ভোক্তার আয় বাড়াতে ও কর্মসংস্থানে গুরুত্ব দিতে হবে

ভোক্তাকণ্ঠ ডেস্ক: ভোগ্য পণ্যের উচ্চমূল্যের কারণে ভোক্তারা খুবই কষ্টে আছে। এই মুহূর্তে ভোক্তাদের স্বস্তি দিতে তাদের আয়-রোজগার বাড়ানো এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরির দিকে সরকারকে গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলেছেন কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)-এর সভাপতি গোলাম রহমান।

এক সাক্ষাৎকারে তিনি এ বিষয়ে কথা বলেন।

প্রশ্ন: ভোগ্য পণ্যের ব্যবস্থাপনায় কী ধরনের সংকট দেখছেন? এই অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় কী?

গোলাম রহমান: ভোগ্য পণ্যের বাজারে এখন বহুমুখী সংকট। দেশের অর্থনীতি বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে সংযুক্ত থাকায় বিদেশে কোনো সংকট দেখা দিলে তার প্রভাব এখানেও পড়ে। করোনা-পরবর্তী সময়ে অনেক পণ্য সরবরাহ কমেছে, যার ফলে অনেক ভোগ্য পণ্যের দাম এখন বেশ চড়া। এসব কারণে মূল্যস্ফীতিও বেশ ঊর্ধ্বমুখী। এই প্রেক্ষাপটে আমদানি ব্যয় বেড়েছে। আমদানি ব্যয় বাড়ার আরেকটি কারণ হলো জাহাজভাড়া অনেক বেড়েছে। বহুদিন ধরে আমদানি ও রপ্তানির ভারসাম্যের মধ্যে আমদানি কম হয়েছে, রপ্তানি বেশি হয়েছে। ফলে দেশের রিজার্ভও বেড়েছিল। কিন্তু কয়েক মাস ধরে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স কমে আমদানির পরিমাণ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেছে। এতে দেশের রিজার্ভের ওপর চাপ পড়েছে। ডলারের সংকট দেখা দিয়ে ডলারের বিনিময় হার ৮৬ টাকা থেকে বেড়ে ১১০ টাকা পর্যন্ত হয়ে যায়। এমন পরিস্থিতিতে ভোগ্য পণ্যের আমদানি মূল্য অনেক বৃদ্ধি পেয়ে বাজারে পণ্যের দাম বেড়েছে।

বর্তমানে ভোগ্য পণ্যের ব্যবসাটি গুটিকয়েক ব্যবসায়ীর হাতে চলে গেছে। যার কারণে ব্যবসায় প্রতিযোগিতা না থাকায় মনোপলি সৃষ্টি হয়েছে। ব্যবসায়ীরা চাইলেই পণ্যমূল্য বৃদ্ধি করে ভোক্তাদের ওপর চাপিয়ে দিতে পারে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা আমরা এখন দেখছি। এটি কোনোভাবেই ভোক্তাদের অনুকূলে নয়। বর্তমানে ভোক্তার অবস্থা খুবই নাজুক, বিশেষ করে নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্তের মানুষ অনেকটা নাভিশ্বাস অবস্থায় আছে। উত্তরণের উপায় বলতে গেলে, এ অবস্থায় মানুষের আয়-রোজগার বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। আমরা সব সময় দেখে আসছি, পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের আয়ও বাড়বে, তারপর নতুন একটি স্থিতিশীল অবস্থায় যাবে। এটা যুগে যুগে হয়ে আসছে। হয়তো সামনে এ রকম একটা মধ্যমেয়াদি বা দীর্ঘমেয়াদি সমাধান আসবে। ভোক্তার আয়ের পরিমাণ যদি তার ব্যয়ের চেয়ে বেশি হয়, তাহলে ভোক্তার জীবনমানে সুবিচার হয়।

প্রশ্ন: ডলার সংকটের কারণে ব্যবসায়ীরা চাহিদামতো এলসি খুলতে পারছেন না। এতে বাজারে দীর্ঘ মেয়াদে পণ্যের সংকট হতে পারে। বাজারে পণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে সরকারের করণীয় কী?

গোলাম রহমান: ডলার সরবরাহ বাড়াতে সরকার নানা ধরনের চেষ্টা করছে। ডলার সাশ্রয়ে সরকার এরই মধ্যে বিলাসবহুল পণ্য আমদানি বন্ধ রাখতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। এগুলো ইতিবাচক মনে করি। আর ভোগ্য পণ্য আমদানিতে কোনো ধরনের বিধি-নিষেধ দেওয়া ঠিক হবে না। সরকারের উচিত হবে, নিত্যপণ্যের আমদানি স্বাভাবিক রাখা, যাতে মানুষের প্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহে সংকট না থাকে। এটা সরকার করছে বলেই রিজার্ভের পরিমাণ কমছে। আমদানিনির্ভরতা কমাতে দেশে যদি ভোগ্য পণ্যের উৎপাদন বাড়ানো যায়, তাহলে আরো ভালো। বিলাসপণ্য আমদানি হ্রাস করে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধি করতে হবে, তাহলে সংকট মোকাবেলা করা সম্ভব হবে। তবে আইএমএফের ঋণ পেলেও দ্রুত এই সংকট কেটে যাবে। এখনো দেশে পর্যাপ্ত রিজার্ভ রয়েছে, আমরা আশা করতে পারি, খুব দ্রুতই ডলার সংকট কেটে যাবে।

প্রশ্ন: কয়েক দিন পর পর একেক পণ্যের সংকট দেখিয়ে ব্যবসায়ীরা দাম বাড়াচ্ছেন। এটা কি আসলেই সংকট, নাকি তাদের কারসাজি?

গোলাম রহমান: আমাদের দেশের বড় ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে খুচরা ব্যবসায়ী পর্যন্ত সবার মধ্যেই এখন অতিমুনাফার প্রবণতা বেড়ে গেছে। লাভের প্রত্যাশা বেড়ে যাওয়ায় বিশেষ করে আমদানি পণ্যের ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি, কখনো চিনির সংকট হয়, কখনো ভোজ্য তেলের সংকট হয়। সম্প্রতি আমরা নানা রকমের সংকট দেখেছি। এখানে কিছুটা ব্যবসায়ীদের কারসাজি আছে বলে আমার মনে হয়। ব্যবসায়ীরা এখন আর স্বাভাবিক লাভের মধ্যে থাকতে চান না। যেকোনো উপায়ে লাভের পরিমাণ বৃদ্ধির চেষ্টা করেন। তাদের এই দৃষ্টিভঙ্গি অনেক ক্ষেত্রে সংকট সৃষ্টিতে দায়ী বলে আমার মনে হয়।

প্রশ্ন: বর্তমান পরিস্থিতিতে বাজার তদারকির ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। বাজার তদারকিতে সরকারকে আরো গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন আছে কি?

গোলাম রহমান: বর্তমানে নিত্যপণ্যের বাজারে যে বহুমুখী সংকট, এটা শুধু বাজার তদারকির অনুপস্থিতির কারণে হচ্ছে, তা কিন্তু নয়। কিছু সমস্যা রয়েছে, যেগুলো তাৎক্ষণিকভাবে সমাধান করাও সম্ভব নয়, কারণ সেগুলো সরকার বা আমাদের ব্যবসায়ীদের আওতার বাইরে। তবে বাজার তদারকির প্রয়োজন আছে, সাপ্লাই চেইন যাতে ঠিক থাকে। নানা কারণে দাম বেশি বা কম হতে পারে, কিন্তু বাজারে যেন পণ্যের অভাব দেখা না দেয়। যদি বাজারে পণ্যের সংকট দেখা দেয়, তাহলে ভোক্তারা কিন্তু আরো বিপদে পড়বে। বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে কেউ যাতে অনৈতিকভাবে অতিমুনাফা করতে না পারে। এসব ক্ষেত্রে তদারকি আরো বৃদ্ধি করার প্রয়োজন আছে। শুধু খুচরা পর্যায়ে নয়, পাইকারি ও রিফাইনারি এবং উৎপাদন পর্যায়েও এই তদারকি করতে হবে। অন্য যেসব কারণে মূল্য পরিস্থিতি নাজুক হয়ে পড়েছে, সেই দিকগুলোতেও সরকার দৃষ্টি দিতে পারে। তবে এটা কোনো একক মন্ত্রণালয়ের কাজ নয়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও প্রতিযোগিতা কমিশন—এদের যথেষ্ট দায়িত্ব আছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। তাদের পাশাপাশি উৎপাদন, পরিবহনব্যবস্থা ও আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক রাখতে কাজ করতে হবে কৃষি মন্ত্রণালয়, প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়, সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে। কেউ যদি কৃত্রিম সংকট তৈরি করে অতিমুনাফা করতে চায়, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

প্রশ্ন: নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্যে স্বল্প আয়ের মানুষ বর্তমানে খুবই কষ্টে আছে। সরকার টিসিবি ও ওএমএসের কার্যক্রমের মাধ্যমে যতটুকু পণ্য দিচ্ছে, সেটা যথেষ্ট নয়। এই মুহূর্তে তাদের জন্য সরকার কী করতে পারে?

গোলাম রহমান: স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য ভর্তুকি মূল্যে যে পণ্য সরবরাহ করছে, এটার জন্য সরকারকে সাধুবাদ দিতে হয়। এসব কার্যক্রমের জন্য স্বল্প আয়ের মানুষের মধ্যে যারা এসব পণ্য পাচ্ছে, তারা কিছুটা হলেও স্বস্তিতে আছে। তবে টিসিবির মাধ্যমে যেসব পণ্য দেওয়া হচ্ছে, সেটা স্থানীয় বাজার থেকে কিনে দেওয়া হচ্ছে। এতে মোট পণ্যের সরবরাহ কিন্তু বাড়ছে না। সার্বিকভাবে যাতে পণ্যের সরবরাহ বৃদ্ধি পায় সরকারকে ওই ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। সরকার সরাসরি যদি আমদানি করে এসব পণ্য সরবরাহ করে, তাহলে বাজারে পণ্যের ওপর প্রভাব পড়বে না। এতে যারা এসব পণ্য পাচ্ছে, তাদের বাইরের লোকজনও উপকৃত হবে।

প্রশ্ন: পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বেড়েছে। মূল্যস্ফীতির এই চাপের মধ্যে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো ঠিক হবে কি?

গোলাম রহমান: পাইকারি পর্যায়ে প্রায় ২০ শতাংশ দাম বাড়ার ফলে বিতরণ কম্পানিগুলোর ব্যয় বাড়বে, এটা স্বাভাবিক। কিন্তু বিদ্যুৎ খাতে অনেক অপচয়, অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি আছে। সিস্টেম লস কমানোসহ বিতরণ কম্পানিগুলোর ব্যয় হ্রাসে যথেষ্ট সুযোগ আছে। তারা এসব ব্যয় কমিয়ে আনতে পারলে খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রয়োজন হবে না। বিতরণ কম্পানিগুলোর আবেদন বিইআরসিকে রেগুলেশন অনুযায়ী অত্যন্ত নিবিড়ভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কারণ এই মুহূর্তে খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়লে মূল্যস্ফীতি আরো বাড়বে। এতে স্বল্প আয়ের মানুষজন আরো চাপে পড়বে।

প্রশ্ন: সরকার বিলাসপণ্য হিসেবে ফলের ওপর শুল্ক দ্বিগুণ করেছে। যার কারণে দামও দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। এতে মানুষের পুষ্টিঘাটতি তৈরি হবে কি?

গোলাম রহমান: আমাদের দেশে এখন প্রচুর ফল উৎপন্ন হচ্ছে। এখন অনেক বিদেশি ফলও দেশে উৎপন্ন হচ্ছে। সারা বছরই এখন বাজারে দেশি ফল পাওয়া যায়, যার কারণে পুষ্টির ঘাটতি তৈরি হবে বলে আমার মনে হয় না। সাময়িকভাবে বিদেশি ফল সরবরাহ কিছুটা কমে দাম বাড়লেও এই উদ্যোগের ফলে আমাদের ফল উৎপাদন বাড়বে।

প্রশ্ন: মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কিভাবে কমানো যেতে পারে? আমাদের বাজার ব্যবস্থাপনায় কী কী ঘাটতি আছে? এই ঘাটতি পূরণে আমরা কী করতে পারি?

গোলাম রহমান: মধ্যস্বত্বভোগী থাকে নানা কারণে, বিশেষ করে পচনশীল কৃষিজাত পণ্যের ক্ষেত্রে এটি সবচেয়ে বেশি। আমাদের বাজারব্যবস্থা এখনো খুব স্মুথ না। পচনশীলতা দূর করার জন্য যেসব পরিবহনব্যবস্থা থাকার কথা, সেগুলো নেই। যার ফলে ব্যবসায়ীরা মনে করেন, যত দ্রুত সম্ভব কিছুটা লাভ করে অন্যের কাছে পণ্য বিক্রি করে দিতে পারলেই তাঁদের ঝুঁকি কমে যাবে। মধ্যস্বত্বভোগী বেশি হওয়ার এটাও অন্যতম কারণ। মধ্যস্বত্বভোগী কমানোর জন্য যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতি করতে হবে, হিমায়িত পরিবহনব্যবস্থা চালু করতে হবে এবং পণ্য সংরক্ষণের জন্য হিমাগার স্থাপন করতে হবে। এতে পচনশীল পণ্য নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি কমবে এবং মধ্যস্বত্বভোগীর দৌরাত্ম্যও কমবে।

প্রশ্ন: ভোক্তাদের স্বস্তি দিতে এই মুহূর্তে করণীয় কী?

গোলাম রহমান: এই মুহূর্তে ভোক্তাদের স্বস্তি দিতে আয়-রোজগার বাড়াতে হবে এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে। ভোক্তাদের আয়-রোজগার বাড়লে পণ্যের মূল্য কিছুটা বৃদ্ধি পেলেও ভোক্তার জন্য কষ্টকর হবে না। যদি আয়-রোজগার মূল্যবৃদ্ধির চেয়ে বেশি হয়, তাহলে তার জীবনমানে উন্নতি হবে। আর আয়-রোজগার যদি মূল্যবৃদ্ধির চেয়ে কম হয়, তাহলে কিন্তু ভোক্তা সংকটে পড়বে। ভোক্তারা এখন সংকটে আছে, সেটা হলো আয়-রোজগারের সংকট। তাই সরকারকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে ভোক্তার আয়-রোজগার বাড়ানোর দিকে।

সৌজন্যে, কালের কণ্ঠ।