চিনির বাজার হঠাৎ যে কারণে উত্তপ্ত হলো

ভোক্তাকণ্ঠ রিপোর্ট: হঠাৎ করে বাজার থেকে উধাও হতে থাকে চিনি। ফলে বেড়ে যায় দাম। তবে চিনি উৎপাদন কমের বিষয়ে কারখানা কর্তৃপক্ষ গ্যাস সংকটকে দায়ী করেন। এদিকে পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানান, মিলগেট, খাতুনগঞ্জ বা মৌলভীবাজার থেকে সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি মূল্যে চিনি ক্রয় করতে হচ্ছে। 

সরকারের বাজার তদারকি সংস্থার অনুসন্ধানে এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে।

চিনি নিয়ে ব্যবসায়ীদের কারসাজি থামাতে চিনি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান/মিলসহ সারাদেশের বিভিন্ন বাজারে একযোগে অভিযান চালায় ভোক্তা অধিদপ্তর।

এর আগে গত ০৬ অক্টোবর কেজিপ্রতি ছয় টাকা বাড়িয়ে চিনির দাম ৯০ টাকা নির্ধারণ করে সরকার। তবে এ দামে রাজধানীসহ দেশের কোথাও চিনি পাওয়া যাচ্ছে না। প্রতি কেজি খোলা চিনি বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১১০ টাকা।

চিনির বাজার নিয়ন্ত্রণে মাঠে ভোক্তা অধিদপ্তর

চিনির বাজার নিয়ন্ত্রণে গত ২২ অক্টোবর সকাল সাড়ে ৮টার দিকে জুম প্ল্যাটফর্মে জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) এ. এইচ. এম. সফিকুজ্জামানের সভাপতিত্বে প্রধান কার্যালয়, সকল বিভাগীয় ও জেলা কার্যালয়ের কর্মকর্তাবৃন্দের সঙ্গে চিনিসহ নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক সভা অনুষ্ঠিত হয়।

সভার নির্দেশনা অনুসারে অধিদপ্তর কর্তৃক চিনিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সামগ্রীর বাজার নিয়ন্ত্রণে ঢাকা মহানগরসহ দেশব্যাপী বাজার তদারকি/অভিযান পরিচালিত হয়। এ সকল অভিযানে চিনির উৎপাদন পর্যায়ে এবং পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ে বিক্রয় কার্যক্রম তদারকি করা হয়।

চিনির রিফাইনারী/মিলসমূহে তদারকি

মেঘনা সুগার রিফাইনারী লিমিটেড

নারায়ণগঞ্জে মেঘনা সুগার রিফাইনারী লিমিটেডে গিয়ে দেখা যায়, দৈনিক উৎপাদন ক্ষমতা তিন হাজার মে. টন থাকলেও গত ২০ অক্টোবর এক হাজার ৯৭৪ মে. টন চিনি উৎপাদন করা হয়েছে। এছাড়া সাপ্লাই অর্ডারে মূল্য উল্লেখ ছিল না। ২৩ অক্টোবরের পূর্বের মজুদকৃত চিনি পাওয়া যায়নি।

সিটি সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড

রূপগঞ্জ এলাকায় অবস্থিত সিটি সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডে গিয়ে দেখা যায়, তীর ব্র্যান্ডের খোলা চিনি (৫০ কেজি) ও কনজ্যুমার (১ কেজি) প্যাক সরকার নির্ধারিত মূল্য মুদ্রিত আছে। এছাড়া উৎপাদন সক্ষমতার প্রায় ৫০ ভাগ কম চিনি উৎপাদন করছে। প্রতিষ্ঠানটির সাপ্লাই অর্ডারে ইউনিট প্রাইস উল্লেখ ছিল। সেখানে কোন মজুদকৃত চিনি পাওয়া যায়নি।

চিনি উৎপাদন কমের বিষয়ে কারখানা কর্তৃপক্ষ গ্যাস সংকটকে কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন।

আবুল মোনেম সুগার রিফাইনারী লিমিটেড

আবুল মোনেম সুগার রিফাইনারী লিমিটেডের দৈনিক উৎপাদন ক্ষমতা ৭০০ মে. টন। ২২ অক্টোবর উৎপাদন এবং সরবরাহ করেছে ৬৮৫ মে. টন। এখানে উৎপাদিত চিনি নিজস্ব কোকাকোলা আইসক্রিম ফ্যাক্টরিতে ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও আকিজ, এসিআই ও সেনা কল্যাণ গ্রুপের জন্য চিনি উৎপাদন ও মোড়কজাত করেন। এছাড়াও বিভিন্ন সুপারশপ তাদের চিনি সরাসরি ক্রয় করে। এই মিলে কোন মজুদকৃত চিনি পাওয়া যায়নি।

দেশবন্ধু সুগার মিল

নরসিংদী জেলার পলাশে দেশবন্ধু সুগার মিলে গিয়ে দেখা যায়, একাধিক সাপ্লাই অর্ডারের মেয়াদ শেষ হওয়ায় ১০-১২ দিন পর চিনি সরবরাহ করা হয়েছে। এছাড়াও পাকা রশিদ/চালানে পণ্যের একক মূল্য উল্লেখ নেই। মিলগেটে কোন মূল্য তালিকা প্রদর্শন করা হয় না। মিল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন গ্যাস/বিদ্যুতের কোন সংকট নেই। এই মিলে অপরিশোধিত চিনি প্রক্রিয়াজাত করে ৫০ কেজির বস্তা বাজারজাত করা হয়। কোন খুচরা বা ছোট প্যাকেটে চিনি বাজারজাত করা হয় না।

এস. আলম সুগার রিফাইনারী

চট্টগ্রামের এস. আলম সুগার রিফাইনারীতে গিয়ে দেখা যায়, চিনি উৎপাদন কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এখানে দৈনিক ৮০০-৯০০ মে. টন উৎপাদন হয়। ৫০ কেজির বস্তায় চার হাজার ৫০০ টাকার মূল্য মুদ্রিত রয়েছে, যা যথাযথ প্রতিয়মান হয়। ৫০ কেজির বস্তায় ২০০-২৮০ গ্রাম কম চিনি পাওয়া যায়। এছাড়া কারখানায় উৎপাদনরত অবস্থায় ৫০ কেজি বস্তায় বিক্রয়মূল্য উল্লেখ থাকলেও বাজারে ওই মিলের ৫০ কেজির চিনির বস্তায় কোন বিক্রয় মূল্য উল্লেখ থাকতে দেখা যায়নি।

সারাদেশে চিনির বাজারে অভিযান

গত ২২-২৩ অক্টোবর ঢাকা মহানগরসহ দেশব্যাপী ১০৩টি তদারকি/অভিযান চালায় ভোক্তা অধিদপ্তর। একইসঙ্গে দেশব্যাপী অভিযান/তদারকিকালে চিনির দাম বেশি রাখা এবং মূল্য তালিকা প্রদর্শন না করাসহ বিভিন্ন অপরাধে ২৭৮টি প্রতিষ্ঠানকে ১৪ লাখ ৭৫হাজার টাকা জরিমানা আরোপ ও আদায় করা হয়।

তদারকিতে যেসব অসঙ্গতি পেল

ঢাকার মৌলভীবাজার, কারওয়ান বাজার, মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট, টাউনহল মার্কেট, মিরপুর শাহআলী মার্কেট, চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জসহ দেশের প্রায় সকল জেলার বিভিন্ন পাইকারী ও খুচরা বাজারে তদারকি কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এসব বাজারসমূহে সরকার নির্ধারিত মূল্যে খোলা চিনি বিক্রয় হচ্ছে না এবং বাজারে চিনির সরবরাহ কম।

বাজারে প্যাকেটজাত চিনির সরবরাহ কম। কোথাও প্যাকেটজাত চিনির প্যাকেট কেটে খোলা চিনি হিসেবে বিক্রয় হচ্ছে। কিংবা প্যাকেটের এমআরপি মুছে বেশি দামে বিক্রয় করা হচ্ছে।

তদারকিকালে পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানান, মিলগেট, খাতুনগঞ্জ বা মৌলভীবাজার থেকে সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি মূল্যে চিনি ক্রয় করতে হচ্ছে। 

অপরদিকে খুচরা ব্যবসায়ীরা জানান, পাইকারি ব্যবসায়ীদের নিকট থেকে সরকার নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি মূল্যে চিনি ক্রয় করতে হচ্ছে।

পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীদের নিকট ক্রয় ভাউচার পাওয়া যায়নি। এর কারণ হিসেবে তারা জানান, মিল গেট বা মৌলভীবাজার, খাতুনগঞ্জের মত বড় পাইকারি বাজার থেকে তাদের ক্রয় ভাউচার দেওয়া হয় না। দু’ একজন ব্যবসায়ী ভাউচার দিলেও সেখানে চিনির পরিমাণ উল্লেখ থাকে কিন্তু টাকার পরিমাণ উল্লেখ থাকে না।

পাইকারি ব্যবসায়ীরা আরও জানান, ডিলারদের নিকট থেকে চাহিদা মোতাবেক চিনি পাচ্ছেন না। দুই মাস পূর্বে অর্ডারকৃত চিনি এখনো সরবরাহ করা হয়নি।

অধিদপ্তর কর্তৃক অনুষ্ঠিত সভাসমূহ

শুধু অভিযান বা তদারকিই নয়, ব্যবসায়ী এবং এই খাত সংশ্লিষ্টদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং আইন সম্পর্কে অবগত করতে বিভিন্ন ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে সভাও করে ভোক্তা অধিদপ্তর।

২৩ অক্টোবর কারওয়ান বাজার ও মৌলভীবাজারে ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ, পাইকারী ও খূচরা ব্যবসায়ীদের অংশগ্রহণে অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের উপস্থিতিতে দুটি মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়।

২৪ অক্টোবর চিনির মিল মালিক, পরিবেশক, পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতা, ক্যাব, বাজার ব্যবসায়ী সমিতি, ট্যারিফ কমিশনের প্রতিনিধি ও পেট্রো বাংলার প্রতিনিধির সঙ্গে মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়।

সভায় চিনির মজুদ পর্যালোচনা করে দেখা যায়, অপরিশোধিত চিনির মজুদ ও পাইপ লাইনে সর্বমোট তিন লাখ ৭৫ হাজার ৬৭৫ মে. টন চিনি মজুদ আছে এবং ঘাটতি নেই।

দাম বৃদ্ধির প্রেক্ষাপট সম্পর্কে যা বলে হয়েছে

মিলে চিনির উৎপাদন ও সরবরাহ কম: চিনি উৎপাদনের ক্ষেত্রে নির্ধারিত চাপের গ্যাস প্রয়োজন হয়। কিন্তু বর্তমানে যে পরিমাণে গ্যাসের চাপ প্রয়োজন চিনি উৎপাদনের ক্ষেত্রে সে পরিমাণে গ্যাস সরবরাহ হচ্ছে না মিলগুলোতে। ফলে চিনির উৎপাদন কম হওয়ায় বাজারে চিনির সরবরাহ কম হচ্ছে।

মুদ্রিত (পাকা) ভাউচার প্রদান না করা: চিনি ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে মুদ্রিত (পাকা) ভাউচার প্রদান করা হচ্ছে না। ফলে প্রতিটি স্তরে মূল্য কারসাজির সুযোগ নেয়া হচ্ছে।

এলসি খোলার জটিলতা: বড় এলসি খোলার ক্ষেত্রে অসুবিধার সম্মুখীন হচ্ছে মর্মে জানায় রিফাইনারি প্রতিষ্ঠানসমূহ। তারা পূর্বের ন্যায় সহজে এলসি খুলতে পারছেন না।

মিল গেটে ট্রাকে চিনি লোডের ক্ষেত্রে দীর্ঘ সময় জটিলতা: চিনি সরবরাহ নিতে ট্রাকগুলোকে সাত-আট দিন পর্যন্ত মিল গেটে অপেক্ষা করতে হয়। তাদের দীর্ঘ সময় অপেক্ষার ফলে চিনি পরিবহনের খরচ বেড়ে যায়।

ডলারের মূল্য বৃদ্ধির প্রভাব: ডলারের মূল্য বৃদ্ধির প্রভাবেও চিনির বাজার অস্থিতিশীল হয়েছে মর্মে ব্যবসায়ীরা জানান।

শুল্কহারের সমন্বয়: চিনি আমদানির ক্ষেত্রে এখনও শুল্কহার অত্যাধিক মর্মে রিফাইনারির মালিকরা উল্লেখ করেন। তারা শুল্কহার সমন্বয়ের প্রস্তাব করেন।

অত্যাবশ্যকীয় পণ্য বিপণন ও পরিবেশক নিয়োগ আদেশ, ২০১১ এর ‘ফরম ঘ’ অনুযায়ী এসও তে একক মূল্য উল্লেখ না করা: কতিপয় মিল কর্তৃক এসও তে চিনির একক মূল্য উল্লেখ করা হচ্ছে না।

পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে যেসব সুপারিশ করা হয়েছে

১. মিলগুলোকে তাদের সর্বোচ্চ উৎপাদন এবং সরবরাহ অব্যাহত রাখার নির্দেশনা প্রদান। 

২. মিল থেকে খুচরা পর্যায়ে পর্যন্ত চিনি কোথাও অসাধু উদ্দেশ্যে মজুদ করে বাজার অস্থিতিশীল করছে কি না গোয়েন্দা সংস্থা কর্তৃক তা নজরদারি করা।

৩. চিনির বাজার স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত ভ্রাম্যমাণ আদালত/বাজার অভিযান অব্যাহত থাকতে হবে।

৪. মূল্য পর্যালোচনার জন্য ‘মূল্য নির্ধারণ সংক্রান্ত জাতীয় কমিটি’র নিয়মিত সভা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

৫. চিনি উৎপাদনকারী মিলগুলোতে নির্ধারিত চাপের গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিতের বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

৬. মিল মালিক থেকে খুচরা পর্যায়ে ক্রয়-বিক্রয়ের ক্ষেত্রে মুদ্রিত (পাকা) ভাউচার প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

৭. এলসি খোলার ক্ষেত্রে বিদ্যমান জটিলতা দূর করতে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্তৃক ব্যবসায়ীদেরকে সহযোগিতা প্রদানের নির্দেশনা।

৮. মিল গেট থেকে চিনি পরিবহনে (ট্রাক) সরবরাহ করতে অপেক্ষমাণ সময় কমিয়ে আনতে হবে।

৯. এলাকাভিত্তিক ডিলার নির্ধারণ করে সেই ডিলারদের মাধ্যমে এলাকার বাজারসমূহে চিনি সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।

১০. মিলগুলো কর্তৃক অত্যাবশ্যকীয় পণ্য বিপণন ও পরিবেশক নিয়োগ আদেশ, ২০১১ এর ‘ফরম ঘ’ অনুযায়ী এসও তে চিনির একক মূল্য উল্লেখ করতে হবে।

১১. ঢাকাসহ বড় বড় বাজারসমূহে পাইকারি চিনি ব্যবসায়ীদের চাহিদামত মিল থেকে সরাসরি চিনি সরবরাহের ব্যবস্থা নিতে হবে।