ভোক্তারা সচেতন হলে প্রতারণা কমে যাবে: সফিকুজ্জামান

ভোক্তাকণ্ঠ রিপোর্ট: এ. এইচ. এম. সফিকুজ্জামান। জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক। ২০২২ সালের ০২ ফেব্রুয়ারি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করে তাকে এই দায়িত্ব দেওয়া হয়। এর আগে তিনি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন।

সম্প্রতি ভোক্তাকণ্ঠকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে বর্তমান বাজার পরিস্থিতি, ভোক্তাদের অধিকার ও ভোক্তা-অধিকার আইন নিয়ে কথা বলেছেন ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ. এইচ. এম. সফিকুজ্জামান। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শেখ রিয়াল।

ভোক্তা ও পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো-

ভোক্তাকণ্ঠ: ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল এই সময়ের মধ্যে ভোক্তা অধিদপ্তর ভোক্তার অধিকার কতটুকু নিশ্চিত করতে পেরেছে বলে আপনি মনে করছেন?

এ. এইচ. এম. সফিকুজ্জামান: ভোক্তার অভিযোগ বা ভোক্তার যে অধিকারের প্রশ্ন, এটি ব্যাপক বিষয়। আমরা এটি নিয়ে কাজ করছি। ভোক্তাকে আমরা সচেতন করছি। এর বাইরে আমরা বাজারের মূল্য নিয়ন্ত্রণ, ভেজাল, নকলের বিরুদ্ধে আমরা নিয়মিত বিভিন্ন অভিযান করছি। ভোক্তারা তাদের অভিযোগের প্রতিকার চাচ্ছে, সেগুলোও আমরা সমাধান দিচ্ছি। তবে যদি ২০০৯ থেকে আজকে ২০২৩ সালের কথা বলি মানুষ অন্তত জানে জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর নামে একটি সরকারি সংস্থা আছে। সেখানে তারা অভিযোগ করতে পারে এবং সেই অভিযোগের তারা প্রতিকার পেতে পারে। এটুকুই আমাদের অর্জন।

ভোক্তাকণ্ঠ: কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে নিত্যপণ্যের বাজার, পশুর হাট, চামড়ার বাজার নিয়ন্ত্রণে অধিদপ্তর কি কি কার্যক্রম হাতে নেবে?

এ. এইচ. এম. সফিকুজ্জামান: কোরবানির ঈদে মূলত আমাদের দুটি বিষয় আছে। এটা হলো কোরবানির আগেই মসলার দাম বেড়ে যায়। সেটা নিয়ে আমরা ইতোমধ্যেই কাজ শুরু করেছি। বিশেষ করে আদার দাম অত্যাধিক ছিল এবং এটি নিয়ে আমরা কাজ করেছি। এছাড়াও গরম মসলা বলতে এলাচি, দাঁড়চিনি, জিরাসহ এগুলোর অবৈধ ভাবে মজুত করে বাজারকে অস্থির করছে কি না, এটা নিয়ে আমরা কাজ করছি। এর বাইরে যেমন পেঁয়াজের বিষয় ছিল, আগে থেকেই আমরা বলেছিলাম যে আইপি খুলে দিলে পেঁয়াজের বাজারে স্বস্তি আসবে। কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে আইপি খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্তে ইতোমধ্যেই পেঁয়াজের বাজারে প্রভাব পড়েছে। বাংলাদেশে আমদানি করা পেঁয়াজ আসতে শুরু করেছে। বাংলাদেশের পোর্টগুলোতে কেজিতে ২৫ টাকা এবং খাতুনগঞ্জ, শ্যামবাজারের আড়ৎগুলোতে ৩০ টাকা নিম্নমুখী হয়েছে। আমরা আশা করছি যে, পাইকারী এবং খুচরা বাজারে দুই-একদিনের মধ্যে ৫০ টাকা কেজির মধ্যে চলে আসবে। এগুলোর বিষয়ে আমরা পদক্ষেপ নিচ্ছি।

এর বাইরে কোরবানির চামড়া নিয়ে আমাদের ব্যাপক কার্যক্রম আছে। বিশেষ করে লবণ মাখানো থেকে শুরু করে চামড়াটাকে প্রিজার্ভ করা, একদিনে প্রায় ৫০ লাখ চামড়া উৎপাদন হয়। সেটাকে এই গরমের মধ্যে যাতে প্রিজার্ভ করা যায় সে জন্য লবণ মাখানো দরকার। লবণের জন্য ইতোমধ্যেই বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে মিটিং হয়েছে। আমিও ভোক্তা অধিদপ্তরে মিটিং করবো। সেখানে এ বছর বাম্পার লবন উৎপাদন হলেও দেখা গেল যে গত বছর যে খোলা লবণের দাম ছিল ১২ টাকা এই মুহুর্তে সেটি ১৮ টাকা। এটা নিয়ে আমরা কাজ করছি। আরেকটি বিষয় হলো যে, কোরবানির চামড়া যাতে ঢাকামুখী না হয়, ঢাকায় যেহেতু সাভার বা আমাদের পুরান ঢাকায় চাপ পড়ে, আমরা এ বিষয়েও ব্যবস্থা নিচ্ছি। আমরা যদি পর্যাপ্ত লবণ মেখে চামড়াটা প্রিজার্ভ করতে পারি তাহলে এই দেশিও সম্পদ রক্ষা করা সম্ভব হবে। এছাড়া পশুর হাটে অনেক সময় প্রতারণার বিষয় থাকে। সেখানে আমাদের স্থানীয় মন্ত্রণালয় থাকবে, স্থানীয় প্রশাসন থাকবে। সেই সঙ্গে আমাদের ভোক্তা অধিদপ্তরের কার্যক্রম থাকবে। ঢাকায় দেখা যায়, পশুগুলোকে ট্রাকে আটকে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করা হয়। সেটা যাতে এবার না হয় সে বিষয়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে আমরা কাজ করবো।

ভোক্তাকণ্ঠ: ভোক্তাদের অভিযোগ, ভোক্তা অধিদপ্তরের কার্যক্রম শুধু ঢাকা কেন্দ্রীক, উপজেলা বা আরও তৃণমূল পযায়ে তেমন নেই। এ বিষয়ে আপনার ব্যাখা কি?

এ. এইচ. এম. সফিকুজ্জামান: এই ধারণাটা সঠিক নয়। সারা বাংলাদেশেই আমাদের অভিযান চলে। প্রতিদিন ৪০ থেকে ৪৫টি অভিযান পরিচালিত হয়। ঢাকাতে মাত্র তিন থেকে চারটি অভিযান চলে। গণমাধ্যমগুলো ঢাকার অভিযানগুলো হাইলাইট করে। এ জন্য ঢাকার অভিযানগুলো মানুষ দেখছে। তবে আমাদের অভিযান সারাদেশেই হচ্ছে। জেলা, উপজেলার অভিযানের খবরও স্থানীয় মিডিয়াগুলোতে আসছে। এছাড়া জাতীয় গণমাধ্যমেও জেলা, উপজেলার অভিযানের নিউজগুলো দেখাচ্ছে। তারপরও আমাদের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আমাদের যে প্রয়োজন সে অনুসারে প্রতিটি উপজেলা বা জেলায় প্রতিদিন অভিযান করা সম্ভব হয় না। এ জন্য আমরা জনবল বৃদ্ধির কার্যক্রম হাতে নিয়েছি।

ভোক্তাকণ্ঠ: ভোক্তা-অধিকার আইন ২০০৯, বর্তমান সময়ে ভোক্তাদের অধিকার আদায়ে কতটুকু কার্যকর বলে মনে করছেন?

এ. এইচ. এম. সফিকুজ্জামান: ২০০৯ সালের তখনকার প্রেক্ষাপট আর এখনকার প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হয়েছে। মানুষের প্রতারণার কৌশলও পরিবর্তন হয়েছে। এর মধ্যে ই-কমার্স ব্যবসায় বড় ধরনের প্রতারণা হয়েছে, এটা আপনারা জানেন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে এটা নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। আর ভোক্তা অধিদপ্তরে যে অভিযোগগুলো এসেছে সেগুলো আমরা নিষ্পত্তি করতে পারছি না, কারণ আইনগত কিছু জটিলতা আছে। এ জন্য আমাদের নতুন আইনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। এটা ফাইনাল স্টেজে আছে। ই-কমার্স ইস্যূগুলো নিয়ে ভিন্ন একটা অধ্যায় আমরা করছি। এছাড়া ২০০৯ সালের আইনে শাস্তির যে বিধানগুলো আছে, অর্থদণ্ড বা অন্যান্য দণ্ড আছে, নতুন আইনে দণ্ডগুলোকে যাতে দিগুন বৃদ্ধি করা হয়, সে বিষয়ে আমরা সুপারিশ করেছি। এর বাইরে আমরা ১০টা সার্ভিস সেক্টর নিয়ে কাজ করি। পর্যটনসহ আরও পাঁচটি সার্ভিস সেক্টর যুক্ত করেছি। আমি আশা করবো যে, এই আইনটি যদি আমরা দ্রুত জাতীয় সংসদ থেকে পাশ করাতে পারি তাহলে ভোক্তা স্বার্থ রক্ষায় এই আইনটি রক্ষাকবজ হিসেবে কাজ করবে।

ভোক্তাকণ্ঠ: কনজুমারস এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) নেতৃবৃন্দ বলছেন, ভোক্তা স্বার্থ সুরক্ষায় বর্তমান ভোক্তা-অধিকার আইনের সম্প্রসারণ প্রয়োজন। কোন কোন ক্ষেত্রে সম্প্রসারণ প্রয়োজন বলে মনে করছেন?

এ. এইচ. এম. সফিকুজ্জামান: সম্প্রসারণের বিষয়টি উচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্ত। যেমন ভারতে ভোক্তা-অধিদপ্তর নয়, এর জন্য সম্পূর্ণ আলাদা মন্ত্রণালয় রয়েছে। সেখানে আমাদের ভোক্তা-অধিকার যেটা ক্যাবের আন্দোলনের ফসল এই অধিদপ্তর। ২০০৯ সালে আইন হলেও ২০১১ থেকে এই অধিদপ্তরের মূল কাঠামো তৈরি হয়েছে। সেটা আমাদের ১০-১২ বছরের পদযাত্রায় আমাদের অধিকারের প্রশ্ন, সচেতনতার প্রশ্ন, এগুলো মানুষের কাছে আরও বেশি নিবির ভাবে কাজ করার সুযোগ আছে। সেটা সরকার বিবেচনা করবে। যে এটি পৃথক মন্ত্রণালয় বা অন্য কিছু হবে কি না? আর আমাদের সক্ষমতার যেটুকু ঘাটতি আছে সে জন্য আমরা জনবল নিয়োগসহ আমাদের শক্তি বৃদ্ধির জন্য যা যা প্রয়োজন তা নিয়ে কাজ করছি।

ভোক্তাকণ্ঠ: সম্প্রতি অভিযোগ করার জন্য অভিযোগ পোর্টাল খোলা হয়েছে, সব মিলিয়ে অভিযোগ কেমন বেড়েছে? অভিযোগ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে অধিদপ্তরের কাজের অগ্রগতি কেমন?

এ. এইচ. এম. সফিকুজ্জামান: আমাদের যে অভিযোগের পদ্ধতি ছিল স্বশরীরে অফিসে এসে অভিযোগ করা যেত অথবা চিঠি লিখে বা মেইলের মাধ্যমে অভিযোগ করা যেত। অনেক ক্ষেত্রেই মেইলে সকলের এক্সসেস থাকে না। আবার অভিযোগ দায়েরের যে পদ্ধতি, হয়তো সিলি কোনো ঘটনা, যেগুলো নিয়ে মানুষ ওতো বেশি আগ্রহী হতো না অফিসে এসে অভিযোগ দায়ের করতে। এ কারণে আমরা নিজেরাই কনজুমারস কমপ্লেইন ম্যানেজম্যান্ট সিস্টেম (সিসিএমএস) তৈরি করেছি। এখানে একটা মোবাইল অ্যাপসের মাধ্যমে বাংলাদেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে যে কেউ অভিযোগ দায়ের করতে পারে। এটা গত ১৫ মার্চ ভোক্তা দিবসে অফিশিয়ালি চালু করেছি। এটা আপাতত ঢাকার জন্য পাইলটিং প্রজেক্ট হিসেবে আছে। পরবর্তীতে সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে দেব। আপাতত আমি জানি যে এই দুই/তিন মাসে ছয় হাজার অভিযোগ পড়েছে। এটাতে মানুষের আগ্রহ তৈরি হয়েছে। মানুষ সিসিএমএসের মাধ্যমে অভিযোগ করছে। এর মাধ্যমে মানুষ যেকোনো প্রান্ত থেকে অথবা বাসায় অথবা যেখানে সে প্রতারিত হচ্ছে সেখাবে বসেই অভিযোগ দায়ের করতে পারে। অভিযোগ দায়ের করার পর তাৎক্ষণিক ভোক্তা একটি ওটিপি পাবে। সে ওটিপি অনুসারে তার অভিযোগের একটা সিরিয়াল নাম্বার বা কোড নাম্বার থাকবে। সে অনুসারে তার অভিযোগের শুনানি বা বিচারিক কার্যক্রম চলমান থাকবে তখন সে প্রতিটা মুহুর্তে মেসেজ পাবে। তবে শুনানিতে অভিযোগকারীকে স্বশরীরে উপস্থিত থাকতে হবে।

ভোক্তাকণ্ঠ: ভোক্তা অধিদপ্তরে আপনার প্রায় দেড় বছরের দায়িত্বে ভোক্তাদের অধিকার নিশ্চিত করতে বা সচেতন করতে উল্লেখযোগ্য কি কি উদ্যোগ নিয়েছে এবং আগামীতে কি কি নিতে চান?

এ. এইচ. এম. সফিকুজ্জামান: প্রথমত আমার মূল্যায়ন তো আমি করবো না, এটা আপনারা করবেন। তবে আমি যে জিনিসটি বলতে পারি, ভোক্তা অধিদপ্তরে আমার পথ চলা ১৫ মাস। আমি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে দীর্ঘদিন কাজ করেছি। আমি ইন্টারনাল ট্রেড এন্ড ইম্পোর্ট দেখতাম। সে ক্ষেত্রে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাজ এবং ভোক্তা অধিদপ্তরের কাজের কিছুটা মিল আছে। এখানে এসে আমি চেষ্টা করেছি, কিভাবে মানুষের কাছে যাওয়া যায়। সে বিষয়ে আমি কিছু পদক্ষেপ নিয়েছি। বিশেষ করে সোসাল মিডিয়াকে আমরা খুব ভালো ভাবে ব্যবহার করেছি। আমাদের অফিশিয়াল ফেসবুক পেইজ এবং ইউটিউব চ্যানেল আছে। সেখানে আমাদের অভিযানগুলো প্রচার করি। সেখানে প্রচুর মানুষ আমাদের অভিযানগুলো দেখে। এ থেকে মানুষ সচেতন হচ্ছে। ভোক্তার অধিকার বা ভোক্তার স্বার্থ রক্ষার জন্য এ কাজটা তো অনেক ব্যাপক।

আমরা কাজ করছি এবং আমার যেটা ধারণা গত দেড় বছরে জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর সম্পর্কে অনেক মানুষ এখন জানে। এটাও জানে যে, এখানে যদি কোনো অভিযোগ করা হয় বা ভোক্তা-অধিকারের কোনো বিষয়ে নালিশ করা হয় সেটার প্রতিকার পাওয়া যাবে। এই আত্মবিশ্বাস মানুষের মধ্যে আছে। তবে অনেকেই একটা ভুল ধারণা করে, আমিও কিছু ফিডব্যাক পাই, যে তাদের অভিযোগগুলো নিষ্পত্তি হচ্ছে না। সেগুলোর কিছু টেকনিক্যাল বিষয় আছে। প্রথমত যে অভিযোগকারী তার সঙ্গে যোগাযোগের নাম্বার থাকতে হবে। তার ঠিকানা থাকতে হবে। একইসঙ্গে যার বিরুদ্ধে অভিযোগ তার ঠিকানা বা যোগাযোগ নাম্বার থাকতে হবে। এভাবে ত্রুটিপূর্ণ আবেদন থাকলে সেগুলো আমরা নিষ্পত্তি করতে পারছি না।

দ্বিতীয়ত, অভিযোগ প্রমাণের জন্য যে ডুকুমেন্টস, সেগুলো যদি সাবমিট না করে তাহলে আমরা কিভাবে এই অভিযোগ প্রমাণ করবো। এমন অনেকগুলো কারণে আমাদের অভিযোগ পেন্ডিং থেকে যাচ্ছে। আর একটি বিষয় হচ্ছে, ই-কমার্স রিলেটেড যে অভিযোগগুলো রয়েছে সেগুলোর ক্ষেত্রে, যে প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ তাদের অনেকেই দেশের বাইরে চলে গেছে, মানি লন্ডারিং হয়েছে, কেউ আন্ডারগ্রাউন্ডে আছে। তাদের অফিস দুই বছর থেকে বন্ধ। সে ক্ষেত্রে তো এসব অভিযোগ আমরা নিষ্পত্তি করতে পারছি না। মানুষের আক্ষেপের বড় জায়গাটা হলো ই-কমার্সের অভিযোগগুলো নিষ্পত্তি হচ্ছে না। কিন্তু আমাদের তো এটা করার সুযোগ নেই। যেহেতু অনেকগুলো সিআইডিতে মামলা হয়েছে, মানি লন্ডারিং হয়েছে, তারা বিদেশে গিয়ে পলাতক অবস্থায় রয়েছে। সেটা তো আমার আইনে আমরা করতে পারবো না।

ভোক্তাকণ্ঠ: সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভিডিও দেওয়া নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে। অনেকেই বলছেন, ফেসবুক, ইউটিউবে ভিডিও দিয়ে ভোক্তার অধিকার রক্ষা হবে কি না? এ বিষয়ে আপনার ব্যাখ্যা জানতে চাই।

এ. এইচ. এম. সফিকুজ্জামান: যারা বিতর্ক করে তারা যেকোনো বিষয় নিয়েই বিতর্ক করবে। প্রথম কথাটা হচ্ছে- আইনে আমাকে বলা হচ্ছে মানুষকে ভোক্তার অধিকার সম্পর্কে সচেতন করা। সচেতন করার জন্য আমাদের যে ট্রেডিশনাল সিস্টেম আছে, যে লিফলেট বিতরণ বা দুই/একটা সেমিনার। এটা দিয়ে আমি কত লোকের কাছে পৌঁছাতে পারবো। কিন্তু আমরা যেটা করছি, আমাদের একটা ভিডিও মিলিয়ন ভিউ হয়েছে। তার মানে কি আমি চার কোটি মানুষের কাছে যেতে পারছি। এটা তো মানুষের কাছে পৌঁছানোর একটা প্ল্যাটফর্ম। এখন যারা সমালোনা করছে তারা বিভিন্নভাবে সমালোচনা করবে। আমরা সেই সমালোচনা শুনবো। কিন্তু আমরা আমাদের কাজ করতে থাকবো। আমার তো একটা প্ল্যান নিয়ে আগাতে হবে। আমাকে মানুষের কাছে পৌছাতে গেলে সোসাল মিডিয়া ফেসবুক ইউটিউব এখন বাংলাদেশের মানুষের কাছে ব্যাপক ব্যবহার হচ্ছে। আমি এই মাধ্যমকে ব্যবহার করে মানুষের কাছে পৌঁছাবো। এটা আইন মেনেই করছি। আমাদের একটা কাউন্সিল আছে এবং আমরা সরকারি ভাবে এপ্রুভাল নিয়ে এটা করছি। এটা এমন না যে আমাদের ইচ্ছেমত আমরা করছি, তা নয় কিন্তু।

ভোক্তাকণ্ঠ: সাধারণ পর্যায়ের ভোক্তাদের অভিযোগ রয়েছে, অধিদপ্তর বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান ও সিন্ডিকেটের অসাধু কর্মকাণ্ডের বিপরীতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারছে না। এ প্রসঙ্গে আপনার মতামত কি?

এ. এইচ. এম. সফিকুজ্জামান: আপনারা দেখেন যে আমাদের অভিযানগুলো খুচরা বা পাইকারী বাজারে হয়। আপনারা বলেন যে আমরা কর্পোরেটগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি না। এই কথাগুলো সত্য নয়। আমরা প্রত্যেকটি কর্পোরেট গ্রুপের ফ্যাক্টরিতে একাধিকবার লাইভ ক্যামেরা নিয়ে গিয়েছি। তাদের অনিয়মগুলো আমরা বের করেছি। সেগুলো বের করে আমরা সরকারের কাছে জানিয়েছি। এবং প্রতিযোগীতা কমিশনে ৫৪টি মামলা হয়েছে। এটা ভোক্তা-অধিকার আইনে কাভার করে না। প্রতিযোগীতা কমিশনের আইনে এই বিষয়গুলো কাভার করে। কর্পোরেটগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিযোগীতা কমিশনে ৫৪টি মামলা হয়েছে। আপনারা এসব প্রচার করেন। ভোক্তা অধিদপ্তরের অভিযানের ফলেই এই মামলাগুলো হয়েছে। এখন অনেক ক্ষেত্রেই আছে, যা আমার আইনে বিচার করা যায় না কিন্তু অন্য আইনে বিচার্য। এখন সেই জিনিসটা তো আমি করতে পারবো না। আমাদের আইন অনুযায়ী যে ব্যবস্থাগুলো রয়েছে সেগুলো আমরা করছি। আমাদের কিছু বিষয়ে কিন্তু আমরা নিজেরাও ফৌজদারি মামলা করেছি। ডিমের ক্ষেত্রে এবং ই-কমার্সগুলোর কিছু ক্ষেত্রে আমরা নিজেরাই মামলা করেছি। আমরা কিন্তু মামলা করছি। আর কর্পোরেট গ্রুপগুলো সম্পর্কে যেটা বলা হয়, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছি না, এটা ঠিক নয়। নিয়মিত মনিটরিং চলছে, প্রতিদিন তারা আমাদেরকে রিপোর্ট দিচ্ছে।

ভোক্তাকণ্ঠ: আমরা সম্প্রতি দেখেছি পেঁয়াজ, আলু, কাঁচা সবজি এবং বিভিন্ন মসলার দাম অস্বাভাবিক ভাবে বেড়েছে। এ ক্ষেত্রে অধিদপ্তর থেকে অভিযানও চালানো হচ্ছে। এই পরিস্থিতির পেছনের কারণ কী? এই অবস্থা থেকে উত্তরণে আপনার প্রতিষ্ঠানের পদক্ষেপ কি?

এ. এইচ. এম. সফিকুজ্জামান: নিত্যপণ্যের মূল্য শুধু বাংলাদেশেই না এটা সারা বিশ্বেই বৃদ্ধি পেয়েছে। সেগুলোর কিছু যৌক্তিক কারণও আছে। আপনারা জানেন আমরা এখন কঠিন সময় পার করছি। কোভিডকালীন সময়ে আমাদের উৎপাদন কমে গেছে। পরবর্তীতে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের একটা প্রভাব পড়েছে। আবহাওয়া পরিবর্তন একটা বড় ইস্যূ। আমাদের ডলারের পেমেন্টের ক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ৮৬ টাকার ডলার এখন ১০৭ টাকায় কিনতে হচ্ছে। এছাড়া আমাদের দেশের অনেক কিছুই ইম্পোর্ট নির্ভর। বিশেষ করে ভোজ্যতেল, চিনিতে আমাদের ১০০ ভাগ ইম্পোর্ট নির্ভরতা। এগুলো যৌক্তিক কারণ। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, বড় জাহাজে পণ্য আনার ক্ষেত্রে এক লাখ টনের একটা মাদার ফেসেল আসে। সেখানে হয়তো ৮০ মিলিয়ন ডলার পেমেন্ট। এটা হয়তো ব্যাংক অনেক ক্ষেত্রে সময়মতো দিতে পারে না। সেখানে ডেমারেজ দিতে হচ্ছে। জাহাজ বসে থাকছে। এগুলোর প্রভাব দ্রব্যমূল্যের উপর পড়ছে।

এছাড়া, আমাদের দেশে উৎপাদিত পণ্যের ক্ষেত্রে ডিজেল, সারের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। এই দাম বৃদ্ধিও আমাদের উৎপাদন খরচের উপর পড়েছে। এগুলো নিয়ে আমরা কাজ করছি। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে অসাধু কিছু ব্যবসায়ী একটা অজুহাত দিয়ে তারা বাড়তি মুনাফার চিন্তা করে। তারা নিত্যপণ্যগুলোকে মজুত করে রাখে। তারা বিপণন ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে। এগুলো প্রতিটি বিষয় নিয়ে গোয়েন্দা বাহিনীসহ আমরা কাজ করছি। এই অনিয়মগুলো আমরা যেখানেই পাচ্ছি তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিচ্ছি।

ভোক্তাকণ্ঠ: ভোক্তাদের সচেতন করতে আপনার যদি কোনো বার্তা থাকে।

এ. এইচ. এম. সফিকুজ্জামান: প্রথম যেটি সমস্যা হলো- ভোক্তারা তাদের অধিকার সম্পর্কে জানে না। জানানোর জন্য আমরা কাজ করছি। আমরা সভা, সেমিনার এবং ভিডিওগুলো ছড়িয়ে দিয়ে সচেতন করার চেষ্টা করছি। আমি একটা উদাহরণ দিতে চাই- ঈদের আগে পোশাকের কেনাকাটা বেড়ে যায়। সেখানে অনেক মানুষ প্রতারণার শিকার হয়। দুই হাজার টাকা একটি পোশাক দেখা গেল আট হাজার, ১০ হাজার টাকার তিন/চার বার স্টিকার লাগিয়ে বিক্রি করছে। এগুলো নিয়ে আমরা কাজ করছি। এই ভিডিওগুলো ফেসবুক, ইউটিউবে মানুষ দেখছে। মানুষ সচেতন হচ্ছে। ভোক্তাদের বড় একটা বিষয় হচ্ছে যে তারা সচেতন নয়। যদি প্রতিটা মানুষ সচেতন হতো তাহলে অতিরিক্ত মূল্যে যে বিক্রি করছে, তারা এসব বিষয়ে প্রতিবাদ করতো। প্রতিবাদ করলেই এসব প্রতারণা আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যেত।

আরেকটি বিষয় মানুষ অনেক সময় প্যানিক হয়ে যায়। যেমন পেঁয়াজের সংকট হবে ভেবে বাজার থেকে অতিরিক্ত পেঁয়াজ কিনে মজুত করে। এতে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি হয়। আর যতক্ষণে ভোক্তার অধিকার নিয়ে সেই ভোক্তা সচেতন না হবে সেখানে আমাদের এই আইনী ব্যবস্থা বা আমাদের এই অভিযান সেটি আসলে প্রকৃত অর্থে শতভাগ সফল হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত ভোক্তাদের অংশগ্রহণ না হবে। এর জন্য আমি বলবো ভোক্তারা তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হবেন এবং সেই অধিকারের জন্য তাকে সেই কথাগুলো বলতে হবে, চ্যালেঞ্জ করতে হবে। সেখানে প্রতিকার না পেলে তখন আমাদের কাছে অভিযোগ দায়ের করতে হবে। এবং সেখান থেকে আমরা তাদেরকে প্রতিকার দেওয়ার ব্যবস্থা করতে পারি।