‘জ্বালানি সংকটের জন্য আমদানি নির্ভরতাই দায়ী’

ভোক্তাকণ্ঠ রিপোর্ট: বর্তমানে দেশে জ্বালানি সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। আবাসিক, বাণিজ্যিক এমনকি সিএনজি স্টেশনেও চলছে জ্বালানি সংকট। 

এদিকে, শিল্প কারখানায় নিরবচ্ছিন্ন গ্যাসের দাবি জানিয়ে আসছেন ব্যবসায়ী নেতারা। তবে জ্বালানির এই সংকটের জন্য ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধকে বরাবরই দায়ী করে যাচ্ছে সরকার। 

যদিও বিশেষজ্ঞদের মতে, অভ্যন্তরীণ উৎপাদন না বাড়িয়ে আমদানি নির্ভরতাই এর জন্য দায়ী। 

কেন এই সংকট, অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়ানোর সুযোগ ছিলো কি না, ভবিষ্যৎ জ্বালানি ব্যবস্থা কেমন হতে যাচ্ছে- এসব বিষয়ে ভোক্তাকণ্ঠের সঙ্গে কথা বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. বদরুল ইমাম। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন এস এম রাজিব।

ভোক্তাকণ্ঠ: গ্যাস বা কয়লার অভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমিয়ে লোডশেডিং করতে হচ্ছে। আবাসিক, বাণিজ্যিক এমনকি সিএনজি স্টেশনগুলোতেও গ্যাস সংকট চলছে। আসলে কেন এই সমস্যার সৃষ্টি হলো?

বদরুল ইমাম: ভূতত্ত্ববিদ হিসেবে এটা বলতে পারি, বাংলাদেশ ডেল্টা এরিয়া হওয়ায় এখানে গ্যাসের পর্যাপ্ততা রয়েছে। কারণ পৃথিবীর সব ডেল্টা এরিয়াতেই তেল-গ্যাস থাকে। আমরা এখানকার গ্যাস রিচ যেহেতু জানি এবং আমাদের একাংশ প্রমাণিত হয়েছে, প্রকৃতপক্ষে এই নির্দেশটা পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশব্যাপী আছে। আমরা সেই পরিমাণ এক্সপ্লোরেশন করিনি। ফলে গ্যাসের প্রাপ্যতা ক্রমাগত ভাবে উৎপাদন বাড়াচ্ছিল এবং ২০১০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত কন্টিনিউ বেড়েছে। কিন্তু ২০১৬ সাল থেকে এটা কমতে থাকে এবং যা আর থামেনি। এটা প্রতি বছরই কমতির দিকে রয়েছে। সম্প্রতি একটা প্রোগ্রাম হাতে নিয়েছে সরকার। এতে কিছুটা হয়তো বাড়বে, তবে আগের পর্যায়ে গ্যাস উৎপাদন নিয়ে যাওয়া খুবই ডিফিকাল্ট। আর এর কারণ হচ্ছে- বহুদিন ধরে ব্যাপক অনুসন্ধান না করা। এই স্থবিরতা স্থল ভাগেও ছিল, সমুদ্র ভাগেও ছিল। তবে অনুসন্ধানের অভাবে উৎপাদন কমলেও চাহিদা কিন্তু বেড়েই চলেছে। যার কারণে উৎপাদন এবং চাহিদার মধ্যে বড় পার্থক্য তৈরি হয়ে গেছে। এটাই হলো দেশের জ্বালানি সংকটের মূল কারণ।

ভোক্তাকণ্ঠ: জ্বালানির এই সংকট আরও তীব্র হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে কি না?

বদরুল ইমাম: এই গ্যাপটা পূরণের জন্যে সরকার এলএনজি আমদানির পদক্ষেপ নিয়েছিল। কিন্তু এলএনজি তো উচ্চ মূল্যের জ্বালানি। ফলে এটা যখন দেশিও গ্যাসের সঙ্গে সরবরাহ করা হচ্ছে, দেশিও গ্যাসের যে মূল্যটা ছিল, আমরা যে স্বল্প দামে পেতাম, সেটার মূল্যও বেড়ে গেছে। আর এই মূল্য বাড়ার ফলে এটা দিয়ে যে প্রোডাক্ট পেতাম তার দামও বেড়ে গেছে। ফলে এটা আমাদের ভোক্তা পর্যায়ে এসে আলটিমেটলি বোঝা হয়ে পড়েছে। যেমন এর ফলে বিদ্যুতের দাম, আবাসিক বা বাণিজ্যিক সংযোগের গ্যাসের দামও বেড়ে গেছে এবং এই সংকটটা সহসা সমাধানও হচ্ছে না।

ভোক্তাকণ্ঠ: তথ্যমতে, দেশে গ্যাসের মজুদ শেষের দিকে এবং দ্রুতই ফুরিয়ে যাবে। তাই চাহিদা মেটাতে আমদানি করতে হচ্ছে। কিন্তু অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়ানোর সুযোগ ছিল কি না?

বদরুল ইমাম: গ্যাসের মজুদ ফুরিয়ে গেছে বলা হচ্ছে। কিন্তু আমরা ভূতত্ত্ববিদরা এর সঙ্গে একমত নই। এখানে যেটা আবিষ্কৃত হয়েছে, সেই আবিষ্কৃত ক্ষেত্র থেকেও উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। তিতাস এবং বিবিয়ানা বড় গ্যাস ক্ষেত্র। বিবিয়ানা থেকে বিদেশি শেভরন কোম্পানি প্রতিদিন ১২০০ ইউনিট ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন করে। কিন্তু একই পর্যায়ের গ্যাস ক্ষেত্র তিতাস থেকে কখনোই ৪০০-৫০০ ইউনিটের বেশি উৎপাদন করা হয় না। এখানে একটা সুযোগ আছে। আমরা যদি ওদের লেভেলে গ্যাস উত্তোলন করি, তাহলে বাড়তে পারে। সুতরাং এখানে দুটো পথ আছে, প্রথমত যেগুলো উৎপাদনে আছে সেগুলোর উৎপাদন বাড়াতে সেই পর্যায়ে কাজ করতে হবে। এটা খুব বেশি হাই-টেকনোলজির বিষয় না। এগুলোর কিছু বিষয় আছে, সেগুলো চেঞ্জ করলেই উৎপাদন বাড়ানো যাবে। আরেকটা বিষয় হচ্ছে নতুন গ্যাস কূপ আবিষ্কার করা- যেটা আমরা সবসময় বলে আসছি। যদি যথেষ্ট পরিমাণ অনুসন্ধান করা যায় গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কারের জন্য, তাহলে ভালো হবে।

ভোক্তাকণ্ঠ: সরকার নতুন গ্যাস ক্ষেত্র বা গ্যাস উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা করেছে কি না?

বদরুল ইমাম: পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে আমাদের অনুসন্ধান কার্যক্রম খুবই কম হয়েছে। কিন্তু তার উত্তরেই ত্রিপুরা রাজ্য। পার্বত্য চট্টগ্রামের স্ট্রাকচারগুলোই ত্রিপুরায় চলে গেছে। সেখানে ভারত নয়টি গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কার করেছে। অথচ আমরা মাত্র একটা পেয়েছি। কারণ আমরা পর্যাপ্ত পরিমাণে অনুসন্ধান করিনি। সুতরাং এটাতে বোঝা, যে জায়গাগুলোতে অনুসন্ধান চালানো হয়নি, সেখানে অনুসন্ধান চালালে অনেকগুলো গ্যাস ক্ষেত্র পাওয়া যাবে। এছাড়াও সাগরের পূর্বাংশে মিয়ানমার এবং পশ্চিমাংশে ভারত অনেকগুলো গ্যাস কূপ পেয়েছে। কিন্তু মাঝখানে আমরা কিছুই করিনি। যদি আগের থেকে এই ধরনের চিন্তা কেউ করতো এবং কার্যক্রম গ্রহণ করতো- আমরা দেশের উপর নির্ভরশীল হবো, আমাদের গ্যাস তো কমিয়ে আসছে সেটা নিজেদের গ্যাস দিয়েই পূরণ করবো। কিন্তু সেটা না করে যখন গ্যাস কমে যেতে লাগলো সেটা মেনে নিয়ে আমদানি করে এই গ্যাপটা পূরণ করা হলো। সুতরাং এর কারণ হচ্ছে মাইন সেট, এর কারণ হচ্ছে কার্যক্রম বা দূরদর্শিতার অভাব। এই সমস্ত কারণে বাংলাদেশ ধীরে ধীরে আমদানি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।

ভোক্তাকণ্ঠ: ৪৬টি কূপ খনন ও পুনর্খননের কাজ হাতে নেওয়া হয়েছে। বলা হচ্ছে এখান থেকে ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়া যাবে। এ পরিকল্পনায় কতটা সফলতা আসবে?

বদরুল ইমাম: সেখান থেকে এতটা গ্যাস আসবে না। তার কারণ হচ্ছে ৪৬টা কূপ খনন করলে ৪৬টা থেকে পাওয়া যাবে না। পৃথিবীর কোনো জায়গাতেই ১০টা কূপ খনন করে ১০টাতেই গ্যাস পাওয়ার নজির নেই। বাংলাদেশের পেক্ষাপটে আমরা তিনটা অনুসন্ধান করলে একটাতে পাই। কোনো দেশে পাঁচটা করলে একটা পায়, আবার কোনো জায়গায় ১০টা করে একটা পায়। এখানে সেই হিসেবেও যদি ধরি, তাহলে তিন ভাগের এক ভাগ ১৫টাতে পাবে। ১৫টাতে পেলে সেই হিসাবে ৬০০ মিলিয়নে যাবে না গ্যাস। কিন্তু তারা যে ভুলটা করেছে- প্রতিটা কূপে ১৫-২০ ইউনিট করে ধরেছে। কিন্তু সবগুলোতে যেহেতু পাবে না, তাই এই টার্গেট পূরণ হবে না। তবে এটা যদি স্বার্থক ভাবে করা যায়, তাহলে একটা যোগান আসবে। কিন্তু যে পরিমাণ আশা করেছে সেই পরিমাণ না।

ভোক্তাকণ্ঠ: ২০১৪ সালে সমুদ্র বিজয়ের মাধ্যমে সীমানার আয়তন বাড়ে। কিন্তু এতদিন পরও সমুদ্র থেকে কাঙ্খিত সাফল্য না আসার কারণ কি?

বদরুল ইমাম: ২০১২ সালে মিয়ানমার এবং ২০১৪ সালে ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারণ হওয়ার পর তারা অনেক গ্যাস আবিষ্কার করেছে এবং সেই গ্যাস ব্যবহারও করছে। কিন্তু আমরা এটা করলাম না কেন- সেই উত্তর এখনো পাইনি। প্রশ্ন করলেও উত্তর পাওয়া যায় না। কোনো একটা কারণে এই প্রোগ্রামটা ধামাচাপা দিয়ে রাখা হয়েছিলো। এর উপর জোর না দিয়ে একটা মহল এলএনজি আমদানি কার্যক্রমের সঙ্গে ইন্টারেস্টেড ছিল। সেই কারণে সাগরের অনুসন্ধানের সফলতা আসেনি। 

ভোক্তাকণ্ঠ: সমুদ্রের ২৬টি ব্লকের মধ্যে অগভীর অংশে ১১টি ব্লক রয়েছে। এগুলো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাপেক্সের মাধ্যমে অনুসন্ধান চালানো সম্ভব কি না?

বদরুল ইমাম: সাগরে বাপেক্স অনুসন্ধান করতে পারবে না। সেই সক্ষমতা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানটির নেই। দক্ষ ও ভালো বিদেশি কোম্পানিকে নিয়ে করানোই মূলত মেইন কাজ। কিন্তু সেই কাজটা আমরা এতদিনেও করিনি। বর্তমানে অবশ্য বড় বিদেশি কোম্পানি এক্সিন মবিল ইনভলভ হতে যাচ্ছে। তাদের সঙ্গে নেগোসিয়েশন হচ্ছে এবং সেটা যদি হয় তাহলে ভালো হবে। তারা নাম্বার ওয়ান কোম্পানি, তারা এলে খুবই ভালো খবর। তবে এটা অনেক দেরি হয়ে গেছে। আমাদের ১০টা বছরের যে গ্যাপ, সেই সংকটের মধ্যে পড়ে আছি। এই সংকট থেকে উত্তোরণে আরও ছয়-সাত বছর লাগবে। কারণ সাগরে আজকে গেলেই তো আর গ্যাস উত্তোলন করতে পারবেন না। পাঁচ-সাত বছর আগে যদি আমরা এই উদ্যোগটা নিতাম, তাহলে আমাদের হাতে এখন গ্যাস থাকতো।

ভোক্তাকণ্ঠ: গভীর সমুদ্রের ১৫টি ব্লকে এই অনুসন্ধান চালাতে চাচ্ছে এক্সিন মবিল। কিন্তু এই চুক্তির ফলে দেশের জন্য লাভ হবে না কি  লোকসান?

বদরুল ইমাম: এটা পিএসসি চুক্তির অধীনে হতে হবে। অর্থাৎ তারা খনন করবে, জরিপ করবে। তারা যদি গ্যাস পায়, তাহলে সেটা ভাগাভাগি হবে। আর যদি না পায় তাহলে চলে যাবে। এখানে আমাদের কোনো ক্ষতি নেই। প্রোডাক্টশন শেয়ারিং কন্টাক্ট (পিএসসি) এই দিক থেকে ভালো যে আমাদের কোন ইনভেস্ট করতে হবে না। যদি গ্যাস পায় তখন আমরা শেয়ার করবো এটা। তবে চুক্তি কোন প্রক্রিয়ায় হলো, কতটা দেশীয় স্বার্থ রক্ষা করে হলো, সেই বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ।

ভোক্তাকণ্ঠ: সব ঠিক থাকলে সমুদ্র থেকে তেল-গ্যাস পেতে অন্তত আট থেকে ১০ বছর সময় লাগবে। তাহলে স্বল্প সময়ের মধ্যে দেশের জ্বালানি চাহিদা পূরণের উপায় কি?

বদরুল ইমাম: এই সংকট থেকে উত্তোরণের জন্য সাগরের উপর নির্ভরশীল না হয়ে স্থল ভাগের উপর নির্ভরশীল হতে হবে। কারণ স্থল ভাগে সাত-আট বছর লাগবে না। দুই-তিন বছরের মধ্যেই গ্যাস চলে আসতে পারে। এমনকি প্রোডাক্টশন বাড়ানোর যে পদ্ধতি, অ্যাকজেস্টিন (নির্দিষ্ট) গ্যাস ফিল্ডে এক-দুই বছরের মধ্যে করা যায়। সুতরাং বোথ ওয়েতে (উভয় প্রচেষ্টা) আমাদের চেষ্টা করতে হবে। নতুন গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কার প্লাস যেগুলো উৎপাদনে আছে সেগুলোতে টেকনোলজি ব্যবহার করে উৎপাদন বাড়ানো। এই দুটো পথই আমাদের সামনে আছে।

ভোক্তাকণ্ঠ: সঙ্কট মোকাবেলায় ভোলার গ্যাস কতটা ভরসা যোগাতে পারে? নদীর কারণে ভোলার গ্যাস সরবরাহ করাও সম্ভব হচ্ছে না। এ জন্য কি করা প্রয়োজন? 

বদরুল ইমাম: ভোলার গ্যাস আমাদের অনেক আশাবাদ দিচ্ছে। সেখানে তিনটি গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কার হয়েছে এবং বিশ্বাস করি- সেখানে আরও গ্যাস কূপ আবিষ্কার হবে। তবে সেখানে এখন যেটা করা উচিত, দ্রুত পাইপলাইন স্থাপন করে গ্যাস সরবরাহ করা। কিন্তু সেটা না করে সিএনজি করে নেওয়াটা টেকসই ব্যবস্থা নয়। এতে পাঁচ বা ১০ মিলিয়ন বড়জোর ২৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস নেওয়া যাবে। কিন্তু আমাদের দরকার প্রতিদিন ২০০-৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। সুতরাং পাইপলাইন করে ফেলতে পারলে ভালো এবং এটা দ্রুত সময়ে করা উচিৎ। পাইপলাইন তো সমুদ্রের মধ্যেও করছে, আর এতো নদী। করা যাবে না কেন?

ভোক্তাকণ্ঠ: কয়লা সঙ্কটে একাধিকবার পায়রা ও রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ করতে হয়েছে। আমদানি নির্ভর এ কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর সুফল কতটা ভোগ করতে পারবে ভোক্তা? না কি ক্যাপাসিটি চার্জের যাতাকলে এগুলোও গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়াবে?

বদরুল ইমাম: বিশ্ব বাজারে কয়লা আছে। কিন্তু সেই কয়লা কিনতে হবে ডলার দিয়ে। কিন্তু ডলার যদি না থাকে, তাহলে ডিজাবশন তো (ব্যাহত) হবেই। আর এটাই হচ্ছে বর্তমানে দেশের মূল সমস্যা। যেহেতু আমরা বিভিন্ন পণ্য অনেক উচ্চ মূল্যে আমদানি করতে শুরু করেছি, যেমন উচ্চ মূল্যের এলএনজি আমদানি করতে হচ্ছে। এগুলোর উপর ভর করার কারণেই ডলার সংকটে পড়েছে। সেই সংকট কয়লা কিনতেও ব্যাহত হচ্ছে এবং সেই সংকটটা যদি না মেটে, তাহলে আমদানির উপর নির্ভর করাটা খুবই দুর্যোগপূর্ণ হবে। এটা বার বার ব্যাহত করবে। 

আর যদি উত্তরবঙ্গের নিজস্ব কয়লার উপর নির্ভর করতো। তাহলে বাইরের কয়লার উপর নির্ভর করতে হতো না। আমাদের ডলারের উপর চাপ বাড়তো না এবং সেটাই ছিল মোক্ষম পন্থা। কিন্তু আমরা তো সেই পথে যাইনি। সেখানে যদি এখনো খনন শুরু করা হয়, তাহলেও পাঁচ বছরের আগে উত্তোলন করা সম্ভব নয়। সুতরাং আমাদের পুরো কার্যক্রমের মধ্যে বিরাট দুর্বলতা রয়েছে। ওভার দ্যা লাস্ট ১০-২০ বছরে এই সমস্যাটা এমন পর্যায়ে নিয়ে গেছে যে এই সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। এতে অলরেডি ক্যাপাসিটি চার্জ গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাওয়ার প্লান্ট বানিয়ে উৎপাদন না করলেও ক্যাপাসিটি চার্জ তো দিতেই হবে। এতো বেশি ক্যাপাসিটি হয়ে গেছে কিন্তু সেই পরিমাণ উৎপাদন করতে পারিনি। কারণ আমাদের জ্বালানি নেই। ফলে জ্বালানির অভাবে এখানে যে শুধু বিদ্যুৎ পাচ্ছি না তা নয় বরং না পাওয়ার পরেও ক্যাপাসিটি চার্জ দিয়ে আরেকটা ক্ষতি হচ্ছে। এগুলো একটার সঙ্গে আরেকটা রিলেটেড। সামগ্রিক ভাবে এটা খুব সঙ্কটময় অবস্থানে আছে।

ভোক্তাকণ্ঠ: কর্মকর্তাদের মতে, গ্যাস উত্তোলন না করলেও সেটা তো আর নষ্ট হচ্ছে না, ভবিষ্যতে কাজে লাগবে। কিন্তু  বিশ্ব যেখানে নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে ঝুঁকছে, সেখানে ভবিষ্যতে জীবাশ্ম জ্বালানির চাহিদা কতটা থাকবে?

বদরুল ইমাম: এর সঙ্গে আমি মোটেও একমত নই। কারণ গ্যাস আমাদের এখনই দরকার, এই মুহূর্তে দরকার। এটা ভবিষ্যতের জন্য রেখে দেওয়ার কথা বলাটাও অবান্তর, অর্থহীন। ভবিষ্যতে জীবাশ্ম জ্বালানি পৃথিবী থেকে উঠে যাবে, তখন কি করবেন। তখন তো কোন লাভ হবে না। আজ থেকে ৫০ বছর পর কেউ গ্যাস ব্যবহার করবে না। সারা পৃথিবী যাবে নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে, আমাদেরও যেতে হবে। সুতরাং পৃথিবী যখন নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে চলে গেছে, তখন আমাদের জীবাশ্ম জ্বালানি নিয়ে বসে থাকার সুযোগ নেই। সুতরাং আমাদের এই মুহূর্তে জ্বালানি দরকার।

ভোক্তাকণ্ঠ: দেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানির উন্নয়নে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে কি-না বা কোন প্রক্রিয়ায় বাড়ানো সম্ভব?

বদরুল ইমাম: নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বাংলাদেশ অনেক পেছনে পড়ে আছে। আমাদের টার্গেট ছিল ২০২০ সালের মধ্যে ১০ শতাংশ করার। কিন্তু সেটা করতে পারিনি, দুই-তিন শতাংশে রয়ে গেছে। এগুলোর উপর এতদিন খুব একটা জোড় দেওয়া হয়নি। বর্তমানে কিছু পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে, তবে সেটা অনেক দেরি হয়ে গেছে। এই বিষয়ে খুবই জোড়ালো কার্যক্রম নেওয়া উচিৎ। এছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে যদি খুব বেশি ভর দিতে পারি, তাহলে আমাদের অন্যান্য সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে। এতে নবায়নযোগ্য জ্বালানি বাড়াতে হবে এবং জীবাশ্ম জ্বালানি আস্তে আস্তে কমিয়ে দিতে হবে। রাতারাতি এটা বাড়ানো বা কমানো সম্ভব নয়। নবায়নযোগ্য জ্বালানি আস্তে আস্তে বাড়াতে হবে এবং সেই অনুপাতে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমাতে হবে। সেই সময়টা ২০৪০ সাল হতে পারে, আবার ২০৫০ সালের মধ্যেও হতে পারে। তবে প্রোগ্রামটা এখনই হাতে নিতে হবে।

ভোক্তাকণ্ঠ: বাংলাদেশ জ্বালানিভিত্তিক দেশ নয় বলে জানিয়েছেন প্রতিমন্ত্রী। আসলে ভৌগোলিক ভাবে দেশে খনিজ সম্পদের সম্ভাবনা কেমন? চুনাপাথরসহ যে খনিজ সম্পদগুলো রয়েছে, সেগুলো উত্তোলনে সরকার কি প্রয়োজনী ব্যবস্থা নিচ্ছে?

বদরুল ইমাম: বাংলাদেশে খনিজ সম্পদ অবহেলার শিকার। এটার প্রোপার ইউটিলাইজেশন অনুসন্ধান হয়নি। আপনি গ্যাসের কথা বলতে পারেন- যে পরিমাণ গ্যাস আমাদের দেশে আছে, সেই পরিমাণ অনুসন্ধান আমরা দেখি নাই। চট্টগাম এলাকার কথা বললাম, সেখানে অনেক কম অনুসন্ধান আমরা করেছি। কিন্তু ত্রিপুরারা অনেক পেয়েছে। এই একই ভূখণ্ড যেখানে শুধু দাগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ভৌগোলিক ভাবে তো আর পৃথক হয়নি। সুতরাং তারা এতো গ্যাস পেলে আমার এখানে না থাকার তো কোনো কারণ নাই। আমাদের তথ্য-উপাত্য এবং বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ থেকে জানি- এখানে গ্যাস রয়েছে। যেমন ভোলা দ্বীপের বিষয়ে আমরা বহুদিন ধরে বলে আসছি- এখানে গ্যাস আছে, আপনারা উত্তোলন করুন। এখন এগুলো অনুসন্ধান না করলে তো আপনি প্রমাণ করতে পারবেন না- আছে কি নেই। এছাড়াও উত্তরবঙ্গে কয়লা আছে, সেই তুলনায় আমরা উত্তোলন করি না। সেখানে চারটার মধ্যে একটা মাত্র খনি থেকে আমরা উত্তোলন করি। সেগুলোতেও আমরা উত্তোলন করতে পারি।

অন্যান্য খনিজ সম্পদের মধ্যে চুনাপাথর, সিলিকন, বালিসহ বিভিন্ন খনিজ পদার্থ রয়েছে, সেগুলো উত্তোলন করা যায়। এছাড়াও সম্প্রতি উত্তরবঙ্গে লোহার আকরিক পাওয়া গেছে। সেগুলোতে খুবই উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে এবং অনেক মজুদও রয়েছে। তা যদি হয় তাহলে আমরা একটা লোহার খনিও তৈরি করে ফেলতে পারবো। এখানে একটা ফিজিবিলিটি স্টাডি চলছে বিদেশি কনসালটেন্ট দ্বারা। সুতরাং এগুলোর ফলে আমরা আশাবাদী হতে পারি যে সম্পদের প্রাচুর্যতা রয়েছে দেশে। যদি এগুলোকে কাজে লাগানো না হয়, তাহলে মাটির নিচেই পড়ে থাকবে। কোনো মূল্য হবে না। সুতরাং খনিজ সম্পদগুলোকে উঠানো দরকার।