নিত্যপণ্যের দামে অসহায় ভোক্তা

ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: ‘পাঁচ জনের সংসারে মাসে সয়াবিন তেল লাগত ছয় থেকে সাত লিটার। সেটা কমিয়ে চার লিটারে এনেছি। আদা, পেঁয়াজ, রসুন সবকিছুই দামের কারণে রান্নায় ব্যবহার কমানোর পরও মাসের বাজারে হিসাব মিলছে না। এভাবে চলতে থাকলে পরিবার নিয়ে বেঁচে থাকাটা কষ্টকর হয়ে যাবে।’

কথাগুলো বলছিলেন মিরপুরের বাসিন্দা আতিকুর রহমান। সম্প্রতি রাজধানীর শেওড়াপাড়া বাজারে কথা হয় তার সঙ্গে।

তিনি বলেন, ‘বাবার দেওয়া দুটি ফ্ল্যাটের একটিতে নিজে থাকি এবং আরেকটির ভাড়া দিয়েই সংসার চলে আমার। ছেলের লেখাপড়ার খরচ, বাড়ির ইউটিলিটি বিল পরিশোধের পর যে টাকা অবশিষ্ট থাকত, তা দিয়ে ভালোই চলছিল। তবে বছর ব্যবধানে সব পণ্যের দাম আকাশচুম্বী হয়ে যাওয়ায় কাটছাঁটেও হিসাব মেলে না। বাজারে একবার পণ্যের দাম বেড়ে গেলে আর কমছে না। এটা দুঃখজনক।’

‘পণ্যের দাম কয়েক দফায় বাড়ার পর বাজারে তদারকি শুরু হয়। তদারকির পরও বাড়তি দামেই বাজার স্থিতিশীল হচ্ছে। একেক সময় একেক পণ্যের দাম নিয়ে খেলছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। সরবরাহের দোহাই দিয়ে একেকটি পণ্যের দাম বাড়িয়ে সপ্তাহ ব্যবধানে বাজার থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে শত শত কোটি টাকা। আর আমরা ভোক্তারা অসহায় হয়ে সয়ে যাচ্ছি, সরকারের দুর্বলতার কারণে এমনটি হচ্ছে’ বলে মনে করেন শেওড়াপাড়া বাজারে কেনাকাটা করতে আসা মো. ইসমাইল।

তিনি বলেন, ‘পেঁয়াজ, মরিচ, আলু, আদা, রসুন, তেল, ডাল, চাল থেকে শুরু করে সব পণ্যই সরবরাহের দোহাই দেখিয়ে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। তারা এতটাই শক্তিশালী যে, সরকারও অসহায়ত্ব প্রকাশ করছে। এই পরিস্থিতি থেকে লোকজনকে করতে না পারলে সব উন্নয়ন ধূলিসাৎ হয়ে যাবে।’

নিত্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতিতে জনগণের নাভিশ্বাস উঠেছে। জীবন চালাতে হিমশিম খাচ্ছে নিম্ন ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো। দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারের দু-একটি সংস্থা মাঠে কাজ করলেও সুফল পাচ্ছেন না ভোক্তা। অসাধু ব্যবসায়ীদের লাগাম টানতে না পারলে ভোক্তারাই ভুক্তভোগী হবেন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে সরকারের শক্তিশালী পদক্ষেপ এখন সময়ের দাবি বলে মনে করেন তারা।

চলতি বছরের ০১ জানুয়ারি থেকে ২৯ জুলাই- এই সাত মাসে ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) তথ্য বিচারে চাল, তেল, চিনি, আলু, পেঁয়াজ, শুকনা মরিচ, রসুন, হলুদের দাম ১০ থেকে ১০০ টাকা কেজিতে বেড়েছে।

টিসিবির তথ্য বলছে, ২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে মোটা চাল ছিল ৪৬ থেকে ৫২ টাকা। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৮ থেকে ৫২ টাকা। পাম তেল ১১৭ থেকে বেড়ে ১৩০ টাকায় দাঁড়িয়েছে। আলুর কেজি ছিল ১৬ থেকে ২২ টাকা। এখন ৩৬ থেকে ৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

৩৩-৪৮ টাকা কেজির পেঁয়াজ জুলাইয়ে ৪৫ থেকে ৬৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ৭৫ টাকা থেকে ১৩০ টাকার রসুন বিক্রি হচ্ছে প্রকারভেদে ২০০ থেকে ২৫০ টাকায়। ১৮০ টাকা কেজির হলুদ এখন ৩০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ৪০০ টাকা কেজির শুকনা মরিচ বিক্রি হচ্ছে ৫০০ টাকা দরে। ৯০ টাকার আদা ৪০০ টাকা পর্যন্তও বিক্রি হয়েছে। তবে আটার দাম কেজিতে আট টাকা কমেছে, ডাল কেজিতে ১০ টাকা কমে ১১৫ টাকা হয়েছে এবং লবণের বাজার অপরিবর্তিত রয়েছে।

আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলেও অনেক পণ্যের ক্ষেত্রে স্থানীয় বাজারে তার প্রতিফলন নেই। ফলে ভোক্তারা এর সুফল পাচ্ছেন না। আমদানির তুলনায় খুচরা বাজারে নিত্যপণ্যের দামে পার্থক্য অনেক বেশি। কৃষিপণ্যের উৎপাদন মূল্যের চেয়ে খুচরা দরেও একই পরিস্থিতি।

অন্যদিকে, ডলার সংকট, সময়মতো এলসি (ঋণপত্র) খুলতে না পারা এবং পণ্য খালাসে বিলম্বের কারণে দেশে আমদানির পর পণ্যের দাম বাড়তি হচ্ছে। এছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়তি দামের কারণেও কিছু পণ্যের দাম বেড়েছে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।

কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) প্রেসিডেন্ট গোলাম রহমান বলেন, ‘সমস্যা অনেক রয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেল, চিনি, গম- এসবের দাম অর্ধেকের বেশি কমেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশেও দাম বাড়ে, সে পণ্য এখানে আসুক বা না আসুক। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলে দেশে সেই অনুপাতে দাম কমে না। এক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোও বাজার নিয়ন্ত্রণে সেভাবে ভূমিকা রাখতে পারেনি।’

এছাড়া দাম বাড়ার কারণের মধ্যে রয়েছে বাজার ব্যবস্থাপনার কাঠামোগত ও নীতিগত দুর্বলতা, যথাযথ প্রতিযোগিতার অভাব, ক্রয়-বিক্রয়ের রেকর্ড সংরক্ষণের অভাব। নিত্যপণ্যের দাম কমানোর জন্য ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের জনবল বাড়িয়ে দেশব্যাপী কার্যকর তদারকি কার্যক্রম বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে বলে তিনি মনে করেন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাজার সিন্ডিকেটের হাতে ভোক্তা জিম্মি। পণ্যের দাম বৃদ্ধির পেছনে একটি চক্র খুব শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে ভোক্তাকে নাজেহাল করছে। সরকারের উচিৎ হবে একাধিক সংস্থাকে দিয়ে বাজারের নিয়ন্ত্রণ করা, যাতে করে এর সুফল ভোক্তা পান। এতে সমাজে পিছিয়ে পড়া জনগণ কিছুটা হলেও উপকৃত হবে এবং সরকারের উন্নয়ন সার্থকতা পাবে।

সৌজন্যে, বাংলানিউজ।