মুরগীর বাজারে বড় ব্যবসায়ীদের ‘উল্টো’ খেলা

ভোক্তাকণ্ঠ রিপোর্ট: ছোট খামারিরা মুরগী বাজারজাত করায় কন্টাক্ট ফার্মিং এর কর্পোরেট হাউজগুলো মুরগীর দাম কমিয়ে দিয়েছে।

গত ২৩ মার্চ (বৃহস্পতিবার) জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে আয়োজিত এক সভায় খামারি পর্যায়ে মুরগী ১৯০ থেকে ১৯৫ টাকায় বিক্রির সিদ্ধান্ত নেয় চার কোম্পানি (কাজী ফার্মস, প্যারাগন পোল্ট্রি অ্যান্ড হ্যাচারি, আফতাব বহুমুখী ফার্মস ও সিপি বাংলাদেশ)।

অথচ সাধারণ খামারিদের মুরগী বাজারে আসার সঙ্গে সঙ্গে গত দুই দিনে এই দাম ১৬০ টাকায় নামিয়েছে কোম্পানিগুলো। ফলে খামারিদের উৎপাদন খরচের চেয়েও কমে ১৬০ থেকে ১৬৫ টাকায় ব্রয়লার মুরগী বিক্রি করতে বাধ্য করছে তারা। তাদের এই অসাধু তৎপরতার কারণে বড় কর্পোরেট হাউজের সঙ্গে চুক্তিভিত্তিক উৎপাদনকারীদের বাইরে থাকা খামারিরা প্রতি কেজিতে পাঁচ থেকে ১০ টাকা লোকসান দিয়ে মুরগী বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন।

এক থেকে দুই সপ্তাহের মধ্যে এসব সাধারণ খামারিদের মুরগী বিক্রি শেষ হলেই গত জানুয়ারির পরবর্তী সময়ের মতোই কর্পোরেট হাউজগুলো বড় অংকের টাকা বাজার থেকে তুলে নেবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

তথ্যমতে, দেশে প্রতিদিন ব্রয়লার মুরগীর চাহিদা তিন হাজার ৫০০ টন। খামার আছে এক লাখ ৬০ হাজার, আর বন্ধ রয়েছে প্রায় এক লাখ। সচল ৬০ হাজারের মধ্যে প্রায় ২০ হাজার খামার কর্পোরেট কোম্পানিগুলোর সঙ্গে চুক্তিভিত্তিক ব্রয়লার মুরগী উৎপাদন করছে। চুক্তিভিত্তিক ফার্মগুলোকে কম দামে বাচ্চা দেওয়াসহ মুরগী উৎপাদনে সকল সহযোগীতা করা হয়। আর বাকি ৪০ হাজার খামার নিজেরাই উৎপাদন করে, যাদেরকে মূলত প্রান্তিক বলা হয়।

এর আগে হঠাৎ করে বাড়তে থাকে ব্রয়লারের দাম। বাড়তে বাড়তে ১৫০ টাকার মুরগী মাসের ব্যবধানে ২৭০ টাকায় উঠে যায়। এরপর ডিম ও মুরগীর বাজারের নিয়ন্ত্রণ বড় কর্পোরেট কোম্পানিগুলো নিয়েছে বলে অভিযোগ করে ছোট খামারিরা। এমন অবস্থায় বাজার নিয়ন্ত্রণে ওই চারটি কোম্পানির সঙ্গে বসে জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর।

সংগৃহীত

রাজধানীর কাপ্তান বাজার এবং কারওয়ান বাজারের মুরগীর আড়তে মঙ্গলবার (২৮ মার্চ) ১৭০-১৭৫ টাকা কেজিতে ব্রয়লার মুরগী পাইকারিতে বিক্রি হয়েছে। এই মুরগী কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে আড়ৎদারেরা পাচ্ছেন ১৫৫-১৬০ টাকায়। কেজিতে তাদের পরিবহন খরচ যাচ্ছে ১০-১২ টাকা।

এ বিষয়ে কাপ্তান বাজারের ইউসুফ ব্রয়লার হাউজ থেকে মঙ্গলবার রাতে জানানো হয়, চাহিদার চেয়ে মুরগীর সরবরাহ বেড়েছে, যার কারণে দাম কমতির দিকে রয়েছে। বুধবার আরেকটু কমবে। তবে ১৫ রোজার পর থেকে আবারও মুরগীর দাম বাড়তে পারে।

একই দিন সেগুনবাগিচা, কারওয়ান বাজার, মিরপুর, যাত্রাবাড়ী, ফকিরাপুলে ১৮০ থেকে ২০০ টাকা কেজিতে ব্রয়লার মুরগী বিক্রি করতে দেখা গেছে।

কারওয়ান বাজার ও সেগুনবাগিচার বিক্রেতারা জানিয়েছেন, গত সপ্তাহেও ২৬০ থেকে ২৭০ টাকায় মুরগী বিক্রি করেছিলেন তারা।

মঙ্গলবার উত্তর যাত্রাবাড়ী বউ বাজার এলাকার মান্নান মুরগী হাউজে ব্রয়লার মুরগী বিক্রি হয়েছে ১৮০ থেকে ১৯০ টাকা, যা তার আগের দিন ছিলো ২০০ টাকা। আর সোনালী মুরগী বিক্রি হয়েছে ৩৪০ টাকা। 

এদিকে, কর্পোরেট কোম্পানিগুলো দাম কমানোয় ঢাকার বাজারগুলোতে ব্রয়লার মুরগীর দামে স্বস্তি ফিরেছে ক্রেতাদের মধ্যে। কিন্তু বেশি দামে মুরগীর বাচ্চা ও খাবার কিনে এখন লোকসানে পড়ার শঙ্কায় উদ্বিগ্ন ছোট খামারিরা। এছাড়াও এ লোকসানে টিকতে না পেরে ছোট খামারগুলো বন্ধ হয়ে গেলে কর্পোরেট সিন্ডিকেটে ব্রয়লারের বাজার আবারও অস্থির হয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ পোল্ট্রি এসোসিয়েশনের সভাপতি সুমন হাওলাদার ভোক্তাকণ্ঠকে বলেন, ‘কর্পোরেট কোম্পানি তাদের নিয়ন্ত্রিত খামারগুলোকে যে দামে বাচ্চা বা খাদ্য দিয়েছে, আমাদের সেই দামে না দেওয়ার কারণে মুরগী তুলতে পারছিলাম না। এ সময় তারা মাত্র ৫২ দিনে (৩১ জানুয়ারি থেকে ২৩ মার্চ) বাচ্চা এবং ব্রয়লার মুরগী থেকে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। আবার আমরা (রোজাকে সামনে রেখে) বেশি খরচেই মুরগী পালন করেছি কিছু লাভের আশায়৷ কিন্তু এখন সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে কম দামে মুরগী ছেড়ে প্রান্তিক খামারিদের ধ্বংস করে দিচ্ছে তারা। এভাবে ছোট খামারিদের ধ্বংস করে আবারও সিন্ডিকেটের মাধ্যমে মুরগীর বাজার অস্থির করে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পায়তারা করছে কর্পোরেট চক্র।’

একই কথা বলেন বাংলাদেশ প্রান্তিক পোল্ট্রি খামারি ঐক্য পরিষদের মহাসচিব কাজী মোস্তফা কামাল। তিনি বলেন, ‘আমাদের উৎপাদন খরচ পড়ছে কেজিতে ১৬৫-১৭০ টাকা। কিন্তু বিক্রি করতে হচ্ছে ১৫০-১৬০ টাকা। এভাবে চলতে থাকলে ছোট খামারিরা ধ্বংস হয়ে যাবে। কিন্তু প্রান্তিক খামারিদের বাঁচাতে সরকারি কোন তদারকি দেখছি না।’

বাংলাদেশ পোল্ট্রি এসোসিয়েশনের তথ্যমতে, দেশে অন্তত ৮০ শতাংশ ব্রয়লার উৎপাদন করে প্রান্তিক খামারিরা। আর ২০ শতাংশের মতো উৎপাদন করে কর্পোরেট কোম্পানিগুলো। কিন্তু কর্পোরেট সিন্ডিকেটের কাছে প্রতিনিয়তই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে সাধারণ খামার। তারা চুক্তিভিত্তিক ফার্মগুলোকে ৩৫-৪৫ টাকায় বাচ্চা দেয়, যা সাধারণ খামারিদের ৬০-৮০ টাকায় কিনতে হয়। মুরগীর খাদ্য এবং ওষুধে কম দাম রাখাসহ বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হওয়ার কারণে প্রান্তিক খামারিদের উৎপাদন খরচ বেশি পড়ে।’

তবে সিন্ডিকেটের বিষয়টি মানতে নারাজ কর্পোরেট কোম্পানিগুলো। তাদের মতে, মুরগীর বাজারে সিন্ডিকেট করা সম্ভব নয়। বর্তমানে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ বেশি হওয়ায় দাম কমেছে। এর আগে উৎপাদনের চেয়ে চাহিদা বেশি ছিল, তাই দাম বেড়েছিলো। আবারও মুরগীর দাম বাড়বে বলেও জানান তারা। 

সিপি গ্রুপের নিয়ন্ত্রণাধীন কন্টাক্ট ফার্মিংয়ের দায়িত্বে থাকা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা জোনের এক কর্মকর্তা ভোক্তাকণ্ঠকে বলেন, ‘প্রতি মাসে ঢাকা জোন থেকে চার লাখ পিস মুরগী সরবরাহের টার্গেট দেওয়া রয়েছে। এই মুরগী কন্টাক্টে থাকা প্রান্তিক খামারিদের কাছ থেকে সরবরাহ করা হয়। প্রতিদিন ১০ থেকে ১২ হাজার মুরগী সরবরাহ করা হয়, আর এর পুরোটাই প্রান্তিক খামারিদের কাছ থেকে। চাহিদার অন্তত ৮০ শতাংশ মুরগী প্রান্তিক খামারিরা উৎপাদন করে, আর বাকিটা আসে কর্পোরেট কোম্পানিগুলোর নিজস্ব ফার্ম থেকে।’

তিনি আরও বলেন, ‘খামারিরা প্রতি কেজি মুরগীর দাম পাচ্ছে ১৪৩ টাকা। প্রতি কেজি মুরগী সোমবার বিক্রি হয়েছে ১৫৭ টাকা, তার আগের দিন বিক্রি হয়েছে ১৭৩ টাকা। কিছু দিন আগে এই মুরগী সর্বচ্চ ২২০ টাকায়ও বিক্রি হয়েছে। ১৪৩ টাকার বেশি যে দাম পাওয়া যায়, সেই টাকার অর্ধেক খামারি এবং অর্ধেক কোম্পানি পায়। এর বিনিময়ে কোম্পানির পক্ষ থেকে ৪০ টাকায় বাচ্চা, কম দামে ওষুধ এবং ফিডসহ বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দেওয়া হয়।’

একই কথা বলেন কাজী ফার্মসের রাজশাহী জোনের একজন কর্মকর্তা। ভোক্তাকণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘সেখানে সোমবার ১৪৯ টাকা কেজিতে ব্রয়লার মুরগী বিক্রি করা হয়েছে, যা তার আগের দিন ছিল ১৬০ টাকা। তবে নরমাল ব্রয়লারের দাম কেজিতে আরও ১০ টাকা কমে বিক্রি হয়েছে। দাম কমে যাওয়ার কারণ হিসাবে তিনি জানান- গরমের কারণে মুরগী বড় করা সম্ভব হচ্ছে না। যার কারণে খামারিরা মুরগী ছেড়ে দিচ্ছে। এছাড়াও রমজানের আগে মুরগীর যে চাহিদা ছিলো, মাস শেষ হয়ে আসায় বর্তমানে সেই চাহিদা অনেক কমে গেছে। তবে এপ্রিলে দাম আবারও বেড়ে যাবে।’

সরকার নির্ধারিত দামে বিক্রি না করে লোকসান দিয়ে বিক্রি করছেন কেন- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘এটা যেহেতু জাতীয় বিষয়, তাই তা কোম্পানি জানে।

এ বিষয়ে কাজী ফার্মসের পরিচালক কাজী জাহিন হাসান এবং প্যারাগণ ফার্মসের পরিচালক মশিউর রহমানের মুঠোফোনে একাধিক বার চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

তবে কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এর বাজার বিশ্লেষক কাজী আব্দুল হান্নান বলেন, ‘সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরের অপরিনামদর্শী নীতিমালা এবং বাজার তদারকির অভাবে দেশের মুরগী উৎপাদন, বিপণন এবং বাজারের নিয়ন্ত্রণে কয়েকটি কোম্পানীর একচেটিয়াত্ব সৃষ্টি হয়েছে। যার খেসারত প্রাথমিক ভাবে দিয়েছে ছোট ছোট পোল্ট্রি খামারের উদ্যোক্তারা। এখন দিতে হচ্ছে সাধারণ ক্রেতাদের।’

এ বিষয়ে জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান ভোক্তাকণ্ঠকে বলেন, ‘বাজার নিয়ন্ত্রণে কাজী ফার্মস সহ চারটি কর্পোরেট কোম্পানির সঙ্গে আমরা মতবিনিময় করেছিলাম। মতবিনিময় সভায় তারা বলেছিলেন- তাদের প্রতি কেজি মুরগীর উৎপাদন খরচ পড়ছে ১৩০-১৪০ টাকা। যেহেতু প্রান্তিক খামারিদের উৎপাদন খরচ একটু বেশ পড়ছে। তাই সব দিক বিবেচনা করে কাজী আস্বস্ত করেছিল- রমজান মাসে তারা ১৯০-১৯৫ টাকায় (খামারি পর্যায়ে) ব্রয়লার মুরগী বিক্রি করবে। কিন্তু এখন শোনা যাচ্ছে, তারা মিলগেট থেকে ১৬০ টাকায় ছাড়ছে। আর এতে বাধ্য হয়ে প্রান্তিক খামারিদেরও কম দামে ছাড়তে হচ্ছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘এই বিষয়ে গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে বাজার তদারকি করা হচ্ছে। বাজার নিয়ন্ত্রণে আমরা এ বিষয়ে অ্যাকশনে যাবে। কারণ বাজার স্থিতিশীল রাখতে প্রান্তিক খামারিদেরকেও বাচিয়ে রাখতে হবে।’

তবে কাজী আব্দুল হান্নান বলেছেন, ‘চুক্তিবদ্ধ হয়ে বাচ্চা ও পোল্ট্রি ফিড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের নির্ধারণ করা দামে খামারিদের বাধ্য করা হচ্ছে জানার পরও প্রাণিসম্পদ অধিদফতর ব্যবস্থা না নেয়ায় ধীরে ধীরে অধিকাংশ খামার তাদের চুক্তির আওতায় চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। যেসব উদ্যোক্তা যায়নি তারা এই দাদন ব্যবসায়ীদের বাজার কারসাজির কারণে লোকসান দিয়ে বিনিয়োগ হারাচ্ছে। স্বাধীন খামারিদের ডিম বা মুরগী বাজারে আসা বন্ধ হলেই এরা যথেচ্ছ দাম হাকিয়ে ভোক্তার পকেট লুটে নিচ্ছে। রমজানের প্রারম্ভে এক দফার পর ঈদ সামনে রেখে দ্বিতীয় দফা পকেট কাটার খেলা শুরু করছে এরা। এতে আপাতত স্বস্তি মনে হলেও বাস্তবতা ভিন্ন।’

এদিকে, কম দামে ব্রয়লার মুরগী বিক্রি করায় ছোট খামারিরা লোকসানের মুখে পড়েছে বলে জানিয়েছেন প্রান্তিক খামারিরা। তাই প্রান্তিক খামারিদের টিকিয়ে রাখতে মুরগী এবং ডিম উৎপাদনের সুযোগ সাধারণ খামারিদের হাতে এবং বাচ্চা ও ফিড উৎপাদনের দায়িত্ব কর্পোরেট কোম্পানিগুলোর হাতে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন প্রান্তিক খামারিরা।