ভোক্তা না কি সিন্ডিকেট, কার স্বার্থ দেখবে?

এস এম নাজের হোসাইন: সরকারের নানাবিধ উদ্যোগে কৃষিতে দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং এক সময় আলু রপ্তানি করে বাংলাদেশ বিপলু বৈদেশিক মুদ্রা আয় করেছে। ২০২২ সালে আলু ব্যবসায়ীরা বিশেষ করে কোল্ডস্টোরেজ মালিকেরা লোকসান দিয়েছে বলে দাবি করলেও ২০২৩ সালে তার বিপরীত চিত্র দেখা যাচ্ছে।

সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডে আলুর বাজার লাগামহীন হতে হতে সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। সরকার দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে অবশেষে আলু আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আলুর বাজারের এই নিয়ন্ত্রণহীন পরিস্থিতি দুই মাস ধরেই চলছিল। সবগুলো নিত্যপণ্যের দামে দিশেহারা সাধারণ মানুষ।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, সেপ্টেম্বর মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ৬৩। কিন্তু খাদ্যে মূল্যস্ফীতি ছিল ১২ দশমিক ৩৭ শতাংশ। আগস্ট মাসে এই হার ছিল আরও বেশি ১২ দশমিক ৫৪। খাদ্য মূল্যস্ফীতির এই হার সাড়ে ১১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর আগে ২০১২ সালের জানুয়ারি মাসে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি ১২ দশমিক ৭৩ শতাংশে উঠেছিল।

রাজধানীর মোহাম্মদপুরের গৃহিনী রোজিনা বেগম বসবাস করেন স্বামীসহ পাঁচজন নিয়ে। স্বামী একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। যার মাসিক আয় সর্বসাকুল্যে ৩৫ হাজার টাকার মতো। বাসাভাড়া, খাওয়া-দাওয়া দুই সন্তানের পড়াশোনাসহ যাবতীয় খরচও চালাতে হয় এই টাকার মধ্যে।

রোজিনা জানান, বছরখানেক আগেও তার পরিবারের খাদ্য তালিকায় প্রতি সপ্তাহে মাংস থাকতো। এখন মাসে এক থেকে দুইবারের বেশি মাংস থাকে না। এক কেজি আলু আর এক কেজি বেগুন কিনতে গেলেই ১০০ টাকার বেশি লাগে।

নিত্যপণ্যের বাজারের বর্তমান অবস্থা জানানোর জন্য এর বেশিকিছু দরকার নেই। এক বছর আগে যেখানে মাসিক খরচ হতো ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা। এখন এই খরচ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৬ থেকে ৪০ হাজার টাকা। সেই অনুপাতে আয় বাড়েনি।

বাসাভাড়া বৃদ্ধি নিয়ে বছরের শেষ দিকে এসে রাজধানীতে বসবাস করা বেশিরভাগ সাধারণ মানুষের চিন্তা থাকে। কিন্তু এবার সেই চিন্তার আগে বড় দুশ্চিন্তা হয়ে দেখা দিয়েছে বাজার খরচের চাপ। ২০২২ সাল থেকে নিত্যপণ্যের বাজারে অস্থিরতা প্রতিনিয়তই পাল্লা দিয়েই বাড়ছে।

বাজারে খাদ্যপণ্যসহ প্রায় সব ধরনের পণ্যের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। সীমিত ও প্রান্তিক আয়ের মানুষ জীবন জীবিকা চালাতে খরচের চাপে নাকাল। একদিকে খাবারের খরচ চালাতে তারা হিমশিম খাচ্ছেন। নানাভাবে কাটছাঁট করেও এখন আর সামাল দিতে পারছেন না।

ধারদেনার পথও বন্ধ হয়েছে অনেক আগে। পরিস্থিতি সামাল দিতে না পেরে অনেকেই ইতিমধ্যে পরিবারের সদস্যদের গ্রামে পাঠিয়ে ঢাকায় একা থাকছেন। অনেকেই আবার পরিবার পরিজন নিয়ে ঢাকায় থাকলেও হাতে কিছু থাকছে না। বাড়িতেও বাবা-মায়ের জন্য টাকা পাঠাতে পারছে না। টানাটানি করেই সংসার চলছে।

নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে সরকার বেশ কয়েকটি উদ্যোগ নিয়েছেন। বিশেষ করে ডিম, পেঁয়াজ, আলুর দামও বেঁধে দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বাজার তদারকিতে কয়েক দিন ভোক্তা অধিকারের পক্ষ থেকে কিছু অভিযানও পরিচালিত হয়। কিন্তু তাতে শেষ পর্যন্ত তেমন কোনো লাভ হয়নি।

দেশে আলুর চাহিদার চেয়ে উৎপাদন উদ্বৃত্ত বলে কৃষি মন্ত্রণালয় যখন আলু রপ্তানি করছে, সেই সময় কৃষিপণ্যটির দাম কেন দেশের বাজারে সর্বোচ্চ রেকর্ড হবে আর সরকারকে আমদানির সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তা নিয়ে অনেকেই ভিন্নমত পোষণ করছেন। যদিও কৃষিমন্ত্রী আলুর এই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির জন্য কোল্ডস্টোরেজের মালিকদের সিন্ডিকেটকে দায়ী করেছেন।

দেশের ভোক্তাদের প্রতিনিধিত্বকারী প্রতিষ্ঠান কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) থেকে বারবার বলা হচ্ছিলো, বর্তমানে মজুতকৃত আলুর দেশব্যাপী সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারলেই আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশীয় আলুর চাহিদা পূরণ সম্ভব।

মূল সমস্যা হলো, কৃষকদের হাত থেকে আলু মধ্যস্বত্বভোগীদের হাতে চলে গেছে আর তারাই অতিমুনাফা করে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দেশের মানুষের পকেট কাটছে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় যখন এইসব পণ্যের দাম নির্ধারণ করে দেন, তখন ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তর ছাড়া মাঠে আর কাউকে পাওয়া যায়নি। একটা সময় জেলা ও উপজেলা প্রশাসন স্থানীয় মানুষের দুর্ভোগ ও সমস্যাগুলো লাগবে স্থানীয়ভাবে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করতেন। জেলার বিভিন্ন সরকারি দপ্তরগুলোর কাজের সমন্বয় সাধন করতেন।

বর্তমানে তারা এখন মানুষের ভোগান্তি লাঘবের চেয়ে রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানে অধিক আগ্রহী। তাই সাধারণ মানুষের নিত্যপণ্য নিয়ে আহাজারি, ডেঙ্গু, কোভিড মহামারিসহ নানা সমস্যায় তারা রাজনৈতিক দলগুলোর মতো বিমুখ হয়ে আছে। যার কারণে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের আলুর উৎপাদনকারী জেলা সমূহে এক মাসের বেশি সময় ধরে বাজার তদারকিতে প্রশাসনের কোনো নজরদারি নেই। আর এই কারণেই বিগত দুই মাস ধরে উচ্চ দামে স্থিতিশীল থাকা আলুর বাজার সিন্ডিকেটের আরও বেশি বেপরোয়া হয়ে অতি মুনাফার জন্য সুযোগ তৈরি করে দেওয়া হয়েছে।

এছাড়া বিকল্প বাজার হিসেবে টিসিবির কার্যক্রম জোরদার, সংকটকালীন সময়ে টিসিবির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক উৎস থেকে টিসিবির মাধ্যমে পণ্য আমদানির সুপারিশ কানে তোলা হয়নি।

দুই মাস ধরে আলুর বাজার অস্থিতিশীল থাকলেও আমদানির সিদ্ধান্ত নিতে বিলম্ব করা হলেই অতিমুনাফাকারীদের জন্য আরও মুনাফার পথ প্রশস্ত হলো। আগামী ডিসেম্বর মাসের প্রথম দিকে নতুন আলু বাজারে আসতে শুরু করবে। তাই আমদানির এই সিদ্ধান্ত কতটা সফল বয়ে আনবে?

এর আগে ডিমের ক্ষেত্রেও আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সরকার। দেড় মাস পেরিয়ে যাওয়ার পরও একটি ডিমও দেশে আসেনি। ডিমের আমদানিকারকদের কাছ থেকে জানা গেছে, আমদানি শুল্ক বেশি, ডলার সংকট ও ভারতে ডিমের দাম বেড়েছে। এই কারণে আমদানির সিদ্ধান্ত নিলেও সেই আলু দেশের বাজারে আদৌও পৌঁছাবে কি না, তার নিশ্চয়তা নেই।

দেশে শতভাগ উৎপাদিত আলুর মতো কৃষিপণ্যের বাজার অস্থিতিশীল হওয়ার পেছনে কৃষি মন্ত্রণালয়ের ভূমিকাও কম নয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় কৃষিপণ্য সংকট তৈরি হলেই উৎপাদন বৃদ্ধির পরিসংখ্যানের সত্যতা পাওয়া যায় না।

আলু-পেঁয়াজসহ নিত্যপণ্যের দাম নিয়ে প্রতিবছরই নানা কারসাজি হয়। আলুর কারসাজি হয় মূলত হিমাগার পর্যায়ে। আলুর দাম বাড়লেও কৃষকের কোনো লাভ নেই। কারণ তাদের হাতে আলু থাকে মূলত জুন মাস পর্যন্ত। সেই সময়ে তারা কম মূল্যে ও অগ্রিম দাদন নিয়ে আলু বিক্রি করতে বাধ্য হন।

জুলাই মাস থেকেই বাজার উর্ধ্বমুখী হতে শুরু করে। আর আলুর বাজারের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় হিমাগারকেন্দ্রিক বেপারী, কমিশন এজেন্ট, হিমাগারের মালিক ও আড়তদারসহ মধ্যস্বত্বভোগীদের হাতে। তারা সিন্ডিকেট করে দফায় দফায় আলুর দাম বাড়ান ও সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করেন।

ব্যবসায়ী নির্ভর বাজার ব্যবস্থাপনা, বাণিজ্য ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের মধ্যকার সমন্বয়হীনতা, জেলা প্রশাসনসহ বাজার তদারকি সংস্থাগুলো বাজার তদারকিতে নীরবতা, সমন্বয়হীনতা, আলুসহ নিত্যপণ্যের বাজারে ক্ষমতাসীন দলের নেতাসহ মৌসুমী ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার উদাসীনতাকেই অস্বীকার করার সুযোগ নেই।

সবাই সিন্ডিকেটকে দায়ী করলেও শর্ষের মধ্যে ভূত থাকলে সেই সিন্ডিকেট সরাবে ভাঙবে কীভাবে? তাই একই সময় সরকারকে আগে কৃষক, ভোক্তা স্বার্থ দেখবে, নাকি সিন্ডিকেটের স্বার্থ দেখবে, সেই নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

এস এম নাজের হোসাইন ।। ভাইস প্রেসিডেন্ট, কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)।