রোগীর ‘গলা কেটে’ উপহারের টাকা উসুল

ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল মেডিকেল কলেজের মানসিক রোগ বিভাগের প্রধান ডা. মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন। এই চিকিৎসকের নামে ২০২২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি পাঁচ লাখ টাকার একটি চেক ইস্যু করে চট্টগ্রামের ওষুধ কোম্পানি এলবিয়ন ল্যাবরেটরিজ লিমিটেড। অ্যাকাউন্ট পেয়ি চেকটিতে এলবিয়নের পক্ষে সই করেন প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান রাইসুল উদ্দিন সৈকত। আল-আরাফাহ্‌ ইসলামী ব্যাংকের চট্টগ্রাম নগরের ও আর নিজাম রোড শাখার ওই চেকের নম্বর ৮৪৭৩১০৫। চেকটি ২০২২ সালের ০২ মার্চ নগদায়ন হয়েছে; অর্থাৎ ডা. গিয়াস উদ্দিনের অ্যাকাউন্টে ওই টাকা জমা হয়েছে।

একই চিকিৎসকের নামে ২০১৯ সালের ১০ জানুয়ারি আড়াই লাখ টাকার একটি (চেক নম্বর ৯৭৯০৪৮৬) এবং একই বছরের ৩০ জুলাই আড়াই লাখ টাকার আরও একটি চেক (নম্বর ১৬৩৪৪৮৬) ইস্যু করে এলবিয়ন। চেক দুটি আল-আরাফাহ্‌ ইসলামী ব্যাংকেরই চট্টগ্রামের মুরাদপুর শাখার।

মাত্র তিন দফায় একটি ওষুধ কোম্পানি থেকেই ১০ লাখ টাকার চেক পাওয়া চিকিৎসক গিয়াস উদ্দিনের দেওয়া দুটি প্রেসক্রিপশন এই প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, ২০২১ সালের ২৪ অক্টোবর একজন সিজোফ্রেনিয়া রোগীকে তিনি এলবিয়নের ওষুধ ‘কুইটিনিল ১০০ মিলিগ্রাম’ এবং একই বছরের ০৭ মার্চ আরেকজন রোগীকে এলবিয়নের ‘রিসলক ২ মিলিগ্রাম’ ওষুধ লিখে দিয়েছেন।

এফসিপিএস ডিগ্রিধারী ডা. মোহাম্মদ মাহমুদুর রহমান চৌধুরী চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। চট্টগ্রাম নগরের প্রবর্তক মোড় এলাকার ডায়াগনস্টিক সেন্টার শেভরণেও নিয়মিত রোগী দেখেন তিনি। এ চিকিৎসকের নামে ২০২১ সালের ২০ সেপ্টেম্বর তিন লাখ টাকার চেক ইস্যু করে এলবিয়ন। আল-আরাফাহ্‌ ইসলামী ব্যাংকের চট্টগ্রামের ও আর নিজাম রোড শাখার ওই চেকটির নম্বর ৭১৩১৯৮৮। চেকটি ২০২১ সালের ০৩ অক্টোবর নগদায়ন হয়েছে। এই চিকিৎসকের নামে ২০১৯ সালের ০৫ নভেম্বর একই কোম্পানির ইস্যু করা ২৪৯৭১৫৭ নম্বরের তিন লাখ টাকার আরেকটি অ্যাকাউন্ট পেয়ি চেক জমা হয় আল-আরাফাহ্‌ ইসলামী ব্যাংকের মুরাদপুর শাখায়।

চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের নেফ্রোলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. এম এ কাশেমের নামে ২০১৩ সালের ১৬ মার্চ ০৫ হাজার টাকার একটি চেক ইস্যু করে সান ফার্মা। সিটি ব্যাংক এনএ বাংলাদেশ, ঢাকার মতিঝিল শাখার ওই চেকের নম্বর ০৭৭২৮৭৭।

দীর্ঘদিনের নিবিড় অনুসন্ধানে দুই-চারটা নয়, গুনে গুনে ৬৫টি চেকের কপি আমাদের হাতে এসেছে, যেখানে কেবল এলবিয়ন এবং সান ফার্মা থেকেই চট্টগ্রাম অঞ্চলের সরকারি-বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের ‘বড় বড়’ ৪৩ জন চিকিৎসকের নামে মোট ৪৬ লাখ ৬৭ হাজার ৫০০ টাকা দেওয়ার তথ্য রয়েছে। এর মধ্যে ১৭ লাখ ৭২ হাজার টাকার চেক ইস্যু হয়েছে গত তিন বছরে (২০২২, ২০২১ ও ২০২০ সালে); আর বাকি ২৮ লাখ ৯৫ হাজার ৫০০ টাকা আট বছরে (২০১২ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে)। আর যাদের নামে চেক, তাদের মধ্যে এমবিবিএস থেকে শুরু করে এফসিপিএস ডিগ্রিধারী বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকও আছেন। এমনকি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের বিভিন্ন বিভাগের প্রধানরাও আছেন তালিকায়।

ডা. এ কে এম মহিউদ্দিন ভূঁইয়া নামে একজন চিকিৎসক দাবি করেছেন, এ রকম এক লাখ চেকের কপি তিনি দিতে পারবেন।

ওই চিকিৎসকরা কি ওষুধ কোম্পানি দুটির মালিকানার সঙ্গে যুক্ত? অনুসন্ধান বলছে, না; ওই ৪৩ জন চিকিৎসকের কেউই এলবিয়ন বা সান ফার্মার মালিকানার সঙ্গে যুক্ত নন। এলবিয়ন সম্পূর্ণ পারিবারিক মালিকানার এবং সান ফার্মা ভারতীয় মালিকানার প্রতিষ্ঠান। কোম্পানি দুটির ওয়েবসাইটেই এসব তথ্য রয়েছে।

বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের গত ০৪ জানুয়ারি প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্টস’-এর হিসাব অনুযায়ী, ২০২০ সালে দেশের মোট স্বাস্থ্য ব্যয়ের প্রায় ৬৯ শতাংশ ব্যক্তির পকেট থেকে খরচ করতে হয়, টাকার অঙ্কে যা প্রায় ৫৪ হাজার কোটি। আর এই স্বাস্থ্য ব্যয়ের ৬৪ দশমিক ৬ শতাংশই খরচ হয় ওষুধ কেনা বাবদ, টাকার অঙ্কে যা প্রায় ৩৬ হাজার কোটি।

চলতি বছরের ০৪ জানুয়ারি রাজধানীতে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্টসের এক কর্মশালায় স্বাস্থ্য সচিব ড. মু. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার বলেন, ‘প্রতিটি ওষুধ কোম্পানি চিকিৎসকদের অনেক দামি দামি গিফট দেয়। টিভি, ফ্রিজ, গাড়ি, ফ্ল্যাটসহ দামি গিফট বন্ধ করা গেলে ওষুধের দাম এমনিতেই কমে যাবে। এই প্রক্রিয়াটি বেশ বিতর্কিত। আমরা এটা খতিয়ে দেখব।’

তিন দফায় ১০ লাখ টাকার চেক পাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল মেডিকেল কলেজের মানসিক রোগ বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন সাগর এই প্রতিবেদককে গালিগালাজ করতে শুরু করেন। তিনি বলেন, ‘আমি কার কাছ থেকে চেক নেব, কার কাছ থেকে নেব না- সেটা আপনাকে বলতে হবে?… আপনি আমাকে ফোন করেন কেন?… ফাইজলামি পাইছেন! … ফালতু কোথাকার!’

২০২১ সালের ০৩ অক্টোবর চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন পদে যোগ দেন ডা. মো. ইলিয়াছ চৌধুরী। এর আগে তিনি চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ছিলেন। তার নামে ২০২১ সালের ০৫ এপ্রিল ৫০ হাজার টাকার অ্যাকাউন্ট পেয়ি চেক ইস্যু করে এলবিয়ন। আল-আরাফাহ্‌ ইসলামী ব্যাংকের চট্টগ্রামের মুরাদপুর শাখার ওই চেকের নম্বর ৫৬৬১৩৪১। একই দিন নগদায়নও হয়েছে চেকটি। আরও আগে ২০১৯ সালের ০৫ জানুয়ারি ডা. ইলিয়াছকে একই ব্যাংকের আরেকটি চেকে ৫০ হাজার টাকার দেয় ওই কোম্পানি, যার নম্বর ৯৭৯০৫৩৮।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের মানসিক রোগ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান ডা. মহিউদ্দীন এ শিকদারকে আড়াই লাখ টাকা করে মোট পাঁচ লাখ টাকার দুটি চেক দিয়েছে এলবিয়ন। আল-আরাফাহ্‌ ইসলামী ব্যাংকের মুরাদপুর শাখার এই দুটি চেকের নম্বর ২৫১৬৭৭৭ ও ২৫১৬৭৭৮। প্রথম চেকটি ২০২০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ও পরেরটি ওই বছরের ০৫ মার্চ ইস্যু করা।

খাগড়াছড়ি সদর হাসপাতালের সিনিয়র কনসালট্যান্ট (কার্ডিওলজি) ডা. সৈয়দুল আলম কোরাইশীর নামে ২০২১ সালের ০৫ এপ্রিল এক লাখ টাকার চেক (নম্বর ৫৬৬১৩৪৩) ইস্যু করে এলবিয়ন। আল-আরাফাহ্‌ ব্যাংকের মুরাদপুর শাখার সেই চেকটি ওই দিনই নগদায়ন হয়েছে।

ডা. মো. ইউসুফ ফারুকী পারভেজ ২০০৪ সালে চমেক থেকে এমবিবিএস পাস করে চেম্বার দেন বন্দরনগরীর রাহাত্তারপুলে এবং হাটহাজারীর আমান বাজারে। তিনি অসচ্ছল রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা করেন। এ জন্য ‘গরিবের ডাক্তার’ হিসেবে খ্যাতিও অর্জন করেছেন। তার মানবিকতা তুলে ধরে ‘Steadfast to his oath’ (নিজের শপথে অটল) শিরোনামে ২০২০ সালের ০৪ জুলাই একটি স্বনামধন্য ইংরেজি দৈনিক বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এমন একজন চিকিৎসককে ২০২২ সালের ০৬ মার্চ এক লাখ টাকার চেক দেয় এলবিয়ন। আল-আরাফাহ্‌ ব্যাংকের ও আর নিজাম রোড শাখার ওই চেকের নম্বর ৮৪৭৩১১৬। পর দিনই চেকটি নগদায়ন হয়।

চমেক হাসপাতালের রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের প্রধান ডা. সরোজ কান্তি চৌধুরীকে ২০১৯ সালের ১০ জানুয়ারি দেড় লাখ টাকার (নম্বর ৯৭৯০৪৫১); ২০১৯ সালের ০৮ অগাস্ট আরও দেড় লাখ টাকার চেক (নম্বর ১৬৩৪৪৮৯) দিয়েছে এলবিয়ন। দুটি চেকই আল-আরাফাহ্‌ ব্যাংকের মুরাদপুর শাখার।

একই হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. আশীষ দে’র নামে এলবিয়ন ২০২১ সালের ০৫ এপ্রিল এক লাখ টাকার চেক (নম্বর ৫৬৬১৩৪৪) ইস্যু করে, যা একই ব্যাংকের মুরাদপুর শাখায় পর দিন নগদায়ন হয়েছে। তার নামে একই কোম্পানির ২০১৯ সালের ১০ জানুয়ারি এক লাখ টাকার আরেকটি চেক (নম্বর ৯৭৯০৪৪৮) এবং ওই বছরের ০৮ অগাস্ট আরও এক লাখ টাকার চেক (নম্বর ১৬৩৪৪৮৮) ইস্যুর তথ্য পাওয়া গেছে।

এভাবে বিভিন্ন চিকিৎসককে এলবিয়নের দেওয়া ৫৮টি অ্যাকাউন্ট পেয়ি চেকের কপি পাওয়া গেছে। এর মধ্যে বিএনপিপন্থি চিকিৎসকদের সংগঠন ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ড্যাব)-এর কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি এবং ঢাকার ইবনে সিনা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. এ কে এম মহিউদ্দিন ভূঁইয়ার নামে ২০১৯ সালের ৪ এপ্রিল তিন লাখ টাকা; রাঙামাটি মেডিকেল কলেজের ইন্টারনাল মেডিসিনের সহকারী অধ্যাপক ডা. কামরুল হাসান লোহানীর নামে ৫০ হাজার করে এক লাখ; চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল সেন্টারের ভারপ্রাপ্ত প্রধান কর্মকর্তা ডা. মোহাম্মদ আবু তৈয়বের নামে ৫০ হাজার করে পাঁচ চেকে মোট আড়াই লাখ টাকা দিয়েছে এলবিয়ন।

এছাড়াও, ডা. কাজী মো. আবরার হাসান, ডা. প্রতীক চৌধুরী, ডা. মো. শাহ আলম, ডা. সফিউল আলম, ডা. দিলীপ চৌধুরী, ডা. মঈনউদ্দিন চৌধুরী, ডা. সুরজিৎ রায় চৌধুরী, ডা. সৈয়দ মো. সৈয়দুল বাশার, ডা. মনীশ সাহা রায়, ডা. দোদুল দাস, ডা. জীবন চন্দ্র দাস, ডা. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, ডা. মো. কামাল উদ্দিন আহমেদ, ডা. ইলিয়াস তালুকদার, ডা. মো. গিয়াস উদ্দিন চৌধুরী, ডা. রিয়াজ উদ্দিন চৌধুরী, ডা. মো. জহিরুল হক ভূঁইয়া, ডা. ইফতেখার রিয়াজ চৌধুরী, ডা. উম্মে হাবিবা রহমান, ডা. নাসরিন ফারজানা সনি, ডা. এমরুল হোসেন, ডা. সুমিত রায় চৌধুরী, ডা. নারায়ণ দাস, ডা. হামিদা ইয়াসমিন জেসি ও ডা. আবদুল্লাহর নামেও বিভিন্ন অঙ্কের টাকা দিয়েছে এলবিয়ন।

শুধু এলবিয়ন নয়, ডাক্তারদের হাতে অ্যাকাউন্ট পেয়ি চেক তুলে দিচ্ছে বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানি সান ফার্মাও। চট্টগ্রাম অঞ্চলের ডাক্তারদের দেওয়া সান ফার্মার সাতটি অ্যাকাউন্ট পেয়ি চেক আমাদের হাতে এসেছে। চেকগুলোর মধ্যে একটি ২০১২ সালে, বাকি ছয়টি ২০১৩ সালে ইস্যু করা।

চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের নেফ্রোলজি বিভাগের প্রধান ডা. এম এ কাশেমের মতো চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের কনসালট্যান্ট ডা. মো. সালাউদ্দিনের নামেও ২০১৩ সালের ১৬ মার্চ দুই হাজার টাকার চেক ইস্যু করেছে সান ফার্মা। এছাড়া ডা. শেখ মাহমুদুল হাসান, ডা. এ কে এম আফজাল, ডা. মো. কামরুজ্জামান, ডা. খালেদা আকতার ও ডা. মো. রাসেলের নামেও তাদের একই ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থেকে বিভিন্ন অঙ্কের চেক ইস্যু করেছে সান ফার্মা। তবে সান ফার্মার একজন কর্মকর্তা চাকরি ছেড়ে দেওয়ায় তিনি চেকগুলো আর ডাক্তারদের মাঝে বিলি করেননি বলে দাবি তার।

একটি ওষুধ কোম্পানির একজন পরিচালক নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে বলেন, ‘সাধারণত ওষুধ কোম্পানির প্রধান অ্যাকাউন্ট থেকে ডাক্তারদের চেকের মাধ্যমে টাকা দেওয়া হয় না। ডাক্তারদের নামে চেক ইস্যু করতে বিভিন্ন ব্যাংকের বিভিন্ন শাখায় ওই কোম্পানির নামে অনেকগুলো অ্যাকাউন্ট খোলা হয়। এসব কাজে ব্যাংকও যতটুকু সম্ভব গোপনীয়তা বজায় রাখে এবং কোম্পানিকে নানা কৌশলে সুরক্ষা দেয়। যেমন ডাক্তারদের চেক ক্লিয়ারিংয়ের বিস্তারিত তথ্য অনেক সময় অনলাইনে বা নিজেদের সার্ভারে রাখে না ব্যাংকগুলো। কিছু ক্ষেত্রে হিসাব বিবরণীতে অস্পষ্ট বিবরণ বা সাংকেতিক ভাষা ব্যবহার করা হয়। নির্দিষ্ট সময় পর এই অ্যাকাউন্টগুলো আবার বন্ধ করে দেওয়ার ঘটনাও ঘটে।’

তিনি বলেন, কিছু ওষুধ কোম্পানি আবার অন্য প্রতিষ্ঠানের নামে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলে ডাক্তারদের টাকা দেয়। আবার এমন কিছু ডাক্তার আছেন, যারা নিজেদের নামে না নিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে চেক ইস্যু করতে বলেন।

এ পরিচালকের কাছ থেকে আরও জানা যায়, ডাক্তারদের চেক দেওয়ার ক্ষেত্রে ওষুধ কোম্পানির একটা কৌশল হলো- ‘সেমিনার’ আয়োজন। তিনি বলেন, ‘কোনো কারণে প্রশাসন যদি আমার কাছে জানতে চায়, ডাক্তারদের কেন টাকা দিলাম? আমি বলব, ওনাদের নিয়ে আমরা সেমিনার করেছি। এই সেমিনারে অতিথি হওয়ার জন্য, বক্তব্য দেওয়ার জন্য বা অংশগ্রহণ করার জন্য টাকা দিয়েছি। এমনও ঘটে, ওই সেমিনার আদতে হয়ইনি বা হলেও নামকাওয়াস্তে।’

ঢাকাভিত্তিক বিশেষায়িত ফার্মাসিউটিক্যাল গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘ফোরপি মার্কেটিং কনসালট্যান্সি’র বরাত দিয়ে ইবিএল সিকিউরিটিজের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “২০১৬ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে ২০১৭ সালের ১৫ মার্চ পর্যন্ত সময়কালে স্কয়ার ফার্মা ৭৪.৮০%, ইনসেপ্টা ৫%, বেক্সিমকো ৫৩.৯০%, রেনেটা ৪৪.৭০% ও হেলথকেয়ার ৩৬.১০% ‘ডাক্তার রিচ’ করেছে। একই সময়ে ‘প্রেসক্রিপশন শেয়ার’ করেছে- স্কয়ার ১৩.৮০%, ইনসেপ্টা ৭.৩০%, বেক্সিমকো ৬.৩০%, রেনেটা ৪.৭০% ও হেলথকেয়ার ৩.৩০%।” প্রেসক্রিপশন শেয়ার বেশি হলে বিক্রিও বেশি হতে পারে বলে ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

এই টার্মগুলোতে আসলে কী বোঝায় জানতে চাইলে ওষুধ কোম্পানির কয়েকজন কর্মকর্তা ব্যাখ্যা দেন- আগে একজন ডাক্তার একটি কোম্পানির ওষুধ লিখতেন না। কিন্তু যোগাযোগ করার পর থেকে লেখেন। এখন ওই ডাক্তারের সঙ্গে কোম্পানির সম্পর্ক ভালো। এটাকে ‘ডাক্তার রিচ’ বলা হয়। আর ‘প্রেসক্রিপশন শেয়ার’ হচ্ছে- ধরা যাক, একজন ডাক্তার এক রোগীর প্রেসক্রিপশনে মোট ২ হাজার টাকার ওষুধ লিখলেন। কোন কোম্পানির কত টাকার ওষুধ লিখলেন- সেটা দেখার জন্য প্রেসক্রিপশনের ছবি তোলেন ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা। সেটাই ‘প্রেসক্রিপশন শেয়ার’। আর একটা আছে ‘ডাক্তার লিভ’। এটার অর্থ- অনেক সময় ডাক্তারদের মেডিকেল প্রমোশন অফিসাররা মোটরসাইকেল বা অন্য গাড়িযোগে চেম্বারে দিয়ে আসেন। ওষুধ কোম্পানির ভাষায় আরেকটা আছে- ‘সিটি’ বা ক্যাশ ট্রিটমেন্ট। প্রত্যেকটা কোম্পানি তার লভ্যাংশের একটি অংশ প্রতি মাসে ‘সিটি’তে বিনিয়োগ করে, অর্থাৎ ডাক্তারকে ক্যাশ টাকা দেয়।

২০১৯ সালে প্রকাশিত ‘বাংলাদেশের ওষুধ শিল্প’ শিরোনামে ইবিএল সিকিউরিটিজের একটি গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ‘২০১৮ সালে মার্কেটিং বা বিপণন খাতে স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের খরচ হয়েছে ৯৯ কোটি ৬০ লাখ টাকা, বেক্সিমকো ফার্মার ৪২ কোটি ৮০ লাখ, রেনেটার ৩৩ কোটি ৮০ লাখ, একমির ১৬ কোটি ৪০ লাখ ও ইবনে সিনার নয় কোটি ২০ লাখ টাকা।’

ওরিয়ন ফার্মার একজন বিপণন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘ডাক্তারদের অনারিয়াম সাপ্তাহিক, মাসিক, ত্রৈমাসিক, বার্ষিক- বিভিন্ন পদ্ধতিতে হয়। যার রোগী যত বেশি, তার অনারিয়ামও তত বেশি। যে ডাক্তার দিনে ২০০ রোগী দেখেন, সেই ডাক্তার কোম্পানির জন্য সোনার হরিণ। তাকে গাড়ি দিলে লস নাই। কার্ডিয়াক ডাক্তারদের গাড়ি, ফ্ল্যাট দেওয়া হয়। কেননা হার্টের ওষুধগুলো একবার লিখলে সারা জীবন খেতে হয় রোগীদের। তবে অনেক ডাক্তার আছেন, যারা কোম্পানির কোনো অনারিয়াম নেন না। শুধু ওষুধ সম্পর্কে তথ্য জানতে চান।’

ফ্ল্যাট, গাড়ি কোম্পানি কীভাবে কিনে দেয় জানতে চাইলে চট্টগ্রামভিত্তিক এক ওষুধ কোম্পানির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন পরিচালক বলেন, ‘কিনে দিলে তো প্রমাণ থেকে যাবে। তাছাড়া একসঙ্গে কোটি টাকা দিয়ে ফ্ল্যাট কিনে দেওয়াও নানা কারণে সম্ভব না। এ কারণে ডাক্তাররা ব্যাংক লোন নিয়ে ফ্ল্যাট, গাড়ি নিচ্ছেন। সেই লোন প্রতি মাসে শোধ করছে ওষুধ কোম্পানি। এ রকম অহরহ হচ্ছে।’

চট্টগ্রামে কর্মরত অপসোসিন ফার্মার একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, ‘চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে সিসিইউর কার্ডিওলজিতে প্রতিদিন অন্তত ৪০টি প্রেসক্রিপশনে আমাদের ওষুধ বিসলল থাকে। প্রতিদিন ৪০টি প্রেসক্রিপশন হলে বছরের ৩৬৫ দিনে ১৪ হাজার ৬০০টি প্রেসক্রিপশন। যে রোগী একবার বিসলল পাবেন, তিনি এক বছর, এমনকি আজীবন ওষুধটা সেবন করবেন। এই হিসাবে, বছরে শুধু চমেক হাসপাতালের কার্ডিওলজি থেকেই বিসলল কমপক্ষে সাড়ে চার কোটি টাকার সেল হয়। শুধু বিসললের জন্য বছরে ৫০ লাখ টাকা চমেকে ঢেলে দিলে সমস্যা কী?’

নাভানা ফার্মাসিউটিক্যালসের এক বিক্রয় প্রতিনিধি নাম গোপন রাখার শর্তে বলেন, ‘এখন টিভি, ফ্রিজ, এসি, গাড়ির মতো গিফটের চাহিদা ডাক্তারদের পক্ষ থেকেই ওষুধ কোম্পানিকে পাঠানো হচ্ছে। কোম্পানিগুলো সেসব ঘরে পৌঁছে দিচ্ছে। ভাতের চাল পর্যন্ত দিচ্ছে। ডাক্তারের চেম্বারের নামফলক, এসি, প্রেসক্রিপশন ছাপানো সবই করে দিচ্ছে ওষুধ কোম্পানি। তবে সব ডাক্তার এমন, তা-ও নয়। ভালো মানুষও আছেন, তবে সংখ্যাটা নগণ্য।’

‘আমরা জানতে পেরেছি, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সঙ্গে আপনাদের সমঝোতা স্মারক হয়েছে, যেখানে উল্লেখ আছে, ডাক্তারদের ব্যক্তিগত প্রয়োজনে ওষুধ কোম্পানি একসঙ্গে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা সহায়তা করতে পারে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, পাঁচ লাখ, তিন লাখ টাকাও ডাক্তারদের অহরহ দেওয়া হচ্ছে’- বিষয়টি তুললে বাংলাদেশ ওষুধ শিল্প সমিতির মহাসচিব এস এম শফিউজ্জামান বলেন, ‘এটা হয়। কেউ কেউ করে। এটা খারাপ বলতে পারব। কিন্তু নেতা হিসেবে আমি রি-অ্যাকশনও বেশি দিতে পারি না।’ তবে তিনি বলেন, বড় বড় কোম্পানিগুলো যা করে, ছোট কোম্পানিগুলোর সেই সুযোগ নেই; যার কারণে ডাক্তাররা মিডিয়াম কোম্পানির, ছোট কোম্পানিগুলোর ওষুধ তেমন একটা লেখেন না।’

বিএমএ সভাপতি ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন বলেন, ‘চেক দেওয়া হচ্ছে, এটা ঠিক। এটা কাম্য নয়। বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। কোম্পানিগুলো যেভাবে ডাক্তারদের মেনটেইন করছে, এটা খুবই অন্যায়। এভাবে করলে ডাক্তার তো আর ডাক্তার থাকে না।’

চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) ডা. মো. মহিউদ্দিন বলেন, ‘ওষুধ কোম্পানির কাছ থেকে ডাক্তারদের চেক নেওয়ার বিষয়টি নীতি-নৈতিকতাবিরোধী। দরকার হলে উপোস থাকব, চেক নেব কেন? এভাবে চেক নিলে চিকিৎসকদের মানসম্মান বলে কিছু থাকে?’ চেকের ফটোকপি পেলে সংশ্লিষ্ট ডাক্তারদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন বলে জানান তিনি।

ওষুধপণ্য বিপণনের বিধিমালার ১৯.১ ধারায় স্পষ্ট বলা আছে, ‘কোনো পণ্যের বিক্রি প্রসারের উদ্দেশ্যে চিকিৎসা পেশার সঙ্গে জড়িত কাউকে কোনো ধরনের উপহার বা আর্থিক প্রণোদনা দেওয়া বা তার প্রস্তাবও দেওয়া যাবে না।’

বিধিমালার ১৯.২ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো ঔষধপণ্যের বিক্রি প্রসারের উদ্দেশ্যে চিকিৎসা সেবায় জড়িতদের চিকিৎসার কাজে সহায়তা করে- এমন কিছু উপহার দেওয়া যাবে, তবে সেটা অযৌক্তিক রকমের দামি হতে পারবে না।’

অথচ ওষুধ কোম্পানি ও চিকিৎসকরা দামি উপহার দেওয়া-নেওয়ার মাধ্যমে সরকারি বিধিমালা লঙ্ঘনের মতো গুরুতর অপরাধও অবলীলায় করে চলেছেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ বুলেটিন ২০২০ অনুসারে, দেশে নিবন্ধিত চিকিৎসকের সংখ্যা এক লাখ আট হাজার। আর বিএমএ’র কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি ডা. শেখ শফিউল আজমের মতে, দেশে এখন বিএমডিসি’র নিবন্ধিত চিকিৎসকের সংখ্যা হবে এক লাখ ২০ হাজার।

অন্যদিকে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের বার্ষিক প্রতিবেদন ২০২১-২২ অনুযায়ী, দেশে ওষুধ প্রস্তুতকারী কোম্পানির সংখ্যা ২৯৫টি; এর মধ্যে চালু আছে ২২০টি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক আ ব ম ফারুক বলেন, আমাদের দেশে ওষুধের দাম বেশি হওয়ার পেছনে অনেক কারণ আছে। এর মধ্যে বড় কারণ ওষুধ কোম্পানিগুলোর অনৈতিক বিপণন নীতি। দেশে এটা প্রথম শুরু করেছিল মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলো। তারা ডাক্তারদের উপহার দিত। তাদের দেখাদেখি দেশি কোম্পানিগুলোও উপহার দেওয়া শুরু করে। পরে তারা এমন ভাবে শুরু করেছে যে, বিদেশিগুলো এখন পেছনে পড়ে গেছে। চিকিৎসকদের এভাবে ঘুষ দেওয়া বন্ধ করতে পারলে দেশে ওষুধ মিলত অনেক সস্তায়।’

বিএমএ সভাপতি ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনও অকপটে বলেন, ‘ডাক্তারদেরকে দেওয়া ওষুধ কোম্পানির গিফটের কারণেই ওষুধের দাম বাড়ছে।’

২০২১ সালের জুনে সরকারি প্রকাশনা ‘বাংলাদেশ উন্নয়ন সমীক্ষা’য় এক গবেষণা নিবন্ধে বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির ২৫ জন বিক্রয় প্রতিনিধির সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে পাওয়া তথ্য তুলে ধরে বলা হয়, ‘চিকিৎসকরা যাতে চিকিৎসাপত্রে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির ওষুধ লিখে দেন, সে জন্য তাদের পেছনে বিশেষ প্রণোদনা ব্যয়ও বিপণন ব্যয়ে অন্তর্ভুক্ত থাকে। এভাবে মার্কেটিং বা বিপণন বাবদ খরচ বেড়ে যায়, যা শেষতক ওষুধ ব্যবহারকারীদের ঘাড়েই চাপে।’

কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এর চেয়ারম্যান গোলাম রহমান বলেন, ‘ওষুধ প্রশাসনের হাতে এক সময় ২১৯ থেকে ২২০টি জরুরি ওষুধের মূল্য নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা থাকলেও এখন আছে মাত্র ১১৭টির। এর মাধ্যমে ইচ্ছামতো দাম বাড়ানোর সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে ওষুধ কোম্পানিগুলোকে। কিছু চিকিৎসকের মাধ্যমে তাদের ওষুধ রোগীদের প্রেসক্রিপশনে লেখানো; বিনিময়ে ওই চিকিৎসকদের অনৈতিক সুবিধা দিয়ে থাকে তারা। এতে যে টাকা খরচ হয়, তা ভোক্তাদের কাছ থেকেই তোলা হয়, যা সম্পূর্ণ অনৈতিক।’

২০২২ সালের ২৩ নভেম্বর ক্যাব আয়োজিত এক অনলাইন সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটির কোষাধ্যক্ষ মনজুর ই খোদা তরফদার বলেন, ‘সরেজমিন ফার্মেসিগুলোতে গিয়ে খুচরা ওষুধের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত ছয় মাসের ব্যবধানে প্যারাসিটামল সিরাপের দাম বেড়েছে ৭৫ শতাংশ। এছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক, গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন রোগের ওষুধের দাম বেড়েছে ১৩ থেকে ৩৩ শতাংশ।’

স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের মার্কেটিং বিভাগের সিনিয়র ম্যানেজার আসাদ উল্লাহও স্বীকার করেন, ‘ডাক্তারদের গিফট দেওয়ার ক্ষেত্রে যে খরচগুলো হয়, সেগুলো প্রমোশনাল কস্ট থেকে আসে। ওষুধের দামের সঙ্গে সেগুলোও অন্তর্ভুক্ত থাকে। ’

গ্যাস্ট্রিক-আলসারের একটি বহুল প্রচলিত ওষুধের জেনেরিক নাম ওমিপ্রাজল। এর একটি কাঁচামালের নাম ওমিপ্রাজল ৮.৫% পেলেট। এটি দিয়ে বেক্সিমকো ‘প্রোসেপটিন’, স্কয়ার ‘সেকলো’, অ্যারিস্টো ফার্মা ‘ওমেপ’, ইবনে সিনা ‘প্রলোক’, ড্রাগ ইন্টারন্যাশনাল ‘কোসেক’, ইনসেপ্টা ‘ওমেনিক্স’, নাভানা ‘ওমেটাক’, এসকেএফ ‘লোসেকটিল’ ২০ মিলিগ্রাম ক্যাপসুল তৈরি করে।

২০১৯ সালের ২২ জুলাই ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর অনুমোদিত একটি ‘ব্লক লিস্ট’ থেকে জানা যায়, ওমিপ্রাজল ৮.৫% পেলেটের দাম প্রতি কেজি ১২ ডলার (তৎকালীন প্রায় এক হাজার টাকা)। তাহলে সরল হিসাব দাঁড়াচ্ছে, এক কেজি কাঁচামাল দিয়ে ২০ মিলিগ্রাম ওমিপ্রাজল ক্যাপসুল তৈরি করা যাচ্ছে ৫০ হাজার পিস। আর খরচের হিসাব দাঁড়াচ্ছে এক হাজার টাকার কাঁচামাল দিয়ে ৫০ হাজার পিস ওষুধ তৈরি হলে একটি ওষুধে কাঁচামালের (সক্রিয় উপাদান) খরচ পড়েছিল দুই পয়সা।

এক কেজিতে হয় ১০ লাখ মিলিগ্রাম। তাহলে সরল হিসাব দাঁড়াচ্ছে, এক কেজি কাঁচামাল দিয়ে ২০ মিলিগ্রাম ওমিপ্রাজল ক্যাপসুল তৈরি করা যাচ্ছে ৫০ হাজার পিস। আর খরচের হিসাব দাঁড়াচ্ছে- ১ হাজার ৩১১ টাকার কাঁচামাল দিয়ে ৫০ হাজার পিস ওষুধ তৈরি হলে একটি ওষুধে কাঁচামালের (সক্রিয় উপাদান) খরচ আড়াই পয়সার একটু বেশি।

হিসাবটি তুলে ধরে মন্তব্য জানতে চাইলে একটি ওষুধ কোম্পানির কাঁচামাল আমদানির সঙ্গে যুক্ত একজন কর্মকর্তা নাম গোপন রাখার অনুরোধ করে বললেন, হিসাব ঠিক আছে। তবে একটি ওষুধে দুই ধরনের কাঁচামাল থাকে- একটি সক্রিয় উপাদান, আরেকটি নিষ্ক্রিয়। সক্রিয় উপাদান হচ্ছে ওমিপ্রাজল ৮.৫% পেলেট, ওষুধ বলতে এটাই বোঝায়; এটাই আসলে রোগ সারায়। আর নিষ্ক্রিয় উপাদান হলো আটা-ময়দার মতো, যা দিয়ে ওষুধের আকার-আকৃতি দেওয়া হয়। আর ক্যাপসুলের ক্ষেত্রে নিষ্ক্রিয় উপাদান লাগে জিলেটিন, রেড আয়রন অক্সাইড, ইয়েলো আয়রন অক্সাইড ইত্যাদি নামের কিছু খাদ্যোপযোগী রাসায়নিক।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি অনুষদের ক্লিনিক্যাল ফার্মেসি ও ফার্মাকোলজি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মুনীরউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘ওষুধের নিষ্ক্রিয় উপাদানের মধ্যে রয়েছে স্টার্চ, ল্যাকটোজ, সুক্রোজ, চালের গুঁড়া, আটা-ময়দা টাইপের জিনিস। নিষ্ক্রিয় উপাদানের দাম পড়বে সক্রিয় উপাদানের এক হাজার ভাগের এক ভাগ। এটা ধর্তব্যের মধ্যেই না। তিনি বলেন, ‘ওষুধ কোম্পানিগুলো যদি ১০ হাজার শতাংশ লাভ নেয়, আপনি কী করবেন? এটা বন্ধ করার উপায় কী?’

স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস তাদের ওমিপ্রাজল গ্রুপের সেকলো ২০ এমজি ক্যাপসুলের দাম প্রতি পিস ছয় টাকায় বিক্রি করে আসছে ২০১৯ সাল থেকে। অন্য কিছু কোম্পানির ওমিপ্রাজল গ্রুপের ওষুধের দাম আগের মতোই প্রতি পিস পাঁচ টাকা আছে।

তিন পয়সার ওমিপ্রাজল গ্রুপের সেই ওষুধের উৎপাদন খরচ, প্যাকেটিং, মার্কেটিং ও কোম্পানির লাভ ন্যায্যভাবে যোগ করলে দাম কত হতে পারে- ধারণা পেতে চাইলে একটি ওষুধ কোম্পানির একজন পরিচালক জানান, ওমিপ্রাজল গ্রুপের ২০ মিলিগ্রামের একটি ক্যাপসুল বানাতে খালি ক্যাপসুল সেল লাগবে, যেটার দাম প্রতি পিস কমপক্ষে ১০ পয়সা। সক্রিয় ও নিষ্ক্রিয় কাঁচামালের দাম প্রতি পিসে কমপক্ষে পাঁচ পয়সা। অর্থাৎ ১০টি ক্যাপসুল বানাতে খরচ হবে দেড় টাকা। এরপর প্যাকেজিং উপকরণ হিসেবে ব্লিস্টার লাগবে, যেটার দাম প্রতিটি কমপক্ষে দুই টাকা। এর বাইরে কাগজের প্যাকেটের মূল্য যুক্ত হবে এভাবে কম-বেশি সাড়ে তিন টাকার মধ্যে এক পাতা ওষুধ তৈরি করা সম্ভব; যা বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ ৬০ টাকায়।

দেশে ব্যবসা করে আসা শীর্ষস্থানীয় একটি বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১২ জুন পর্যন্ত তাদের আড়াইশ কোটি টাকার ওষুধ বিক্রি হয়েছে। টিপি মূল্যে আড়াইশ কোটি টাকার ওষুধ বিক্রির বিপরীতে ডাক্তারদের পেছনে তারা খরচ করেছে ১৯ কোটি ১৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা (৭.৬৭ শতাংশ)। এর বাইরে সিএসআর (করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতা) ফান্ডসহ আরও নানা ফান্ড থেকে ডাক্তারদের পেছনে খরচ করা হয়। সব মিলিয়ে তাদের ১০ শতাংশ বাজেট থাকে ডাক্তারদের পেছনে।

ওষুধ কোম্পানিগুলো অতিরিক্ত বা অস্বাভাবিক লাভ করছে কি না জানতে চাইলে চট্টগ্রামভিত্তিক একটি ওষুধ কোম্পানির একজন পরিচালক বলেন, ‘অতিরিক্ত মানে! পুরোটাই লাভের ওপর লাভ। ডাক্তারকে সামান্য লোভে ফেলে মূল ব্যবসা হচ্ছে কোম্পানির। ২০২২ সালের তৃতীয় প্রান্তিক পর্যন্ত বাংলাদেশে ওষুধের বাজারের আকার ছিল তিন দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলার। চিকিৎসক ও কোম্পানির অনৈতিকতার কারণে বাজার এতটা বেড়ে গেছে। এত বড় মার্কেট তো আমাদের হওয়ার কথা নয়। প্রয়োজন না থাকলেও গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ দেওয়া হচ্ছে। ক্যালসিয়াম ও ভিটামিনের ওষুধ দেওয়া হচ্ছে। প্রয়োজন ছাড়াই অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হচ্ছে।

সরকার যে ওষুধগুলোর দাম নির্ধারণ করে দেয়, সেগুলোর ক্ষেত্রে কোম্পানির লাভ কম হয় কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘দাম নির্ধারণ করে দেওয়া ওষুধগুলো বেশি চলে। সরকার যে ওষুধগুলোর দাম নির্ধারণ করে, সেগুলোও তো কোম্পানির সঙ্গে বসেই ঠিক করে। ‘‘ডলারের দাম বেড়ে গেছে, কাঁচামাল আনতে পারছি না’’- এসব ধুয়া তুলে দাম বাড়ানো হয়। ডলার আগে ৯০ টাকা ছিল, এখন ১১০ টাকা হয়েছে। ২০ টাকা বেড়েছে। কিন্তু ওষুধের দাম তো ৫০ শতাংশ পর্যন্তও বাড়ানো হয়েছে।’

গত ২৯ মার্চ রাজধানীর একটি হোটেলে পঞ্চম স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি সেক্টর কর্মসূচির (এইচপিএনএসপি) খসড়া স্ট্র্যাটেজিক ইনভেস্টমেন্ট প্ল্যান শীর্ষক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, ‘ওষুধের দাম বেশি কেন রাখা হয়, তা খুঁজে বের করতে হবে। অনেকে অভিযোগ করেন, প্রেসক্রিপশনে প্রয়োজনের চেয়ে অতিরিক্ত ওষুধ লেখা হয়। এ বিষয়টি চিকিৎসকদের খেয়াল রাখতে হবে। প্রেসক্রিপশন লেখার সময় যেন ব্যবসায়িক চিন্তা কাজ না করে।’

সৌজন্যে, প্রতিদিনের বাংলাদেশ।