জ্বালানি উন্নয়নে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে

ভোক্তাকণ্ঠ রিপোর্ট: বায়ুমান ও জ্বালানি উন্নয়নে জীবাশ্ম জ্বালানির বিকল্প হিসেবে নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। নবায়নযোগ্য শক্তির প্রসার বায়ুমান ও জ্বালানি উন্নয়নে কার্যকরী ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

তারা বলছেন, বায়ু দূষণ একটি বৈশ্বিক সংকটে পরিণত হয়েছে, যা মানবজীবন ও পৃথিবী উভয়ের স্বাভাবিকতাকে ধীরে ধীরে হুমকির মুখে ফেলছে। জীবাশ্ম জ্বালানি দহন, শিল্প নির্গমন, এবং যানবাহনের দূষণ এই বিপদের জন্য প্রাথমিক ভাবে দায়ী। নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের মাধ্যমে আমরা বায়ুতে নির্গত ক্ষতিকারক দূষকের পরিমাণ হ্রাস করতে পারি এবং মানব স্বাস্থ্য এবং পরিবেশের উপর বায়ু দূষণের প্রভাব হ্রাসও করতে পারি।

সোমবার বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) হলে বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) এবং বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) এর যৌথ আয়োজনে ‘বায়ুমান এবং জ্বালানী উন্নয়নে নবায়নযোগ্য শক্তির ভূমিকা’ বিষয়ক একটি গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এসব কথা বলেন।

বিআইপি’র প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ ফজলে রেজা সুমনের সভাপতিত্বে উক্ত গোলটেবিল বৈঠকে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী হাবিবুন নাহার।

বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বেলা’র প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, ইন্সটিটিউট অব আর্কিটেক্টস বাংলাদেশ (আইএবি) এর ভাইস প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী নকী এবং ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশ এর সমন্বয়ক শরীফ জামিল এবং বিআইপি এর উপদেষ্টা পরিষদের আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. মো. আকতার মাহমুদ।

গোলটেবিল বৈঠকে মূল বক্তব্য প্রদান করেন বায়ুমন্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার।

তিনি বলেন, বায়ুমান ও জ্বালানি উন্নয়নে জীবাশ্ম জ্বালানির বিকল্প হিসেবে নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। সৌর, বায়ু ও জলবিদ্যুৎ শক্তির মতো নবায়নযোগ্য শক্তি প্রযুক্তির অন্যতম প্রধান সুবিধা হল বায়ুমন্ডলে ক্ষতিকারক গ্রিনহাউস গ্যাস ও বায়ুর দূষক নিঃসরণ ছাড়াই বিদ্যুৎ উৎপাদন করার ক্ষমতা। তিনি তার বক্তব্যে দেশে বায়ুমান উন্নয়নে চারটি সুপারিশ প্রদান করেন যথা- (১) বায়ু দূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা-২০২২ এ বস্তুকণা ২ দশমিক ৫ এর পূর্ববর্তী মান প্রতি ঘন মিটারে ১৫ মাইক্রোগ্রাম বজায় রাখা (২) উন্নয়ন সহযোগিতা প্রদানকারী দেশগুলো নিজ দেশে যেভাবে তাপবিদ্যুৎ উৎপাদনে ইমিশনের মাত্রা বজায় রাখে একই ভাবে বাংলাদেশেও তাপবিদ্যুৎ উৎপাদনে ইমিশনের মাত্রা বজায় রাখা (৩) পরিবেশ অধিদপ্তর কর্তৃক প্রণীত বায়ু দূষণ নির্দেশিকার ১৬ নং পৃষ্ঠার ১৯ নং ক্রমে উল্লেখিত কম সালফারযুক্ত (৫০ পিপিএম) ডিজেল আমদানি ও ব্যবহার নিশ্চিত করা (৪) সকল কয়লা, তেল ও গ্যাস ভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ প্লান্টকে পূর্বের মত লাল শ্রেণীভুক্ত রাখা।

নোঙর বাংলাদেশ ট্রাস্টের চেয়ারম্যান সুমন শামস বলেন, রাজউক বিল্ডিং প্ল্যানের নির্দেশনা সোলার প্ল্যান বসানো বাধ্যতামূলক। কিন্তু বাস্তবে এই সোলারগুলোর সঠিক ব্যবহার হচ্ছে না। এ ব্যাপারে সরকারকে সঠিক কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে।

পিওর আর্থ বাংলাদেশের প্রোগ্রাম ডিরেক্টর বাসুদেব চক্রবর্তী বলেন, লেড এসিড যুক্ত ব্যাটারি উন্মুক্ত স্থানে ফেলে রাখার কারণে এটি দীর্ঘ সময়ে বায়ুকে দূষিত করে। এই দূষিত বায়ু এর পার্শ্ববর্তী এলাকার শিশু ও গর্ভবতী মায়েদের স্বাস্থ্যের উপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।

সেন্টার ফর গ্লোবাল এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (সিজিইডি) নির্বাহী পরিচালক আব্দুল ওয়াহাব বলেন, বায়ুদূষণ একটি বৈশ্বিক সংকটে পরিণত হয়েছে। যা মানবজীবন ও পৃথিবী উভয়ের স্বাভাবিক তাকে ধীরে ধীরে হুমকির মুখে ফেলছে। জীবাশ্ম জ্বালানি দহন, শিল্প নির্গমন, এবং যানবাহনের দূষণ এই বিপদের জন্য প্রাথমিক ভাবে দায়ী।

ইন্সটিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) এর নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশ, তাই বায়ুকে দূষণমুক্ত রাখতে হবে। বায়ুদূষণ রোধে ও জ্বালানি নিরাপত্তায় নবায়নযোগ্য শক্তির কোনো বিকল্প নেই।

ইন্সটিটিউট অব আর্কিটেক্টস বাংলাদেশ (আইএবি) এর ভাইস প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী নকী বলেন, আমাদের অনেক বিধিমালা আছে কিন্তু বিধিমালা গুলোর মধ্যে সমন্বয় নেই।

বিআইপি এর উপদেষ্টা পরিষদের আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. মো. আকতার মাহমুদ বলেন, নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রসারের মাধ্যমে বায়ুমান উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকারের পাশাপাশি অন্যান্য গবেষণা সংগঠন, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং জনগণকে একযোগে কাজ করতে হবে।

ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশের সমন্বয়ক শরীফ জামিল বলেন, বায়ুদূষণ বর্তমানে বাংলাদেশে একটি মারাত্বক মানবিক বিপর্যয়ে পরিণত হয়েছে। এই বিপর্যয় থেকে পরিত্রান পেতে জৈব জ্বালানি ব্যবহার বন্ধ করে নবায়নযোগ্য শক্তিকে প্রমোট করতে হবে। বাংলাদেশে সৌর শক্তির অনেক সম্ভাবনা রয়েছে আমাদের এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হবে। এর জন্য আমাদের আচরণগত ও মানসিককতায় পরিবর্তন আনতে হবে।

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তর চাইলে একক ভাবে পরিবেশ উন্নয়নে কাজ করে শেষ করতে পারবে না। এর জন্য অন্যান্য মন্ত্রণালয়কেও সাহায্য করতে হবে। বিশ্বব্যাপী বায়ু দূষণের স্ট্যান্ডার্ড একই হওয়া উচিৎ। তবে দেশের পরিবেশের সার্বিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিজস্ব একটি রোডম্যাপ ও কার্যকর পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী হাবিবুন নাহার বলেন, আমরা আমাদের বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে বাতাসকে দূষিত করছি, তাই এখন আর আমরা বুক ভরে নিঃশ্বাস নেবার জন্য নির্মল বাতাস পাই না। শুধু সরকার একা কাজ করে এই দূষণ কমাতে পারবেনা। ব্যক্তি পর্যায়ে নবায়নযোগ্য শক্তি ব্যবহারে আগ্রহ দেখাতে হবে, দেশের নাগরিক হিসেবে সবাইকে সবার অবস্থান থেকে বায়ু দূষণ কমাতে সচেষ্ট হতে হবে এবং সরকারকে বায়ুমান ও জ্বালানির উন্নয়নে নির্ধারিত আইন প্রয়োগে সহযোগিতা করতে হবে।

সভাপতির বক্তব্যে বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) এর প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ ফজলে রেজা সুমন বলেন, বিধিমালায় দূষকগুলোর আদর্শমানগুলো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সঙ্গে মিল রেখে সংশোধনী জরুরী।

গোলটেবিল বৈঠকে আরও উপস্থিত ছিলেন বায়ুমন্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) এর গবেষক ইঞ্জি. মারজিয়াত রহমান, পরিবেশ উদ্যোগের গবেষণা সমন্বয়ক ইঞ্জি. নাছির আহম্মেদ পাটোয়ারী, বারসিক’র প্রকল্প পরিচালক মো. কামরুজ্জামান সাগর, একশন এইডের আবুল কালাম আজাদ, বিএনসিএ এর সদস্য সচিব মুহাম্মদ আনোয়ারুল হক, সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চ (সিথ্রিইআর) এর দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রফেশনাল মুমতাহিনা রহমান, সিজিইডি এর প্রেসিডেন্ট সরদার আলী বিশ্বাস, নোঙর ট্রাস্টের নির্বাহী পরিচালক ফজলে সানি এবং সেইভ ফিউচার বাংলাদেশের প্রধান সমন্বয়ক নয়ন সরকার।

এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন ক্যাপস গবেষণা সহকারী ও বিআইপি এর প্রতিনিধিরা।

-এসএম