যেসব পদক্ষেপ না নিলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়

ড. সেলিম রায়হান: দেশে মূল্যস্ফীতি প্রায় এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। গত বছরের শুরু থেকে ১৮ মাসের বেশি সময় ধরে এটি একটি চলমান সমস্যা হয়েছে। এটি হচ্ছে সময়মতো মূল্যস্ফীতি রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা বাস্তবায়নে ব্যর্থতার ফল। যদিও ইউক্রেন যুদ্ধ মূল্যস্ফীতির ওপর প্রাথমিক প্রভাব ফেলেছিল, এত দীর্ঘ সময়ের পরে এটি একটি বৈধ অজুহাত নয়। অন্যান্য কারণ, যেমন এ সময়ের মধ্যে জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির দুই দফাও মূল্যস্ফীতিতে অবদান রেখেছে। যেহেতু জ্বালানি তেল অর্থনীতির প্রায় সব খাতের জন্য অপরিহার্য, তাই এর দাম বাড়া বেশির ভাগ পণ্য ও পরিষেবার খরচকে প্রভাবিত করে।

মূল্যস্ফীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তিনটি ক্ষেত্র রয়েছে, যেখানে আমরা গুরুত্বপূর্ণ ঘাটতি দেখতে পেয়েছি। তিনটি ক্ষেত্রেই নীতি প্রণয়ন ও নীতি বাস্তবায়নে ঘাটতি রয়েছে। প্রথমত, এ বছরের জুনে নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা না হওয়া পর্যন্ত ৬% থেকে ৯%- এ বাঁধা সুদের হারের নীতি বজায় রাখা হয়েছিল। এ নীতি বাজার অর্থনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না।

ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, শ্রীলঙ্কার মতো অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশে যখন মূল্যস্ফীতি বেশি ছিল, তখন তারা তাদের সুদের হার বেঁধে রাখেনি। তারা আরও বিচক্ষণতার সঙ্গে মুদ্রানীতি ব্যবহার করেছে এবং সুদের হার বাড়িয়ে বাজারে অর্থ সরবরাহ কমিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এটি করতে ব্যর্থ হয়েছে। এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ মুদ্রানীতির অধীন একটি সময়োপযোগী সুদের হারের ব্যবস্থা প্রবর্তনে পদক্ষেপ অপর্যাপ্ত ছিল। সুদের হারের সীমা অপসারণের পরও সাম্প্রতিক মুদ্রানীতি মূল্যস্ফীতি মোকাবিলায় অকার্যকর রয়ে গেছে।

সরকারও কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে প্রচুর পরিমাণে ঋণ নিয়ে মূল্যস্ফীতিতে অবদান রেখেছে, যা বাজারে অর্থ সরবরাহ বাড়িয়েছে। অধিকন্তু বেশ কয়েক বছর ধরে ডলারের বিনিময় হারকে কৃত্রিমভাবে বেঁধে রাখা হিতে বিপরীত হয়েছে। গত বছরের শেষের দিকে এবং এ বছরের শুরুতে খুব অল্প সময়ের মধ্যে টাকার ২৫ থেকে ৩০ ভাগ অবমূল্যায়ন হয়েছে। এই আকস্মিক এবং বৃহৎ অবমূল্যায়নও মূল্যস্ফীতিকে উসকে দিয়েছে। কারণ, এটি দেশীয় বাজারে আমদানি করা পণ্যের দাম যথেষ্ট বাড়িয়ে দিয়েছে। তাই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রানীতি ছিল অনুপযুক্ত ও অপর্যাপ্ত।

দ্বিতীয়ত, এ সংকটের সময়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাজস্বনীতির কার্যকর ব্যবহারের সুযোগ ছিল আমদানি পণ্যের ওপর বিভিন্ন কর ছাড় দিয়ে, অথচ তা সেভাবে দেখা যায়নি। তবে টাকার ২৫ থেকে ৩০ ভাগ অবমূল্যায়নের পরিপ্রেক্ষিতে একইসঙ্গে যখন বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম বেড়ে যায়, তখন সরকার অনেক আমদানি পণ্যের ওপর কর সমন্বয় করেনি। এ কারণে দেশীয় বাজারে অনেক পণ্যের দাম বেড়েছে। তাই অভ্যন্তরীণ বাজারে আমদানি করা পণ্যের জন্য কর কমিয়ে এবং প্রয়োজনে কর অব্যাহতি প্রদানের মাধ্যমে একটি যুক্তিসংগত মূল্যস্তর বজায় রাখতে রাজস্বনীতি কার্যকরভাবে ব্যবহার করা যায়নি।

তৃতীয়ত, অভ্যন্তরীণ বাজার ব্যবস্থাপনা এবং বাজার পর্যবেক্ষণ দুর্বলভাবে পরিচালিত। এর ফলে সাম্প্রতিক সময়ে অভ্যন্তরীণ বাজারে সর্বত্রই বিশৃঙ্খল অবস্থা বিরাজ করছে। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী কৃত্রিম ঘাটতি সৃষ্টি করে সংকটকে কাজে লাগিয়ে কোনো যুক্তি ছাড়াই পণ্যের মূল্যের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি করেন। বাজারের এ ধরনের কারসাজি রোধে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা দেখা যায়নি।

বাংলাদেশের বিপরীতে শ্রীলঙ্কা মূল্যস্ফীতির চাপ নিয়ন্ত্রণে সফল হয়েছে। গত দুই বছরে শ্রীলঙ্কা ভয়ানক পরিস্থিতির মুখোমুখি হলেও, তা থেকে সেরে উঠছে। এর একটি প্রধান কারণ হলো, সংকটের সময় শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীন ভূমিকা। শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংক সরকারের কোনো হস্তক্ষেপ ছাড়াই স্বাধীনভাবে সুদের হার এবং বৈদেশিক মুদ্রার হার নিয়ন্ত্রণ করেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদহার, বিনিময় হার এবং সরকারি ঋণ-সংক্রান্ত নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে স্বাধীন নয়। তদুপরি, আগে যেমন আলোচনা করা হয়েছে, অনুপযুক্ত রাজস্বনীতি এবং দুর্বল বাজার ব্যবস্থাপনাও বাংলাদেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে ভূমিকা রেখেছে।

প্রকৃত আয় মূল্যস্ফীতির দ্বারা হ্রাস পায় এবং ফলস্বরূপ সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পায়। ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতির কারণে শুধু প্রান্তিক মানুষই নন, নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্তরাও চরম চাপের মধ্যে রয়েছেন। অনেকে তাঁদের দৈনন্দিন খরচ মেটাতে সঞ্চয় বা ঋণের ওপর নির্ভর করতে বাধ্য হন। অনেকের জন্য এ ধরনের বিকল্পগুলোও খুব সীমিত।

সাধারণ মানুষ নিজেদের মতো করে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। দরিদ্র পরিবারের অনেকেই খাদ্যব্যয় হ্রাস করছেন এবং কম ব্যয়বহুল ও কম পুষ্টিকর খাবার কিনছেন। খাদ্যাভ্যাস এবং জীবনযাত্রায় এ পরিবর্তনের প্রভাব প্রজন্মের মধ্য দিয়ে যেতে পারে, যার ফলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের উৎপাদনশীলতা হ্রাস পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এভাবে দীর্ঘ মেয়াদে দেশে অপুষ্টির শিকার প্রজন্ম তৈরির ঝুঁকি বেড়ে যায়। করোনা মহামারি চলাকালে আমরা এটি ঘটতে দেখেছি। আর এখন উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে একই ঘটনা ঘটছে।

সরকারের উচিত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে কিছু জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া- ১. বাজারে নিত্যপণ্যের পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করা এবং প্রয়োজনে সময়মতো খাদ্যপণ্য আমদানি করা। ২. বাজারে মুদ্রার জোগান কমাতে এবং মূল্যস্ফীতি রোধ করতে মুদ্রানীতির কার্যকর ব্যবহার, বিশেষ করে সুদের হারের বাজারভিত্তিক সামঞ্জস্যকরণ। ৩. রাজস্বনীতির পুনর্মূল্যায়ন করা এবং অভ্যন্তরীণ বাজারে আমদানি করা পণ্যের দাম কমাতে আমদানিতে কর হ্রাস করা। ৪. বাজার ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা আনা এবং যুক্তিহীনভাবে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধিকারী ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কার্যকর আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা। পণ্যের দাম বেড়ে গেলে স্বল্পতম সময়ে প্রতিযোগিতামূলক আমদানির অনুমতি দিয়ে বাজার কারসাজিকারীদের বিরুদ্ধে সরকারের পক্ষ থেকে একটি বিশ্বাসযোগ্য হুমকির ব্যবস্থা রাখা। ৫. কার্যকর ভাবে বাজার পর্যবেক্ষণ এবং ভোগ্যপণ্যের চাহিদা ও সরবরাহ সম্পর্কে তথ্যের অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করা। কী পরিমাণ পণ্য প্রয়োজন এবং কতটা আমদানি করতে হবে, তার সঠিক পরিসংখ্যান সরকারের কাছে থাকা উচিত। ৬. দ্রব্যমূল্য তদারকিতে প্রাসঙ্গিক সরকারি বিভাগগুলোকে (যেমন প্রতিযোগিতা কমিশন) শক্তিশালী করা, যারা বাজার তদারকি এবং বাজারে ব্যবসায়ীদের দ্বারা প্রতিযোগিতাবিরোধী কর্মকাণ্ড প্রতিরোধ করার দায়িত্বে আছে।

মনে রাখা দরকার, মূল্যস্ফীতি কোনো একক সংস্থা বা নীতি দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। এর জন্য দরকার সুষ্ঠু মুদ্রানীতি, রাজস্বনীতি এবং সঠিক বাজার ব্যবস্থাপনার সমন্বিত প্রচেষ্টা।

লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক এবং সানেমের নির্বাহী পরিচালক।

সৌজন্যে, প্রথম আলো।