খাতুনগঞ্জে পেঁয়াজের বড় দরপতন

ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: অভ্যন্তরীণ বাজারে সরবরাহ ঠিক রাখতে গত ৭ ডিসেম্বর পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে ভারত সরকার। এই ঘোষণার পর পরই অস্থিতিশীল হতে শুরু করে বাংলাদেশের পেঁয়াজের বাজার। হু হু করে বাড়তে থাকে দাম। কেজিপ্রতি দাম গিয়ে ঠেকে ২৪০ টাকায়।

রমজান মাসে আরও বাড়তে পারে পেঁয়াজের দাম- এমন শঙ্কা থেকে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানির সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। ভারত সরকারও এতে নীতিগত সম্মতি দেয়। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, রোজার আগেই দেশে আসবে ভারতীয় পেঁয়াজ। তবে ঘোষণার মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো সরকারি ভাবে দেশে আসেনি ভারতীয় পেঁয়াজ।

তবে সীমান্ত দিয়ে চোরাইপথে আসা পেঁয়াজে ভরে গেছে চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের আড়ত। এতে মাত্র ১০ দিনের ব্যবধানে ভোগ্যপণ্যে দেশের দ্বিতীয় বৃহৎ পাইকারি বাজারটিতে ভারতীয় পেঁয়াজের দাম কমেছে কেজিপ্রতি ৫৫-৬০ টাকা। কমেছে দেশি পেঁয়াজের দামও।

বুধবার খাতুনগঞ্জ ও চাক্তাইয়ের মোকামে দেশি পেঁয়াজ ৪০ থেকে ৭০ টাকায় এবং ভারতীয় নাসিক জাতের পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৬০-৬৫ টাকায়। ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশি পেঁয়াজ পুরোপুরি বাজারে আসায় এবং চোরাইপথে আসা ভারতীয় পেঁয়াজের সরবরাহ বেড়ে গেছে। অন্যদিকে চাহিদা কম থাকা এবং পচনের শঙ্কায় দ্রুত কমছে দাম।

ভারতের স্থানীয় বাজারে পেঁয়াজের দাম বেড়ে যাওয়ায় গত বছরের অগাস্টে সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে পেঁয়াজ রপ্তানিতে ভারত সরকার ৪০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে। এরপর গত অক্টোবরে পেঁয়াজের সর্বনিম্ন রপ্তানি মূল্য নির্ধারণ করা হয় টনপ্রতি ৮০০ মার্কিন ডলার। কিন্তু অভ্যন্তরীণ বাজারে পেঁয়াজের দাম বাড়ায় এবং এসব পদক্ষেপ তেমন কার্যকর না হওয়ায় গত ০৮ ডিসেম্বর থেকে পেঁয়াজ রপ্তানি পুরোপুরি বন্ধ করে ভারত সরকার। ভারতের ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফরেন ট্রেড কার্যালয় গত ৭ ডিসেম্বর এক আদেশে চলতি বছরের ৩১ মার্চ পর্যন্ত পেঁয়াজ রপ্তানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।

ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দিলে বাংলাদেশের বাজারে হু হু করে বাড়তে থাকে দাম। দেশের বাজারে ২৪০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয় প্রতি কেজি পেঁয়াজ। পরে দেশি পেঁয়াজ বাজারে আসা শুরু করলে ধীরে ধীরে কমে ৫০-৬০ টাকা কেজিতেও পেঁয়াজ বিক্রি হয়। ফেব্রুয়ারি মাসের শুরু থেকে আবারও বাড়তে থাকে পেঁয়াজের দাম। খুচরা বাজারে রোজার শুরুতেও ১২০-১৩০ টাকা কেজিতে ভারতীয় পেঁয়াজ বিক্রি হয়।

এদিকে, দেশের বাজারে পেঁয়াজের দাম না কমায় ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানির জন্য দেনদরবার শুরু করে সরকার। রমজান মাসে দেশের বাজারে দাম কমায় নির্দিষ্ট পরিমাণে চিনি ও পেঁয়াজ রপ্তানির অনুমতি দিতে ভারতকে আনুষ্ঠানিক চিঠি দেয় বাংলাদেশ সরকার। ফলে ৫০ হাজার টন পেঁয়াজ ও এক লাখ মেট্রিক টন চিনি আনার ঘোষণা দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু সরকারি ঘোষণার মাস পেরোলেও এখনো সরকারি উদ্যোগে ভারত থেকে পেঁয়াজ আমদানি শুরু হয়নি।

তবে বাংলাদেশে পেঁয়াজের অতিরিক্ত দামের সুযোগে ভারত থেকে চোরাইপথে পেঁয়াজ আসা শুরু হয়। ফেব্রুয়ারির শুরু থেকে চোরাইপথে আসা পেঁয়াজ বিক্রি শুরু হয় খাতুনগঞ্জ ও চাক্তাইয়ের মোকামে।

বুধবার সরেজমিনে দেখা যায়, খাতুনগঞ্জ ও চাক্তাইয়ের মোকামগুলো পেঁয়াজে ভর্তি, বিক্রিও হচ্ছে সমানতালে। তবে পাইকারি বাজারে দাম কমার প্রভাব আনুপাতিকহারে খুচরা বাজারে পড়েনি। খুচরা ব্যবসায়ীদের দাবি, এখনো দোকানে রমজানের আগে কেনা পেঁয়াজ রয়েছে। যে কারণে খুচরা দোকানগুলোর বড় অংশ এখন লোকসান দিয়ে পেঁয়াজ বিক্রি করছে। পাইকারি বাজার থেকে খুচরা বাজারে কেজিপ্রতি ২৫-৩০ টাকার পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়।

ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) তাদের বুধবারের প্রতিবেদনে বলছে, ঢাকা মহানগরীর খুচরা বাজারগুলোতে দেশি পেঁয়াজ প্রতি কেজি ৬০-৭০ টাকা এবং আমদানি করা পেঁয়াজ ৮০-১০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। এক সপ্তাহ আগেও দেশি পেঁয়াজ ছিল ৮০-১০০ টাকা এবং ভারতীয় পেঁয়াজ ছিল ১১৫-১২০ টাকা। এক বছর আগে এই সময়ে দেশি পেঁয়াজের দাম ছিল মাত্র ৪০-৫০ টাকা কেজি এবং আমদানি করা পেঁয়াজ ছিল প্রতি কেজি ৩৫-৪৫ টাকা।

এদিকে, বুধবার সকালে খাতুনগঞ্জ ও চাক্তাইয়ের আড়তগুলোতে কথা হয় আড়তদার-ব্যবসায়ীদের সঙ্গে। মধ্যম চাক্তাইয়ের বশর অ্যান্ড সন্সের ম্যানেজার মো. শহীদ বলেন, ‘আড়তে দেশি পেঁয়াজের পাশাপাশি ভারতীয় পেঁয়াজে ভরে গেছে। মঙ্গলবার ভারতীয় পেঁয়াজ ৫৫ টাকা এসেছিল। আজ পাঁচ টাকা বেড়েছে। রোজার আগেও ভারতীয় পেঁয়াজ ১২০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। একই ভাবে দেশি পেঁয়াজের দামও কমেছে। মাঝারি সাইজের পেঁয়াজ ৫০-৫২ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে।’

খাতুনগঞ্জের মেসার্স জামেনা ট্রেডিংয়ের পরিচালক মো. আজগর হোসেন বলেন, ‘রোজার শুরুতে সব ধরনের ভোগ্যপণ্যের চাহিদা বেড়ে যায়। এ সময় বেশির ভাগ মানুষ পুরো মাসের বাজার করেন। যে কারণে রোজার শুরুতে একত্রে বেশি পেঁয়াজ কিনেছেন ভোক্তারা। রোজা শুরুর পর পাইকারি কিংবা খুচরা বাজারে পেঁয়াজের বিক্রি কমেছে। কিন্তু আড়তে পেঁয়াজের সরবরাহ স্বাভাবিক ছিল। যে কারণে দাম দ্রুত কমে গেছে।’

তিনি বলেন, ‘বর্তমানে পাবনা, চুয়াডাঙ্গা, ফরিদপুর, রাজবাড়ি থেকে দেশি পেঁয়াজ আসছে খাতুনগঞ্জের আড়তে। ফরিদপুরের ছোট ও মাঝারি দানার পেঁয়াজ ৪০ থেকে ৫৫ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। পাশাপাশি পাবনার মোটা দানার ভালো পেঁয়াজ ৬৫-৭০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। বুধবার ফরিদপুরের বাজারে মোটা দানার পেঁয়াজ দুই হাজার ৪০০ থেকে আড়াই হাজার টাকায় বিক্রি হয়। খাতুনগঞ্জে আসতে কেজিতে ৬৮ টাকা পড়ছে (যাবতীয় খরচসহ ক্রয়মূল্য)।’

খাতুনগঞ্জের হামিদউল্লা মিয়া বাজারের ব্যবসায়ী আবু তৈয়ব বলেন, ‘বাজারের প্রতিটি আড়ত পেঁয়াজে ভর্তি। অনেকে আড়তে রাখতে না পেরে ফুটপাতে পেঁয়াজ রেখেছেন। দেশি পেঁয়াজের পাশাপাশি ভারতীয় পেঁয়াজের দাম কমে গেছে। বেশি কমেছে ভারতীয় পেঁয়াজের দাম। রোজার আগে ভারতীয় ১২০ টাকার পেঁয়াজ এখন ৬০ টাকা। আবার রোজার আগে ৯০ টাকার দেশি পেঁয়াজ এখন ৫০-৫৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।’

খাতুনগঞ্জের লামার বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. ইদ্রিস বলেন, ‘ভারত থেকে বৈধপথে কোনো পেঁয়াজ আসছে না। দেশে এখন যত ভারতীয় পেঁয়াজ আছে সবই চোরাইপথে এসেছে। চোরাইপথে আসা ভারতীয় পেঁয়াজে এখন বাজার সয়লাব হয়ে গেছে।’

তিনি বলেন, ‘রোজার আগে যখন দাম বেশি ছিল তখন দেশে পেঁয়াজ কাটা তেমন শুরু হয়নি। এখন দেশি পেঁয়াজের ভরপুর মৌসুম। তাই বাজারে দেশি পেঁয়াজের সরবরাহ বেড়েছে। পাশাপাশি ভারতীয় পেঁয়াজ বাজারে থাকার কারণে দাম কমে গেছে। তাছাড়া রোজার শুরুতে চাহিদা বেশি ছিল, এখন চাহিদা অনেক কমে গেছে। এতে খুচরায় বেচাকেনা কম, তাই পাইকারি বাজারে দাম কমেছে।’ তবে বর্তমান বাজার দামে কৃষক কিংবা আড়তদার ব্যবসায়ীদের কোনো সমস্যা হচ্ছে না বলে জানান তিনি।

এদিকে, পাইকারি বাজারে দাম অর্ধেক কমে যাওয়ার প্রভাব খুচরা বাজারে পড়েনি। বুধবার দুপুরে নগরীর কাজীর দেউড়ি এলাকার মুদি দোকানগুলোতে ৭৫-৯০ টাকা কেজিতে ভারতীয় পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে। ছোট ও মাঝারি দানার দেশি পেঁয়াজও বিক্রি হচ্ছে ৬০-৭৫ টাকা কেজিতে।

বাজারের ফয়েজ স্টোরের স্বত্বাধিকারী বাবুল বড়ুয়া বলেন, ‘মুদি দোকানে সব ধরনের আইটেম রাখতে হয়। ক্রেতাদের চাহিদা মেটানোর জন্য রোজার আগের পেঁয়াজ এখনো বিক্রি করছি। রোজার আগে ১১০ টাকা কেনা পেঁয়াজ ৮০-৯০ টাকায় বিক্রি করছি। কেজিতে ২০-৩০ টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে।’ জাগো নিউজ।