ভাঙারিতে বেচলো বিআরটিসির ভলভো বাস

প্রায় ২০ বছর আগে সুইডেন থেকে চড়া দামে ৫০টি আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত ভলভো বাস কেনে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন (বিআরটিসি)। দৃষ্টিনন্দন বাসগুলো প্রথম সাত-আট বছর সড়কে দাপটের সঙ্গে চলাচল করে। ধীরে ধীরে সেগুলোর বিভিন্ন যন্ত্রাংশ নষ্ট হতে শুরু করে। যন্ত্রাংশগুলো দেশে দুষ্প্রাপ্য ও ব্যয়বহুল হওয়ায় তা মেরামত করতে পারেনি সংস্থাটি।

ফলে অকেজো বিলাসবহুল বাসগুলো বিআরটিসির জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। দীর্ঘদিন পড়ে থাকার পর ৫০টি ভলভো বাসের মধ্যে ৪৯টি বিক্রি করে দিয়েছে বিআরটিসি। রাজধানীর বিভিন্ন ডিপোতে পড়ে থাকা এসব বাস ভাঙারি হিসেবে কেজিরদরে বিক্রি করা হয়েছে। সচল আছে কেবল একটি। সেটি রাজধানীর মিরপুর ডিপোর নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হচ্ছে। বাসটি এখন সুপ্রিম কোর্টের স্টাফদের আনা-নেওয়ার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে।

সরকারি দপ্তরগুলো কেনাকাটা পছন্দ করে। রক্ষণাবেক্ষণ করে তাদের কী লাভ? দরদ দিয়ে কাজ করলে, তার নিজের তো লাভ নেই। কিন্তু প্রকিউরমেন্টে (সরকারি ক্রয়) অনেক লাভ আছে। সেই চিন্তা মাথায় রেখে গাড়িগুলোর যত্নটা তারা সেভাবে নেন না।

বিআরটিসি সূত্র বলছে, ২০০১ সালে সুইডেন থেকে ৭০ কোটি টাকায় বাসগুলো কেনা হয়। সেই হিসাবে প্রতিটি বাসের দাম পড়ে প্রায় এক কোটি ৪০ লাখ টাকা। সরকারি তহবিল ও সুইডিশ ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এজেন্সির (সিডা) যৌথ অর্থায়নে বাসগুলো কেনা হয়। নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের তথ্যমতে, বাসগুলোর সাধারণ মেয়াদ ১২ বছর। তবে ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণ করা হলে চলবে ২০-২৫ বছর, যাকে আর্থিক মেয়াদ বলা হয়।

সংশ্লিষ্টদের মতে, যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বাসগুলো কাঙ্ক্ষিত সেবা দিতে পারেনি। সড়কে নামানোর সাত-আট বছর পর বাসগুলোর যন্ত্রাংশ নষ্ট হতে শুরু করে। তখন নতুন যন্ত্রাংশ কেনা উচিত ছিল। তা না করে একটি বাসের যন্ত্রাংশ নষ্ট হলে, আরেকটি বাস থেকে সেই অংশ খুলে লাগানো হতো। যেটি থেকে খুলে নেওয়া হতো, সেটি অকেজো হয়ে পড়ে থাকতো। এভাবে এক-একটি করে বাস অকেজো হতে থাকে।

ফলে নির্ধারিত মেয়াদের আগেই ৪৯টি বাস অকেজো হয়ে পড়ে। দফায় দফায় রক্ষণাবেক্ষণের প্রকল্প হাতে নিলেও সেই উদ্যোগ বাস্তবায়ন হয়নি। অবশেষে বোঝা হয়ে থাকা অকেজো সেই বাসগুলো বেচে দেয় বিআরটিসি।

পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু ভলভো নয়, এ পর্যন্ত যত বাস কেনা হয়েছে; সেগুলোর কোনোটিরই যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়নি। ফলে প্রত্যাশিত সার্ভিসও পাওয়া যায়নি। দেশে একটি বাজে সংস্কৃতি চালু রয়েছে, তা হলো রক্ষণাবেক্ষণের চেয়ে নতুন কেনায় আগ্রহ বেশি। নতুন করে কিনলে লাভ বেশি, রক্ষণাবেক্ষণে তো সেটি নেই।

এ বিষয়ে পরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সামছুল হক বলেন, ‘সরকারি দপ্তরগুলো কেনাকাটা পছন্দ করে। রক্ষণাবেক্ষণ করে তাদের কী লাভ? দরদ দিয়ে কাজ করলে, তার নিজের তো লাভ নেই। কিন্তু প্রকিউরমেন্টে (সরকারি ক্রয়) অনেক লাভ আছে। সেই চিন্তা মাথায় রেখে গাড়িগুলোর যত্নটা তারা সেভাবে নেন না।’

তিনি বলেন, ‘ওই (ভলভো) গাড়িগুলোর যেহেতু মেনটেইনেন্স সেভাবে হতো না। ভলভোর একটা পার্টস (যন্ত্রাংশ) না থাকলে আরেকটা থেকে খুলে নিয়ে এসে সেটি সচল রাখতো। এসব করতে করতে কিছু বাস এমনিতেই অকেজো হয়ে গেছে।’

অধ্যাপক সামছুল হক বলেন, ‘বড় কথা হলো—এখানে জবাবদিহিতার সিস্টেম নেই। পাশাপাশি বিআরটিসি যেটা করে, প্রাইভেট সেক্টরের মতো তারাও লিজ দেয়। অথচ মেনটেইনেন্সটা নিজেদের ঘাড়ে রাখে। লিজ যারা নেন, তারা তো আসেন বড় লোক (ধনী) হতে। নিজের গাড়ি যেভাবে দরদ দিয়ে চালান, এটাকে তো তা করেন না। বিআরটিসির গাড়ির অপব্যবহার করে তারা ধনী হন। ফলে শুধু ভলভো নয়, কোনো বাসই টেকসই হয়নি, হচ্ছে না। এটার জন্য তাদের কোনো দর্শনও নেই। এবার পারলাম না, পরেরবার যেন পারি, তেমন চিন্তাও নেই।’