সেভাবেই প্রস্তাবনা দিয়েছে। যার মধ্যে কিছুটা গোলমাল আছে। তবে, তারা তো বেশি টাকা আদায় করার কোন ফর্মুলা দেয়নি। তারা তাদের যা খরচ, তা তুলে ধরে প্রস্তাবনা দিয়েছে। যে খরচের মধ্যে গোলমাল করেছে সরকার নিজেই। অন্যদিকে বিইআরসিরও কিছুটা গরমিল আছে।

পাইকারি বিদ্যুৎ সরবরাহের বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যয় কমিয়ে ঘাটতি কমানোর কোন কৌশল প্রস্তাব করা হয়নি। কেবল মূল্যহার বৃদ্ধি দ্বারা ঘাটতি সমন্বয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে। ব্যয় কমিয়ে ঘাটতি কমানোর কী কোন সুযোগ নেই নিজের এমন প্রশ্নে, নিজেই উত্তর দেন ‘অনেক সুযোগ রয়েছে’।

ড. ইজাজ হোসাইন বলেন, ‘সরকার যেটা করেছে, তারা বিভিন্ন জায়গায় ট্যাক্স বসিয়ে প্রায় এক টাকার মতো দাম এমনিতেই বাড়িয়ে দিয়েছে। এখন তো তেলের দাম বেড়েছে। এক সময় তো তেলের দাম কম ছিল। তারা তেলের ওপর ট্যাক্স বসাচ্ছে, আমদানির ওপর ট্যাক্স বসাচ্ছে। আবার বিদ্যুতের ওপর ট্যাক্স বসাচ্ছে। যে কারণে একটা পণ্যে তিন বার ট্যাক্স বাড়ছে। এতে প্রায় এক টাকার মতো সরকার বিভিন্ন ট্যাক্স বলে নিয়ে নিচ্ছে। এক টাকা কিন্তু এখান থেকেই কমানো যায়। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, আমাদের হাতে গ্যাস নেই। গ্যাস কিনেই আমাদের চলতে হচ্ছে। আমাদের সাশ্রয়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র, সেগুলো চলে গ্যাসে। তাহলে সেগুলো চলবে কী করে।’

বেসরকারি উদ্যোগে পাওয়ার প্ল্যান্ট না বাড়ানোর পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রাইভেট সেক্টরের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো যদি না ব্যবহার করতো। সেগুলোর দাম তো এমনিতেই বেশি। আমি গ্যাস, বিদ্যুৎ পাওয়ার প্ল্যান্ট এতগুলো বানালাম, কিন্তু আমি চালাতে পারলাম না। তাহলে তো সমন্বয় হবে না।’

প্রজেক্ট বাড়িয়ে ওভার ক্যাপাসিটির সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে ড. ইজাজ হোসাইন বলেন, ‘আরেকটা হলো আমাদের ওভার ক্যাপাসিটি। পিডিবিরও করার কিছু নেই। কারণ, একদম টপ লেভেল থেকে এই প্রজেক্টগুলো আসে। যতো হয় ততো প্রজেক্ট বাড়াও। আমরা দেখাবো, আমাদের সক্ষমতা ২০ হাজার মেগাওয়াটের ওপর চলে গেছে। যেহেতু আমাদের সর্বোচ্চ ১৪ হাজার মেগাওয়াট একদিনে। বেশির ভাগ সময় এর নিচেই থাকে। এরই মধ্যে ২২ হাজার মেগাওয়াট পূর্ণ সক্ষমতা কমপ্লিট রয়েছে। আমরা জেনারেট করছি ১১ হাজার মেগাওয়াট অথচ আমার টপে আছে ২২ হাজার মেগাওয়াট। আমার অনেক পাওয়ার প্ল্যান্ট আছে, যাদের বসিয়ে বসিয়ে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হচ্ছে। ক্যাপাসিটির জন্য দেখা যাবে আরও এক টাকা বেড়ে যায়।’

তিনি বলেন, ‘আমি দেখলাম পিডিবি যেটা বাড়ানোর কথা বলেছে, সেটা কিন্তু বাড়াতে হয় না। হয়তো সর্বোচ্চ ১০ কিংবা ২০ শতাংশ বাড়ানো লাগতে পারে।’

বিইআরসির কারিগরি টিমের সুপারিশ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি পুরোপুরি পিডিবির দোষ বলব না। বিইআরসির মূল্যায়ন কী। পিডিবি যেভাবে করেছে, বিইআরসিও ঠিক সেভাবেই করেছে। ওদের একই ফর্মুলা। এটা তাদের একটা বড় দুর্বলতা। বিইআরসির দায়িত্ব হলো ধমক দেওয়া। তারা কেন শুধু একটা হিসাব ধরে নেবে। তারা কেন বিবেচনা করবে যে, এরা তো সরকারের কাছ থেকে এসেছে, আমরা তো শক্ত হতে পারবো না। কিন্তু তাদের তো শক্ত হওয়া দরকার। তারা ফিক্সড হয়ে বেঁধে দেবে তোমরা এতো মেগাওয়াটের বেশি কেন উৎপাদন করলে। তোমাদের আর করতে দেওয়া হবে না। কিন্তু আমাদের তো এভাবে চলে না। বিইআরসি এভাবে সক্ষমতা কখনোই প্রয়োগ করেনি।’

বিইআরসিকে আরও শক্ত ভূমিকা নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে ড. ইজাজ হোসাইন বলেন, ‘তাদের যদি বিচার-বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নিতে হতো, তাহলে আরও পাঁচ বছর আগে থেকেই এ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হতো। চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে এমন অবস্থা। প্রাইভেট সেক্টরে এতো পাওয়ার প্ল্যান্ট করার দরকার কী। বিইআরসি যদি শক্ত হতো, তাহলে পাঁচ হাজার মেগা বিদ্যুৎ কম হতো। তারা যদি প্রশ্ন করতো এতো জ্বালানি খরচ করে কেন উৎপাদন ব্যয় বাড়াচ্ছ, তাহলেই কিন্তু অতিরিক্ত উৎপাদন সক্ষমতা বন্ধ হতো।

প্রয়োজনের চাইতে উৎপাদন সক্ষমতা না বাড়িয়ে বরং নিয়মতান্ত্রিক ভাবে লোডশেডিংকে সমর্থন করে তিনি বলেন, ‘আমি যদি নিয়মিত লোডশেডিং করতে পারতাম তাহলে ১ টাকা বাঁচাতে পারতাম। সারাদেশে যদি আমরা সবাইকে জানিয়ে সুন্দর ভাবে নিয়মমতো এক ঘণ্টা লোডশেডিং করি, যদিও সবাইকে একটু কষ্ট করতে হবে। কিন্তু আমরা ১ টাকা বাঁচাতে পারতাম। এই দুঃসময়ে এটা করা যেতে পারতো।’