‘কঠোর অনুশাসনে স্মার্ট সিটি হয়ে উঠতে পারে ঢাকা’

রাজধানী ঢাকার হাতিরঝিল প্রকল্প, ধানমন্ডি লেক ও এর আশপাশের এলাকার উন্নয়ন প্রকল্প, টুঙ্গিপাড়ায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধি সৌধ কমপ্লেক্স, কৃষিবিদ ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (কেআইবি), চট্টগ্রামের এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন, সিলেটের দুসাই রিসোর্টসহ দৃষ্টিনন্দন, গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প ও স্থাপত্যের অন্যতম নকশাকার স্থপতি ইকবাল হাবিব

সম্প্রতি পরিকল্পিত নগর ব্যবস্থা গড়ে তোলা, ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ), যানজটসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ভোক্তাকণ্ঠের সঙ্গে একান্ত স্বাক্ষাতে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শেখ রিয়াল

ভোক্তাকণ্ঠ: বর্তমান বাস্তবতায় ঢাকা শহরকে পরিকল্পিত ভাবে গড়ে তোলার সুযোগ কতটুকু?

স্থপতি ইকবাল হাবিব: ৬০ এর দশকে ঢাকা শহরের যখন গড়ে ওঠা তখন পর্যন্ত পৃথিবীব্যাপী একটি ধারণা ছিল গার্ডেন সিটি মুভমেন্ট। ‍অর্থাৎ মানুষ এক জায়গায় থাকবে, তারপর বিনোদন, বাজার এক জায়গায় থাকবে, তারপরে মানুষ অনেক দূরে গিয়ে অফিস করবে। তারপর সময়ের পরিবর্তনের ধারায় আধুনিক পদ্ধতিতে গ্রাম বলা হয় স্মার্ট ডেভলপমেন্ট। ঢাকার জন্মলগ্ন থেকে আমরা যেমন পুরান ঢাকায় উপরে বাসা নিচে দোকান, কারখানা এবং আমাদের এলোমেলো ভাবে কাজের জায়গা, বিনোদন, থাকা, স্কুল-কলেজ সবকিছু মিশে খিচুরি ডেভেলপমেন্ট যেটা হয়েছে সেটা অটোমেটিকালি তৈরি হয়েছে। আসলে স্মার্ট গ্রোথের ফর্মুলাগুলো দিয়ে ঢাকাকে যদি খুব কঠোর একটা অনুশাসনের মধ্যে আনা যায়। যেমন- যেটা ভাঙতে হবে ভেঙে ফেলতে হবে, যেটা রাখতে হবে রেখে দিতে হবে, এভাবে যদি একটু গোছানো যায়, তাহলে ঢাকা খুব দ্রুতই একটি স্মার্ট সিটিতে পরিণত হতে পারে। তার মানে এলোমেলো হওয়াটাই আমাদের কাছে এক ধরনের আশির্বাদ হিসেবে আসতে পারে। যদি আমরা কঠোর রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং সু-শৃঙ্খল করার একটা প্রয়াস নেই। সে অর্থে ঢাকা তার নিজের অপরিকল্পিত বেড়ে ওঠাকে কাজে লাগিয়ে দ্রুততম সময়ে সবচেয়ে আধুনিক স্মার্ট সিটিতে পরিণত হতে পারে।

ভোক্তাকণ্ঠ: এই শহরের দীর্ঘস্থায়ী জলাবদ্ধতা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ঘাটতি এবং প্রয়োজনীয় ফুটপাত, খেলার মাঠ এবং পার্ক না থাকা আরও বহুবিধ সমস্যার জন্ম দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। কীভাবে কর্তৃপক্ষ এবং নগরবাসী এ সকল সমস্যা মোকাবিলা করতে পারে?

স্থপতি ইকবাল হাবিব: যদি রাজনৈতিক ভাবে দায়বদ্ধহীন, নগরের নাগরিকদের অন্তর্ভুক্তিতাহীন, এক ধরনের প্রাধিকারহীন কার্যক্রমের কারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই পাঁচটি বিষয় সরকারের নজরদারিতে আনতে পারছি না। যদি এখনও বা সামনে নির্বাচন আছে, এর মধ্যে এই পাঁচটি বিষয়ে সরকার প্রাধিকার যুক্ত করে কারণ আগামী ২০ বছরে, এখনকার যে ৩৩/৩৪ শতাংশ নগরায়িত মানুষ আছে তারা ৫০ শতাংশে পরিণত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ফলে নগরের প্রস্তুতির জন্য হলেও যদি এই পাঁচটি বিষয়কে অগ্রাধিকার দেওয়া যায় এবং জনগণকে সম্পৃক্ত করে কঠোর রাজনৈতিক অঙ্গিকার, বিনিয়োগ, অর্থ, মেধা শক্তি, সময় এবং সরকারের মনোযোগ বিনিয়োগ করা যায় তবে অবশ্যই এই সমস্যাগুলোর সমাধান হতে পারে। শুধু মনে রাখতে হবে সমাধানের মূল জায়গাটা, রাজনৈতিক ভাবে সদিচ্ছাটা দারকার। সকলের অন্তর্ভুক্তিতে এসব পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। এখন পর্যন্ত ধনীদোষণ নীতিমালায় অত্যন্ত পুঁজি নির্ভর প্রকল্পগুলো প্রাধান্য পায়। ফলে প্রকল্পগুলোতে সকলের অন্তর্ভুক্তিতা থাকে না। ফলে আমরা গণপরিবহনের পরিবর্তে এলিভেটেড এক্সপ্রেস্রের প্রতি আগ্রহী, আমরা ফুটপাত উন্নয়নের পরিবর্তে মেট্রোরেলের প্রতি আগ্রহী, আমরা জলাধারগুলোকে সমুন্নত রেখে জলাধারকে আমাদের চলাচলের উন্নত মাধ্যম হিসেবে তৈরি না করে সমস্ত কঠিন এবং তরল বর্জ্য তার মধ্যে ফেলে দেওয়ার প্রবণতা সরকারি ভাবে করছি। আমাদের মাত্র ৫৫ শতাংশ কঠিন বর্জ্য সংগ্রহ করা হয়। আর ১৮ থেকে ১৯ শতাংশ তরল বর্জ্য পরিশোধিত করা হয়। কিন্তু এগুলোর মাধ্যমে নগরির জলাধারগুলোকে হত্যা করছি। জলাধার কেন্দ্রীক যে সম্ভাবনা আছে সেগুলোকে হত্যা করছি। এই জায়গায় একটা বড় ধরনের প্যারাডাইম শিফট দরকার। সকলের অন্তর্ভুক্তিতা, প্রাধন্য দরকার।

ভোক্তাকণ্ঠ: ড্যাপ সাধারণ মানুষের কল্যাণে কতটুকু কাজে লাগবে? এই পরিকল্পনা নিয়ে আপনার বক্তব্য জানতে চাই।

স্থপতি ইকবাল হাবিব: ড্যাপ একটি উচ্চকৃত দলিলে পরিণত হয়েছে। যেখানে উদ্ভুত কতগুলো হাইপোথিসিস ব্যবহার করা হয়েছে। সেটা হচ্ছে ঢাকা থেকে প্রায় ৭৬ লক্ষ মানুষ চলে যাবে। বা চলে যেতে বাধ্য হবে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো সমস্ত পরিসংখ্যান বলছে নগর অভিমুখতা আরও বাড়বে। কারণ নগরে কোনো না কোনো কিছু করে খাওয়া যায়, গ্রামে মানুষ যেতে যায় না। গ্রামের অবস্থা আরও সঙ্কিন। অনেক দ্রুতই গ্রামকে অর্থনৈতিক মূল কেন্দ্র বানানো সহজ না। এবং গণতান্ত্রিক দেশেও সাধারণ মানুষের ধারণা অনুযায়ী, স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করার ব্যাপারে রাজনৈতিক দল আগ্রহী না। বিনিয়োগও করি না। এ জন্য হাইপোথিসিসের উপর ভিত্তি করে যে পরিকল্পনা সেটা বাস্তবায়ন অযোগ্য।

এই ড্যাপে ধনীকে আরও সুবিধা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। ধনীদের জন্য সরকারের কোনো নাগরিক উদ্যোগ করার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। যার আছে তাকে আরও দেব। বন্য প্রবাহ অঞ্চল বা জলধারা, অর্থাৎ নদীর পাশের অঞ্চল সেগুলোকে ধনী ডেভলপারদের হাতে সমর্পণ করেছে। বলা হয়েছে মূখ্য জলস্রোত, সাধারণ জলস্রোত ৬০ শতাংশ রাখার কথা। কিন্তু সেগুলো আবার শর্ত সাপেক্ষে উন্নয়নের কথা বলে ডেভলপারদের পক্ষে এই ধ্বংস সাধনকে অনুমোদন করা হয়েছে এই ড্যাপে। তার মানে দরিদ্রের আবাসন অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ, প্রবাহ অঞ্চলকে সমর্পণ, এই সমস্ত কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে ড্যাপ যতক্ষণ পর্যন্ত পরিশিলিত না হয় এই ডকুমেন্ট জনবান্ধব, পরিবেশবান্ধব ডকুমেন্ট না বিধায় জনগণ ইতোমধ্যে পরিত্যাগ করেছে এবং সামনেও এটা পরিত্যাগ করার কারণে সরকারের পক্ষে বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না। তবে ড্যাপের মতো একটি ডকুমেন্ট জনবান্ধব, পরিবেশবান্ধব করে বাস্তবায়নযোগ্য ভাবে করতে হবে।

ভোক্তাকণ্ঠ: ড্যাপের পরিকল্পনায় ঢাকার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে ঢাকার পাশের তিন জেলা- নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও কেরানীগঞ্জের কিছু এলাকা, এই বৃদ্ধিকে কিভাবে দেখছেন? ড্যাপ বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জগুলো কী কী?

স্থপতি ইকবাল হাবিব: বর্ধিত অঞ্চলের জন্য পরিকল্পিত নগরায়ণ ব্যবস্থা, অবকাঠামো ইত্যাদির সুযোগ রয়েছে। এতে এই নগরীকে আরও পরিবেশবান্ধব, জনবান্ধব এবং সহনীয় অন্তর্ভুক্তিতা নগরী বানানো সম্ভব। কিন্তু আমরা এখনও দেখি ভূমিকে পুঁজি কেন্দ্রীক বা ভূমিকে বিনিয়োগের মাধ্যম হিসেবে দেখার প্রবণতা যায়নি। ভূমি যে একটা সুবিধা, সংবিধানের অধিকারের সংস্থানের জায়গা, তার বদলে ভূমিকে দেখা হচ্ছে বিনিয়োগের জায়গা হিসেবে। এর ফলে এই অতিরিক্ত জায়গা পুরান ঢাকায় যুক্ত হওয়া সত্ত্বেও এবং সেটার পরিমাণ কিন্তু বর্তমান ঢাকার প্রায় ৮০ শতাংশ, তার পরও অপরিকল্পিত এবং এ ধরনের ভ্রান্ত নীতিমালার কারণে সেগুলো একই রকম অবস্থায় উপনীত হতে পারে বলে আমি ধারণা করছি। আবার বলছি দ্রুততম সময়ে ড্যাপকে পরিশিলিত করে পরিমার্জিত এবং যথাযথ করে এই ডকুমেন্ট বাস্তবায়নে সকল নগরকে বাধ্য করতে পারলে হয়তো এই পরিশিলিত ড্যাপই হবে আমাদের বেঁচে যাওয়ার, ঘুরে দাঁড়ানোর সবচেয়ে বড় অবলম্বন।

ভোক্তাকণ্ঠ: আপনারা ড্যাপ নিয়ে অনেক আগে থেকেই কথা বলছেন? এখন পযন্ত কোনো পরিবর্তন কি লক্ষ্য করেছেন?

স্থপতি ইকবাল হাবিব: রাষ্ট্রপতি স্বাক্ষরিত এই ডকুমেন্টটি পুনরায় পরিবেক্ষণের মাধ্যমে প্রয়োজনে তার সম্ভ্যাব্য যাচাইয়ের কার্যক্রমগুলো আবার করে এটাকে পরিশিলিত করার সিদ্ধান্ত সরকার নিয়েছে। সেই কাযক্রম এই মুহুর্তে কতটা চলমান বা কতটা এগুচ্ছে সেটা যেহেতু আমি সেই দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি প্রাপ্ত ফলে বর্তমানে যারা দায়িত্বে রয়েছে তারা বলতে পারবে। তাদের শক্তিমত্তা হারাচ্ছে, জনগণের সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততা বিচ্ছিন্নতা হচ্ছে। বরং রিহ্যাবের মতো রিয়েল এস্টেট গোষ্ঠী, যারা পুঁজি কেন্দ্রীক গোষ্ঠী তাদের শক্তিমত্ত্বায় কাঙ্খিত জায়গায় যাবে কি না আমি সন্দিহান।

ভোক্তাকণ্ঠ: রাজধানীতে আমরা প্রায়ই দেখি ভবনে বিভিন্ন প্রকার দুর্ঘটনা ঘটে। এসব দুর্ঘটনার কারণ কি? রাজধানীতে ভবন নির্মাণ কি খুব সহজ? কারণ দুর্ঘটনার পরে দেখা যায় অনেক ভবন নির্মাণে কোনো আইন মানা হয়নি?

স্থপতি ইকবাল হাবিব: ৮৭ থেকে ৯০ শতাংশ ভবন যখন কোনো না কোনো ভাবে অনুমোদিত সেই নগরীতে আবার অননুমোদিত কিন্তু ব্যত্যয় করে তৈরি করা, বুঝতে হবে এই নগরীর এই অনুমতি দেওয়ার যে কর্তৃপক্ষ রয়েছে তাদেরকে কেউ মানছে না। অনুমোদন দিলেও এর পরে পুরো নগরীজুরে সমস্ত অনিয়ম রাজউকের সমীক্ষায় ৮৭ শতাংশ উল্লেখ করেছে। যদিও মনে রাখা দরকার ঢাকা শহরের এখনও প্রায় ৫০ শতাংশের উপরে পুনর্গঠনের জন্য প্রস্তুত। মানে এক তলা, দোতলা এমন বাড়ি। আর তিন-চার তলা বাড়ি, উচ্চ ভবনে সব সেবাদান একসঙ্গে করলে তাহলে হয়তো পুরো ঢাকার ৬৭ থেকে ৬৮ শতাংশ পুনর্গঠনের সুযোগ রয়েছে। তার মানে এখানে একটা কঠোর অনুশাসন, নিয়ন্ত্রণ এবং এক ধরনের প্রণোদনা সুন্দর ভাবে করা যেত, জনকল্যাণ মুখীতায়, নগরকেন্দ্রীকতায় তাহলে হয়তো সাংঘাতিক ভাবে উন্নতি করতে পারতাম। কিন্তু এই অনিয়মকে সবাই মেনে দাঁত কেলিয়ে রাজউকের মতো সকলের সামনে হাসে তখন দুর্ঘটনা না ঘটাটাই অলৌকিক ভাবে পরম করুণাময়ে অসৈর্গক বলে মনে করি। আমাদের দুর্ঘটনার সমস্ত অবস্থা আমরা তৈরি করে রেখেছি। আগুন হোক বা ভূমিকম্প হোক। এর যেকোনোটা ঘটলেই এটা নিয়ন্ত্রণের কোনো রকমের প্রস্তুতি নেই। সব ঘটনাই প্রমাণিত। তার পরেও কারো খবর কেউ রাখে না। সে অবস্থার মধ্যে আমরা আছি।

ভোক্তাকণ্ঠ: রাজউকের ভূমিকা কি তাহলে?

স্থপতি ইকবাল হাবিব: ব্যবসা, ব্যবসা এবং ব্যবসা। রাজউক অনুমোদনটাকেও ব্যবসা হিসেবে দেখে। তাদের অধিকাংশ প্রকাল্পগুলো ধনী মানুষকে ধনী বানানো, রাজনৈতিক অথবা পাউয়ারফুল আমলাদেরকে কোনো না কোনো ভাবে বড় লোক বানানো। এটা এক ধরনের বড় লোক বানানোর যন্ত্রে পরিণত হয়েছে। কি দিয়ে- সবচেয়ে দামি জমি বড় লোককে দিয়ে দাও এবং সেই বড় লোককে দাও যার জন্য জমি বরাদ্দ নেই। সবচেয়ে বড় ব্যাপার এই মুহুর্তে ঢাকার যে অবস্থা তাতে জমি দেওয়ার তো কোনো সুযোগই নেই। তাকে দিবেন মাথা গোঁজার একটা বাস্তুসংস্থান। এটা একটি ফ্ল্যাট হতে পারে। তাহলে এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে মধ্যসত্ত্বভোগী তৈরি করা হচ্ছে। এবং তারা এই জমি ডেভেলপারকে হস্তান্তর করে কোটি কোটি টাকার মালিক হচ্ছে। তারা জমি অব্যবস্থাপনার চরম ফায়দা লুটার একটা সংগঠনে পরিণত হয়েছে।

ভোক্তাকণ্ঠ: সাম্প্রতিক সময়ে দূষণের দিক থেকে ঢাকা পৃথিবীতে শীর্ষ স্থান লাভ করছে। কীভাবে এই সঙ্কট থেকে বেরিয়ে আসা যায়?

স্থপতি ইকবাল হাবিব: ভালো উদাহরণগুলোকে অনুসরণ করলে এ ধরনের পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ সম্ভব। হাতিরঝিল যে শহরে, ধানমন্ডি লেকের মতো উদাহরণ যে শহরে, আমাদের পাশের শহর নারায়ণগঞ্জের অসংখ্য প্রজেক্টের মধ্যে দ্রুত ঘুরে দাঁড়ানোর যে উদাহরণ, রাজশাহীর মতো শহরের ঘুরে দাঁড়ানোর যে উদাহরণ, এই ভালো উদাহরণগুলোকে রাজনৈতিক সদিচ্ছায় যেকোনো সময় কার্যকর করলেই আমরা দূষণমুক্ত, দখলমুক্ত, পরিবেশবান্ধব, জনবান্ধব নগরীতে পরিণত করতে পারি এই জনসমুদ্রের নরগীকে।

ভোক্তাকণ্ঠ: ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরের অন্যতম বড় সমস্যা যানজট। এখন এই সঙ্কট নিরসনে আর কোনো উপায় আছে? থাকলে সেগুলো কী?

স্থপতি ইকবাল হাবিব: প্রথম এবং একমাত্র উপায় ব্যক্তিগত গাড়ি, ব্যক্তিগত যানবাহনের প্রাধান্য একেবারে উঠিয়ে নিয়ে তার পরিবর্তে গণপরিবহণ, পায়ে চলার ব্যবস্থা, গণপরিবহনের বাস, কমিউটার রেল, নৌপথ এগুলোকে ব্যবহার করা। একটা মাত্র কারণে বর্তমানে সড়কের ব্যবহার দ্রুত সময়ে বেড়ে যাবে। অর্থাৎ আমি যদি এই শহরের প্রতি ১০টা গাড়ির পরিবর্তে একটা আধুনিক ইলেকট্রিক বাস নামাতে পারি তাহলে সড়কের সম্ভাবনা, ক্ষমতা, প্রবাহধারা পাঁচ থেকে ছয়গুন বেড়ে যাবে। এবং গণমানুষকে আমরা অন্তর্ভুক্ত করতে পারবো এবং শহরের মধ্য দিয়ে যে রেল লাইনগুলো আছে সেগুলোকে যদি আন্তঃনগরীও না করে অন্তঃনগরী হয়, শহরের চারপাশে এবং ভেতরে।

কমিউনিটি রেলের কারণে কলকাতা, বোম্বে এই শহরগুলো বেঁচে গেল। হাতিরঝিলে সেটা করে দেখিয়েছি আমরা। সবশেষে পথচারীবান্ধব নগরী করলে সমীক্ষা অনুযায়ী এটাকে পরিবহন কৌশলপত্র অনুযায়ী ৪০ থেকে ৪২ শতাংশ মানুষের প্রতিদিন যে পৌণে চার কোটি থেকে চার কোটি ট্রিপ তৈরি হয়, সেই ট্রিপকে সামাল দিতে পারবো। শুধুমাত্র পথচারীবান্ধব নগরী গড়ে তোলা। পথচারীবান্ধব বলতে শুধু ফুটপাত বড় করা না, ফুটপাতে গাছ লাগিয়ে ছায়া তৈরি করা, খাবার পানির ব্যবস্থা করা, প্রতি আধা কিলোমিটার পর পর শৌচালয় তৈরি করা। এই কাজগুলো খুব কঠিন না। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অনেক টাকার বিনিয়োগ না। তার বদলে যখন ৩৪ হাজার কোটি টাকার এলিভেটেড এক্সপ্রেস তৈরি করা হয়, যেখানে প্রাইভেট গাড়ি ছাড়া কেউ উঠবে না, তখন বোঝা যায় আমাদের মাথা নষ্ট। যারা উঠবে তাদের সংখ্যা ৮ থেকে ১০ শতাংশ। তাদের জন্য সমস্ত বিনিয়োগ করছি। তাদের জন্য আকাশ দেখিয়ে দিচ্ছি, তাদের জন্য সড়ককে সংকুচিত করে পিলার উঠাচ্ছি। তাহলে যারা ৯২ শতাংশ, অন্যভাবে চলাচলে আগ্রহী বা সামর্থ রাখে না, তাদেরকে পরোয়াই করছি না। এই যে আমরা মেট্রোরেল তৈরি করলাম, এটি সবচেয়ে উচ্চ মূল্যের গণপরিবহন। এটি অবশ্যই সাধুবাদ, কিন্তু কম মূল্যের, সাশ্রয়ী মূল্যের গণপরিবহনে বিনিয়োগ করছি না কেন? তার মানে সাধারণ মানুষের অন্তর্ভুক্তিতা আমাদের পরিবহনে দেখছি না।

ভোক্তাকণ্ঠ: মেগা প্রজেক্টের যেমন বড় বড় ফ্লাইওভার, মেট্রোরেল, বিআরটি উড়ালপথের মত প্রকল্পের ভালো-মন্দ উভয় দিক সম্পর্কে যদি বলতেন।

স্থপতি ইকবাল হাবিব: এগুলো পরিকল্পিত এবং সমন্নিত না। দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে এই। একমাত্র মেট্রোরেল ছাড়া। মেট্রোরেল উচ্চ মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্তদের বা মধ্যবিত্তদের জন্য একটা বিকল্প তৈরি হবে। কারণ ঢাকা শহর নিন্মবিত্তবান্ধব শহর না। কিন্তু ঢাকা শহরে নিন্মবিত্ত, মধ্যবিত্ত এবং নিন্ম মধ্যবিত্তের সংখ্যাই বেশি। তাদের জন্য আমরা বিনিয়োগ করছি না। সরকার এলিভেটেড এক্সপ্রেস, উড়াল সেতু সাংঘাতিক ভাবে অগ্রাধিকার দিচ্ছে। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে কত বেশি মানুষকে সার্ভ করছে, উপকার দিচ্ছে, সেই দায়িত্বপূর্ণ সংবেদনশীল পরিসংখ্যান ভিত্তিক হওয়া দরকার। এতে অনেক বেশি মানুষ অন্তর্ভুক্ত হবে। কিন্তু অনেক কম খরচের মধ্য দিয়ে তাদেরকে সেবা দেওয়া যাবে। কিন্তু উচ্চমূল্যের প্রকল্পগুলোতে সরকার খুব বেশি আগ্রহী এটা বলাই বাহুল্য। এটা আমরা বুঝি। কিন্তু এর মধ্য দিয়ে গণমানুষের অন্তর্ভুক্তিতার প্রকল্পগুলো মার খাচ্ছে। সামনের দিনগুলোতে আর কোনো বিকল্প থাকবে না। এগুলোকে আবার ভেঙে ফেলা ছাড়া। তার মানে এই অপভ্রংস বা অপধারণা বা ভ্রান্তিবিলাশের যে প্রকল্প এগুলো আমাদের জন্য বিষফোঁড়ায় পরিণত হওয়ার জন্য অপেক্ষমান।

ভোক্তাকণ্ঠ: হাতিরঝিল প্রকল্পে কিছু ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। এগুলো কি পরিকল্পনায় ছিল?

স্থপতি ইকবাল হাবিব: সাংঘাতিক ভাবে অন্যায় এবং এটার জন্য আমরা মামলা করেছি। দুর্ভাগ্য প্রধানমন্ত্রী বলা সত্ত্বেও রাজউক এই মামলায় সুপ্রিম কোর্টে লড়াই করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। যদিও প্রধানমন্ত্রী দপ্তর থেকে বলা হয়েছে, এই মামলা যেন না চালানো হয় এবং জনগণের আকাঙ্খা অনুযায়ী এটাকে গণপরিসর হিসেবে বাণিজ্যিক কার্যক্রম থেকে দূরে রাখা হয়। কিন্তু রাজউক একটা ব্যবসায়ী বা ধনী কেন্দ্রীক মানসিকতার সংস্থায় পরিণত হয়েছে সে জন্য এই অবস্থা। সে সঙ্গে রাজউক যার সক্ষমতাই নেই এই ধরনের প্রকল্প পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন এবং মেনেজমেন্ট করার তাকে এখনও এই দায়িত্বে কেন রাখা হয়েছে আমি জানি না। বরং সিটি কর্পোরেশনের মতো সংস্থা, যার সামর্থ আছে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা রাখা, যার লোকবল আছে এটিকে নিরাপত্তাসহ অন্যান্য কার্যক্রম করার। এবং রক্ষণাবেক্ষণ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে, তার মাধ্যমে এই প্রকল্প কেন রক্ষণাবেক্ষণ, কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে না? এটি প্রশ্ন। আর্মি চলে যাবার পর এর রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা এতোই খারাপ যে এটি হয়তো সামনে দিনে তার সমস্ত গৌরব, সৌন্দর্যতা হারাবে।

ভোক্তাকণ্ঠ: পরিবেশ ভাবনাকে মূল ভাবনায় রেখে ঢাকার নদী ও খাল পুনরুদ্ধার এবং হাতিরঝিলের মতো আরও প্রকল্প কি বাস্তবায়ন হতে পারে? কল্যাণপুর খাল এবং আশুলিয়া বেড়িবাঁধ সম্পর্কে বলুন।

স্থপতি ইকবাল হাবিব: হ্যাঁ, হতে পারে। হতে পারতেই হবে। কারণ অনেক প্রকল্প আমরা উদাহরণ হিসেবে করেছি। প্রধানমন্ত্রীর অনুমতির কারণে কল্যাণপুরের প্রকল্পটি তার একটা উদাহরণ। হাতিরঝিলের অনুকরণে নারায়ণগঞ্জে দুটি প্রকল্প হয়েছে। এর মধ্যে বাবরের খাল এবং শেখ রাসেল বিনোদন এলাকা। এখানে আর্ট কলেজ, শিশুদের স্কুল থেকে শুরু করে বিশাল শিশুতোষ, নারীবান্ধব একটি গণপরিষর তৈরি হয়েছে। তার মানে আমাদের নির্বাচিত মেয়রদের নেতৃত্বে এই পুরো কার্যক্রম যদি পরিশিলিত করা যায়, আরও বেশি গণমানুষবান্ধব করা যায়, তাহলে অবশ্যই সম্ভব। কল্যাণপুর প্রকল্প এই মুহুর্তে চলমান বলে বা মাত্র শুরু হলো বলে আমার বিশ্বাসে কোনো চির ধরার কোনো সুযোগই নেই। আমি দৃঢ় বিশ্বাসী, এতোটুকু বলতে পারি- ধানমন্ডি লেক, হাতিরঝিল, নারায়ণগঞ্জ এবং মাদারীপুরের এ ধরনের প্রকল্পগুলো করার অভিজ্ঞতার সুবাদে শুধুমাত্র ঐকান্তিকতা, রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং এক ধরনের জনকেন্দ্রিক বা জনগণের ভোটে নির্বাচিত নেতৃত্বের মাধ্যমে বাস্তবায়ন, যাতে জনগণ সম্পৃক্ত থাকে, এই তিনটি শর্তকে পালন করলেই পুরো ঢাকাকে আবার দ্রুতই এই ধরনের প্রকল্পের বাস্তবায়ন সম্ভব।